স্বপ্নের শহর হবে হবিগঞ্জ পৌরসভা, এমন প্রত্যাশা ছিল বাসিন্দাদের। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ তো দূরের থাক, পৌরবাসীকে বাঁচতে হচ্ছে হাই-হুতাশ করে।
পৌরসভার চেয়ার বদল হয়েছে অনেকবার। কিন্তু বদলায়নি পৌরবাসীর ভাগ্য। নানা সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে বসবাস করতে হচ্ছে প্রথম শ্রেণির এ পৌরসভার বাসিন্দাদের।
২৮ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ সদর পৌরসভায় ভোট সামনে রেখে ভোটাররা জানিয়েছেন তাদের চাওয়াপাওয়ার কথা।
বছর বছর কর বাড়লেও, বাড়েনি সুযোগসুবিধা। অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, যানজট, অকেজো ড্রেনেজ ব্যবস্থা, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনার স্তূপ, অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতাসহ নানা সমস্যা নিয়েই বাস করতে হচ্ছে পৌরবাসীকে।
১৮৮১ সালে ৯.৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে হবিগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হয়। পরে ১৯৯০ সালে হবিগঞ্জ পৌরসভাকে প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় উন্নীত করা হয়। এ পৌরসভার জনসংখ্যা প্রায় ৯৫ হাজার।
যানজটে নাকাল পৌরবাসী
হবিগঞ্জ পৌরসভার সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট। এই পৌরসভার সড়কগুলো সরু হওয়ায় দিনের পর দিন যানজট লেগেই থাকে। হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার সামনে থেকে চৌধুরী বাজার পর্যন্ত মাত্র দেড় কিলোমিটারের রাস্তা। অথচ এই সড়কে প্রতিদিন চলাচল করে পাঁচ হাজারেরও বেশি টমটম ইজিবাইক। সেই সঙ্গে কয়েক হাজার রিকশা।
নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, ছোট শহর হবিগঞ্জে ১ হাজার ২০০ টমটম-ইজিবাইকের বেশি চলাচল করা সম্ভব নয়। অথচ পাঁচ হাজারের বেশি টমটম-ইজিবাইকের অনুমোদন দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে নতুন করে আরও শতাধিক টমটম-ইজিবাইকের অনুমোদন দিয়েছে পৌরসভা। এ কারণে যানজটের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষকেই দুষছেন তারা।
হবিগঞ্জ পৌরসভার শ্যামলী এলাকার বাসিন্দা পল্লব চৌধুরী বলেন, ‘শহরের যানজটের অবস্থা কী বলব। প্রতিবছর ট্যাক্স বেড়ে দ্বিগুণ হয়। বাড়ি বানাতে ট্যাক্স লাগে, গাছ কাটতে ট্যাক্স লাগে। কিন্তু এত টাকা ট্যাক্স দিয়েও আমাদের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি পায়নি। যানজটের কারণে শহরে বের হওয়া যায় না।’
মামুনুর রহমান নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘হবিগঞ্জ ছোট্ট একটা শহর। অথচ এই শহরে প্রতিদিন যত টমটম চলে তার জন্য এই যানজট। তার জন্য কে দায়ী? অবশ্যই পৌর কর্তৃপক্ষ। তারা অনুমোদন না দিলে এগুলো চলাচল করতে পারত না।’
অকেজো ড্রেনেজ ব্যবস্থা
হবিগঞ্জ শহরে ৫৩.৬ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ড্রেনের অবস্থাই নাজুক। হবিগঞ্জ শহরের প্রধান দুটি সড়কের দুই পাশের ড্রেনগুলোর অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। কোথাও ড্রেন ভেঙে গেছে, কোথাও ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেনগুলো সংস্কার ও পরিষ্কার না করার কারণে পানিনিষ্কাশন হয় না। যে কারণে অল্প বৃষ্টিতেই শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডের ছোট ছোট ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। এ ছাড়া পৌরসভার চিড়িয়াকান্দি, কর্মকার পট্টি ও ইনাতাবাদ এলাকায় বড় বড় ড্রেনগুলোর অবস্থাও একই রকম। ড্রেনগুলোতে ময়লা পানি জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
অকেজো ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বৃষ্টি হলে পানিতে তলিয়ে যায় সার্কিট হাউস, জেলা প্রশাসকের বাসভবন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অফিসসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরও। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার বাসাবাড়িতেও পানি ঢুকে যায়।
স্থানীয়রা বলছেন, পৌর এলাকায় গত ১০ বছরে ৫০টির বেশি পুকুর, জলাশয় ও খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে বাসাবাড়িসহ নানা স্থাপনা। ফলে বৃষ্টির পানি যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে কর্মকার পট্টির বাসিন্দা বিপ্লব রায় সুজন বলেন, ‘অনেক বছর ধরে ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরে আছে। আমরা কাউন্সিলরসহ মেয়রকে বারবার বললেও তারা ড্রেনগুলো পরিষ্কারের কোনো ব্যবস্থাই নেননি।’
চিড়াকান্দি এলাকার বাসিন্দা এলাকার সৈয়দ ইব্রাহী বলেন, ‘মাত্র ১ ঘণ্টা সময় বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট ডুবে যায়। এ সময় ড্রেনের যত ময়লা আবর্জনা রাস্তায় উঠে পড়ে। কোনো কোনো বাসা বাড়িতেও ময়লা পানি ঢুকে যায়। আমরা কতটা কষ্টে আছি, সেটা কেবল আমরাই জানি।’
গলার কাঁটা ময়লার স্তূপ
শহরের যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। পাশাপাশি শহরের ময়লা ফেলা হচ্ছে খোয়াই নদীর পার ও বাইপাস সড়কের দুই পাশে। কয়েক বছর আগে জমি কিনেও নানা জটিলতায় থমকে আছে পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ।
ময়লার দুর্গন্ধে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বাইপাস সড়কটি। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে জেলা আধুনিক স্টেডিয়াম, জেলার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, আদালত, আনসার ভিডিবি ক্যাম্পসহ বিভিন্ন এলাকায়। এতে ক্ষোভের অন্ত নেই স্থানীয় বাসিন্দাদের।
বাইপাস সড়কের দুই পাশে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে কয়েকবার চিঠি দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনকে। সেই সঙ্গে পরিবেশবাদীদের আন্দোলন তো আছেই। তাতেও কোনো ফল মিলছে না।
এ ব্যাপারে জেলা বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘পৌরসভার বিভিন্ন স্থানের হাজার হাজার টন ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে শহরের বাইপাস সড়কে। রাস্তার দুই পাশের সরকারি খালও পৌরসভার ময়লা ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ময়লার দুর্গন্ধে নান সমস্যায় পড়তে হচ্ছে স্থানীয়দের। মাঝেমধ্যে এই ময়লা স্তূপে পৌরসভার কর্মীরা আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন। এতে গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে এলাকার পরিবেশ আরও বিষাক্ত করে তুলছে।’
লেখক তাহমিনা বেগম গিনি বলেন, ‘হবিগঞ্জ একটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা। অথচ এ পৌরসভার নাগরিকদের সমস্যার শেষ নেই। বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে প্রতিদিন লড়তে হয় পৌরসভার বাসিন্দাদের। অথচ সমস্যাগুলো সমাধানে পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো মাথা ব্যথাই দেখা যায় না।’
এ ব্যাপারে মেয়র মিজানুর রহমান মিজান বলেন, ‘উপনির্বাচনের পাস করার পর আমি মাত্র ১৮ মাস সময় পেয়েছি। কিন্তু এই সময়েও হবিগঞ্জ পৌরসভার ২১ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করেছি।
‘শহরের জলাবদ্ধতা অনেকটা কমিয়ে এনেছি। যানজট নিরসনে রাস্তা প্রশস্তে কাজ ও ড্রেন নির্মাণ চলমান রয়েছে। আশা করি এবার নির্বাচনে জয়ী হলে দ্রুত একটি আধুনিক পৌরসভা উপহার দিতে পারব।’