তৃতীয় দফার পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী সমর্থকদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নয়টি পৌরসভায় ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী।
কটিয়াদী
আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে এজেন্টদের মারধর, জোর করে সিল মারার অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন ঘোষণা দেন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী পৌরসভার বিএনপি মেয়র প্রার্থী মো. তোফাজ্জল হোসেন খান।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রগুলো থেকে আমার এজেন্টদের মারধর বের করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনের লোকজন আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। ন্যাক্কারজনক আচরণ করেছে।
‘এই প্রহসনের নির্বাচনের কোনো দরকার ছিল না। মাঠ খুব স্বচ্ছ হবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার একটি পাতানো নির্বাচন করছে। আমি এই নির্বাচনের তীব্র নিন্দা জানাই।’
নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শওকত উসমানের সমর্থকদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সালমা আনিকার।
এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন কিশোরগঞ্জ জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং আমার নিকট কেউ অভিযোগও করেনি।
কটিয়াদীতে বিএনপি মেয়র প্রার্থী তোফাজ্জল হোসেন খান। ছবি: নিউজবাংলা
সিংড়া
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সিল মারাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নাটোরের সিংড়া পৌরসভা নির্বাচনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী তায়জুল ইসলাম।
শনিবার দুপুর একটার দিকে সিংড়া পৌর বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘১২টা কেন্দ্রেই প্রকাশ্যে সিল মারছে আওয়ামী লীগ এজেন্টরা। এ ছাড়া বিএনপি এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসনকে বার বার বলার পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। ভোটের কোনো পরিবেশ নেই।’
তবে এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই বলে জানিয়েছেন জেলা নির্বাচন অফিসার মো. আছলাম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো অভিযোগ লিখিত বা মৌখিকভাবে আমার কাছে আসেনি। সকাল থেকে বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে কোনো ধরনের অনিয়মও দেখা যায়নি।’
নাটোরের সিংড়ায় ভোট বর্জনের ঘোষণা বিএনপি প্রার্থীর। ছবি: নিউজবাংলা
দর্শনা
ভোট কেন্দ্র থেকে নির্বাচনী এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেছেন চুয়াডাঙ্গার দর্শনা পৌরসভার বিএনপির প্রার্থী হাবিবুর রহমান।
শনিবার দুপুরে দর্শনা পুরাতন বাজারে নিজ নির্বাচনি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি। জানান, সকাল থেকে ভোট কেন্দ্রগুলো থেকে পোলিং এজেন্টসহ তার প্রধান নির্বাচনি এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে।
হাবিবুর বলেন, ‘যে সেন্টারে পোলিং এজেন্ট গিয়েছে, তাকেই গলাধাক্কা দিয়ে খুন জখমের হুমকি দেখিয়ে সরকার দলীয় লোকজন ভোট সেন্টার হতে বের করে দিয়েছে। সরকার দলীয় লোকজন ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করার পর সকল বুথ দখল করে নির্দ্বিধায় তাদের মনোনীত প্রার্থীর মার্কায় সিল মারছে।’
অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামীলীগ মনোনিত প্রার্থী মতিয়ার রহমান বলেন, কেউ কারও এজেন্ট বের করে দেয়নি। বিএনপির প্রার্থী মিথ্যা অভিযোগ করছেন।
এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা তারেক আহমেমদ জানান, ‘সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ চলছে। এজেন্ট বের করে দেয়ার বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি।’
কলারোয়া
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে সকালে ভোট বর্জন করেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী শরিফুজ্জামান তুহিন ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী নার্গিস সুলতানা।
পৌরসভাটিতে মেয়র প্রার্থীই ছিলেন তিন জন। দুই জন সরে দাঁড়ানোয় এই পৌরসভায় এখন ভোটে আছেন শুধু আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনিরুজ্জামান বুলবুল।
বিএনপি প্রার্থী শরিফুজ্জামান তুহিন বেলা ১১টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, পৌরসভার ৩ ও ৮ নম্বর কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে তাকে বাধা দেয়া হয়েছে। বহিরাগত যুবকরা তাকে লাঞ্ছিত করেছে।
দলটির বিদ্রোহী নার্গিস সুলতানাও প্রায় একই সময় সংবাদ সম্মেলন করে জানান, কোনো কেন্দ্রে তার এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। ভোটেও ব্যাপক কারচুপি হয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন জেলা নির্বাচন ও রিটার্নিং কর্মকর্তা নাজমুল কবীর। জানান, কোনো প্রার্থী বা এজেন্টের কাছ থেকে এ ধরনের অভিযোগ পাননি তিনি।
কলারোয়ায় বিএনপির মেয়র প্রার্থীর ভোট বর্জনের ঘোষণা। ছবি: নিউজবাংলা
নলছিটি
ঝালকাঠির নলছিটি পৌরসভা নির্বাচনে ভোট বর্জন করেছেন বিএনপি মেয়র প্রার্থী মজিবুর রহমান ও আওয়মী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী কেএম মাসুদ খান। দুজনেই অভিযোগ করে বলেছেন, ভোট কক্ষে মেয়র প্রার্থীর ব্যালট দেয়া হচ্ছে না।
বিএনপির মজিবুর রহমান জানান, সকাল থেকে কেন্দ্রগুলো তার এজেন্টদের ঢুকতেই দেয়নি ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা।
মাসুদ খান জানান, নির্বাচনের আগের দিন থেকে তার কর্মী সমর্থকদের জোর করে এলাকা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তার কোনো পোস্টার ব্যানার রাগাতে দেয়নি।
এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ওয়াহেদুজ্জামান বলেরন, ‘নলছিটি নির্বাচনের দুই প্রার্থীর ভোট বর্জনের কোনো লিখিত পত্র আমার হাতে এখনও আসেনি।’
সরিষাবাড়ি
জামালপুরের সরিষাবাড়ি পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ফয়জুল কবির তালুকদার শাহীন নির্বাচন বর্জন করেছেন।
সরিষাবাড়ি বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে দুপুর ২টার দিকে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি।
ফয়জুল কবির অভিযোগ করে বলেন, ‘পৌরসভার ১৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৭টি কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। ভোটাররা নিজের ভোট নিজে দিতে পারছেন না। ভোটারদের মেয়রের ব্যালট দেয়া হচ্ছে না, শুধু কাউন্সিলরদের ব্যালট দেয়া হচ্ছে।
‘এভাবে নির্বাচন হতে পারে না। তাই আমি সরিষাবাড়ির বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে স্থানীয় ও জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছি।’ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনির উদ্দিন মনির বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে। বিএনপির প্রার্থীর অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে এসব অভিযোগ করছেন তিনি।’
তৃতীয় ধাপে সরিষাবাড়ী পৌর নির্বাচনে ৯টি ওয়ার্ডের ১৮টি ভোটকেন্দ্রের ১১৭টি বুথে ভোট নেয়া হয়েছে। নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনজন।
শিবগঞ্জ
বগুড়া শিবগঞ্জ পৌরসভায় নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মতিয়ার রহমান মতিন।
শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ে শনিবার বেলা ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সকালে ধানের শীষের এজেন্টদের জোর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে আওয়ামাী লীগের লোকজন। ভোটাররা ভোট দেয়ার আগেই বেলা ১১টার মধ্যে ছয়টি কেন্দ্রের ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়। সবগুলো ভোট কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কর্মীরা সবুজ টুপি পড়ে কেন্দ্র দখল করে রয়েছেন।’
জানতে চাইলে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আনিছুর রহমান রহমান বলেন, ‘বিএনপির মেয়র প্রার্থী ভোট বর্জনের কথা শুনেছি। তবে কেন্দ্র দখলের কোনো ঘটনা ঘটেনি। প্রশাসন বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিচ্ছে। আর ব্যালেট পেপার শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন। সুষ্ঠু ভোট হচ্ছে।’
গৌরনদী
অনিয়ম ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের ভোট কক্ষে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছে গৌরনদী পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জহির সাজ্জাদ হান্নান।
শনিবার দুপুরে গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন নিজ বাস ভবনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি।
এ সময় তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রে ভোটারদের জোর করে নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছে কেন্দ্র থেকে কক্ষ পর্যন্ত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেও কোনো লাভ হয়নি। তাদের সামনে বসে অনিয়ম হলেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারিছুর রহমান হারিছ বলেন, ‘ভোট সুষ্ঠভাবেই হচ্ছে। কারচুপির অভিযোগ ভিত্তিহীন। ভোটাররা স্বতস্ফূর্তভাবে ভোট দিচ্ছে।’
ভালুকা
একই অভিযোগে ভালুকা পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাতেম খান ভোট বর্জন করেছেন।
দুপুর আড়াইটার দিকে ভালুকায় বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি বর্জনের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘নতুন করে নির্বাচন চাই। এই ভোট কোনোভাবেই মানি না।’
তৃতীয় দফায় ৬২ পৌরসভায় একযোগে ভোট নেয়া হয়। এই ধাপে ৬৪ পৌরসভায় তফসিল হলেও ভোট হচ্ছে না ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও কুমিল্লার লাকশাম পৌরসভায়।
ত্রিশালে এক মেয়র প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় সেখানে ভোট হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি। আর কুমিল্লার লাকসাম পৌরসভায় মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে সেখানে ভোট নেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না।
প্রথম দফায় পৌর নির্বাচনে ভোট পড়ে ৬৫ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৬২ শতাংশ। দুই দফায় ভোট হয়েছে মোট ৮৪ পৌরসভায়। এর মধ্যে বেশির ভাগ এলাকাতেই শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হলেও কিছু এলাকায় ভোট নিয়ে অভিযোগও উঠে।