সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় পৌরসভায় ২৫ বছরের দখল হারিয়েছেন বিএনপি নেতা তৌহিদুল ইসলাম। তাকে হারিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের জাকিয়া খাতুন।
বিএনপির ঘাঁটি বগুড়ার তিনটি পৌরসভার মধ্যে একটিতেই জয় পেয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী। একটিতে বাজেয়াপ্ত হয়েছে জামানত।
বিএনপির এই বিপর্যয়ের মধ্যে ব্যতিক্রম একজন। তিনি হলেন দিনাজপুরের নেতা সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। টানা তৃতীয়বারের মতো জয় পেয়েছেন তিনি।
কেবল জয় পেয়েছেন এমন না, তার ভোট সারা দেশে প্রতাপ দেখানো আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রায় দ্বিগুণ। এমনকি ২০১৫ সালের নির্বাচনের চেয়ে বেড়েছে ব্যবধান।
প্রথম দুই দফা নির্বাচনে দেশের ৮৩টি পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা জিতেছেন ছয়টিতে।
দিনাজপুর পৌরসভার এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন পাঁচ জন প্রার্থী। এরা হলেন নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রাশেদ পারভেজ, ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি প্রার্থী সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাপা প্রার্থী আহমেদ শফি রুবেল, কাস্তে প্রতীক নিয়ে সিপিবি সমর্থিত মেহেরুল ইসলাম ও হাতপাখা প্রতীকনিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সমর্থিত হাবিবুর রহমান রানা।
জাহাঙ্গীর আলম জিতেছেন ৪৪ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা আওয়ামী লীগের রাশেদ পারভেজ পান ২৪ হাজার ২৬২ ভোট। ব্যবধান ২০ হাজার ৬৭২।
২০১৫ সালে জাহাঙ্গীর হারিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুল ইসলামকে। তখন ব্যবধান ছিল প্রায় ১৫ হাজার।
পৌরসভাটি বিএনপির দখলে থাকলেও সংসদীয় আসন আবার গত তিনটি নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের দখলে।
মুক্তিযুদ্ধের পর কোনো পৌর নির্বাচনেই অবশ্য এখানে আওয়ামী লীগ হারেনি।
১৯৭৪ সালে প্রথম নির্বাচনে জেতেন মুসলিম লীগ নেতা হাফিজ উদ্দীন আহমদ। ১৯৭৭ জেতেন ন্যাপ সমর্থিত মহসীন আলী।
১৯৮৪ সালে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির নেতা আমিনুল হক।
১৯৮৯ সালে জেতেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সফিকুল হক ছুটু।
১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দুই বার জেতেন বিএনপি নেতা মহসীন আলী।
১৯৯৯ সালে ওয়ার্কার্স পার্টির সৈয়দ মোসাদ্দেক হোসেন লাবু নির্বাচিত হন।
২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পৌর চেয়ারম্যান ও পরে মেয়র হন স্বতন্ত্র প্রার্থী সফিকুল হক ছুটু।
এর মধ্যে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি হয়। দেশের বহু এলাকায় ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো জিতে আওয়ামী লীগ। যার একটি দিনাজপুর সদর।
২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের মুখে আওয়ামী লীগ জয় পায় দ্বিতীয়বারের মতো। ২০১৮ সালে জয় পায় আবার।
দিনাজপুর পৌরসভায় টানা তিনবার ভোটে জিতলেন বিএনপির সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম (ছবিতে মাঝে পাঞ্জাবি পড়া)
বিএনপির এই বিপর্যয়ের মধ্যেও ২০১১ সালের নির্বাচনে দিনাজপুর পৌরসভায় জেতেন জাহাঙ্গীর। দায়িত্ব থেকে তার কর্মকাণ্ডের পরীক্ষা তিনি দেন ২০১৫ সালে। আর ১০ বছরের দায়িত্ব পালনের পর আরও বড় পরীক্ষায় নামেন এবার।
রাজনীতিতে আপাতদৃষ্টিতে বেকায়দায় থাকা বিএনপি এবারের পৌর নির্বাচনে কেমন করে, তা নিয়ে দৃষ্টি ছিল দিনাজপুরে। তবে পরীক্ষায় তিনি পূর্ণ নম্বর নিয়ে পাস করেছেন।
জাহাঙ্গীরের ১০ বছরে এলাকায় উন্নয়ন নিয়ে আক্ষেপ আছে নগরবাসীর। তার পরেও তিনি বিপুল ভোটে কেন জিতলেন, তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেল শহরের রামনগর এলাকার আব্দুর রশিদের কাছ থেকে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমের ব্যবহার প্রশংসা করার মতো। আমি বহুবার দিনাজপুর পৌরসভায় গেছি, কিন্তু কখনই অনুমতি নিয়ে তার রুমে প্রবেশ করতে হয়নি।’
‘এই পৌরসভায় বহু মেয়র আসছে, কিন্তু জাহাঙ্গীর আলমের মত ভালো ব্যবহারের মেয়র আসেনি। তার কার্যালয়ে যে কেউ গেলে তাকে আগে বসতে বলেন এবং চা খাওয়ান’- বলেন আবদুর রশিদ।
তিনি বলেন, ‘দিনাজপুর শহরের রাস্তাঘাট খারাপ রয়েছে। আমাদের দুর্ভোগও হয়। কিন্তু সেই দুর্ভোগ তার কার্যালয়ে গেলে আমরা ভুলে যাই।’
শহরের গোলাপবাগ এলাকার ফজলুর রহমান বলেন, ‘এই নির্বাচনে বহু প্রার্থীর লোক আমার বাসায় এসে ভোট চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির প্রার্থী সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম নিজেই এসে আমার বাসায় ভোট চেয়েছেন। তাহলে তিনি জিতবেন না তো কে জিতবেন?’
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগ সমর্থক এক জন ঠিকাদার জানান, জাহাঙ্গীর আলম কাজ বণ্টনের ক্ষেত্রে দল মত দেখেন না। এর আগে যারা পৌর মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা শুধুমাত্র কয়েকজন ঠিকাদার দিয়ে কাজ করিয়েছেন। এ কারণে তিনি জনপ্রিয়।
বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। তার কারণে দিনাজপুরের মানুষ আমাকে আবারও মেয়রের চেয়ারে বসিয়েছে। আমার বিজয় শুধু বিএনপির বিজয় নয়, এই বিজয় জনগণের বিজয়।’
এলাকার রাস্তাঘাট ভাঙা থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। বাজেট আসলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দিনাজপুর শহরের চেহারা পাল্টে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি এই বার প্রথমে দিনাজপুর শহরের ভাঙা রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করব। ড্রেনেজ ব্যবস্থারও কিছু সমস্যা রয়েছে, অচিরিই যান সমাধান হবে।’