বিভিন্ন জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে উদার হাতে আসন দিয়ে এসেছে হবিগঞ্জ। তবে এবারের পৌরসভা নির্বাচন ব্যতিক্রম। তিনটি এলাকাতে নৌকা মার্কার প্রার্থীরা হেরে গেছেন, যার অন্তত দুটিতে এই মার্কার প্রার্থী হারতে পারেন, সেটা এর আগে ভাবাও যায়নি।
প্রথম ধাপের ভোটে শায়েস্তাগঞ্জে আর দ্বিতীয় ধাপে মাধবপুরে প্রথমবারের মতো হেরে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এর মধ্যে মাধবপুরে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে নৌকা মার্কার প্রার্থীর।
নবীগঞ্জে বিএনপি এর আগে জিতলেও তখন আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী ছিল। এবার সেখানে ক্ষমতাসীন দল প্রার্থী করেছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর জামাতাকে। তিনিও পেরে উঠেননি।
এই জেলায় আওয়ামী লীগের শক্তি কত বেশি, তা বোঝা যায় ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে। ওই বছরে সারা দেশে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের মধ্যেও এখানকার চারটি সংসদীয় আসনে বড় ব্যবধানেই জয় পান নৌকা মার্কার প্রার্থীরা। ২০০৮ সালে আরও বড় ব্যবধানে জয় পায় তারা। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যবধান বাড়ে আরও।
অবশ্য শায়েস্তাগঞ্জ ও মাধবপুর পৌরসভায় নৌকার ভরাডুবির পেছনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের দায়ী করছে দলটি। তবে নবীগঞ্জে হেরে হতভম্ভ দলের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে কারচুপির অভিযোগ।
ভোটের রাতে এই অভিযোগ করলেও সেটি সুনির্দিষ্ট ছিল না। জানানো হয়েছে, উপজেলা আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাবে।
দ্বিতীয় দফায় পৌরসভা নির্বাচনে সিলেটেও ভোটার উপস্থিতি ছিল লক্ষনীয়। ছবি: নিউজবাংলা
অবশ্য পরিসংখ্যান বলছে বিএনপি পাস করলেও তাদের ভোট তেমন একটা বাড়েনি।
মাধবপুরে গত পাঁচ বছরে ধানের শীষের ভোট বেড়েছে ৮৩টি। নবীগঞ্জে ভোট বেড়েছে ১২৮টি। শায়েস্তাগঞ্জে বেড়েছে ১৫১টি।
এই পাঁচ বছরে ভোটারের সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সেভাবে না জিতলেও দুটিতে বিএনপির এই জয়ের কারণ দলের একাট্টা আর আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী।
শায়েস্তাগঞ্জে যা হয়েছে
প্রথম ধাপে গত ২৮ ডিসেম্বর শায়েস্তাগঞ্জে বিএনপির ফরিদ আহমেদ অলি জিতে যান চার হাজার ৪১ ভোট পেয়ে।
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের মাসুদুজ্জামান পান তিন হাজার ১৪১ ভোট। দুই জনের ভোটের ব্যবধান ছিল ৯০০।
তবে এই নির্বাচনের ফলাফল উল্টো হতে পারত। কারণ, সেখানে আওয়ামী লীগের তিন জন বিদ্রোহী প্রার্থী সম্মিলিতভাবে ভোট পেয়েছেন বিজয়ী বিএনপি নেতার চেয়ে বেশি।
এক বিদ্রোহী প্রার্থী ছালেক মিয়া পেয়েছেন দুই হাজার ৫৯৯টি। অপর দুই বিদ্রোহীর মধ্যে ফজল উদ্দিন তালুকদার পেয়েছেন এক হাজার ৫১০ ভোট ও আবুল কাশেম এক হাজার ৪৩০ ভোট।
অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের তিন বিদ্রোহী প্রার্থী মিলে পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৫৩৯ ভোট। আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী নৌকা প্রতীকে ভোট পড়তে পারত আট হাজার ৬৮০টি, যা ধানের শীষের প্রায় দ্বিগুণ।
২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর এখানে পৌর নির্বাচনে বিএনপির আহমেদ অলি হারেন তিন হাজার ৮৯০ ভোট পেয়ে।
মাধবপুরে জামানত খোয়ানোর লজ্জা
মাধবপুরে নৌকা হারতে পারে, এই বিষয়টি স্থানীয়ভাবে এতদিন ধারণাও করা হয়নি। এবার পরাজয় এক গ্লানি, তার চেয়ে বড় লজ্জা হয়েছে দলের প্রার্থীর জামানত খোয়ানো।
প্রদত্ত ভোটের সাড়ে ১২ শতাংশ কোনো প্রার্থী না পেলে তিনি জামানত হিসেবে জমা দেয়া টাকা ফেরত পান না। টাকার অংকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ক্ষতি হয়ত তেমন না, তবে এটি সম্মানের প্রশ্ন ক্ষমতাসীন দলের জন্য।
শনিবারের ভোটে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে হাবিবুর রহমান মানিক জিতেছেন পাঁচ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে।
মাধবপুর পৌরসভায় জয়ের বেসরকারি ফল তুলে দেয়া হচ্ছে ধানের শীষের প্রার্থী হাবিবুর রহমান মানিকের হাতে। ছবি: নিউজবাংলা
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শ্রীধাম দাশগুপ্ত নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৫৬৮টি। এর আগে এই দৃশ্য কখনও দেখেনি মাধবপুর।
দলের এই দশা করেছেন নৌকা না পেয়ে বিদ্রোহ করা দুই নেতা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দুইবারের সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ মো. মুসলিম জগ প্রতীক নিয়ে আর গত নির্বাচনে নৌকা নিয়ে নির্বাচিত হিরেন্দ্র লাল সাহার ছোট ভাই পংকজ কুমার সাহা ভোট করেন নারকেল গাছ প্রতীক নিয়ে।
তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা সেভাবে প্রচারে না নামলেও বোঝা যাচ্ছিল তারা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবেন নৌকার প্রার্থীর জন্য।
হয়েছেও তাই। পঙ্কজ ভোট পেয়েছেন চার হাজার ১৫৬টি, যা বিএনপি প্রার্থীর চেয়ে ৮৭৫ ভোট কম।
শাহ মো. মুসলিম তৃতীয় হয়েছেন তিন হাজার ৪৯ ভোট পেয়ে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা বলছেন, এই তিন প্রার্থীর ভোট এক বাক্সে পড়লে তা বিজয়ী বিএনপির প্রার্থীর দেড় গুণেরও বেশি ভোট হতো। আওয়ামী লীগ ভোট পেতে পারত সাত হাজার ৭৭৩টি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, প্রার্থী নির্বাচনে ভুল ছিল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের।
মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এরশাদ আলী বলেন, ‘নৌকা পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী শ্রীধাম দাশগুপ্ত দলের কোনো নেতাকর্মীরা সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। উল্টো নির্বাচনের একদিন আগে ককটেল বিষ্ফোরণের অভিযোগ এনে দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। যে কারণে দলীয় নেতাকর্মী তো বটেই, সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।’
২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনেও এখানে লড়াই করেন বিএনপির মানিক। তখন তিনি ভোট পান চার হাজার ৯৪৮ ভোট। তার ভোট বেড়েছে ১.৬৭ শতাংশ। তবে ওই নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে তার চেয়ে বেশি।
নৌকায় ভোট বাড়ল ১৭১৪, ধানের শীষে ১২৮
২০১৫ সালের নির্বাচনে নবীগঞ্জ পৌরসভায় পাঁচ হাজার ৬২১ ভোট পেয়ে জিতে যান ধানের শীষের প্রার্থী ছাবির আহমেদ চৌধুরির। এবারও জয় পাওয়া প্রার্থীর ভোট পড়েছে পাঁচ হাজার ৭৪৯। অর্থাৎ পাঁচ বছরে বেড়েছে ১২৮ ভোট।
এর চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ ভোট বাড়িয়ে পৌরসভার দখল নিতে পারল না আওয়ামী লীগ।
নবীগঞ্জ পৌরসভার একটি কেন্দ্রের ভোটারদের সারি। ছবি: নিউজবাংলা
গত নির্বাচনে নবীগঞ্জে নৌকার প্রার্থী পেয়েছিলেন তিন হাজার ৭৭৩ ভোট। এবার প্রার্থী বদল করে দলটি ভোট পেয়েছে পাঁচ হাজার ৪৮৫টি। অর্থ্যাৎ পাঁচ বছরে নৌকার বেড়েছে এক হাজার ৭১২ ভোট।
দলীয় কোন্দলসহ নানা কারণে পাঁচ বছর আগে দখল হারিয়ে ফেলা এই পৌরসভাটি নিজের করে নিতে এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের জামাতা গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরীকে।
দলীয় বিভক্তি ভেঙে একাট্টা হয়ে কাজও করেছে দলটি। প্রচারে এসেছেন একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন থেকে শুরু করে আলোচিত আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনও এখানে এক সপ্তাহ প্রচার চালিয়েছেন রাতদিন। সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু এরপরও শেষ হাসি হাসা হয়নি দলের। ২৬৪ ভোটের ব্যবধানে হেরেছে তারা।
হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুশফিক হোসেন চৌধুরী জেলার তিন পৌরসভাতে পরাজয়ের পেছনে দলের ঐক্য না থাকাকে দায়ী করেছেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে অনেক ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতাকর্মী আছেন। অনেক সময় এই ত্যাগী নেতাকর্মীরা মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহ করে বসেন। যে কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ভরাডুবি হচ্ছে।’