কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারের লাইন, ছয়টি পৌরসভায় ভোট বর্জন, পাঁচটিতে সংঘর্ষ ও একটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিতের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় দফায় ৬০ পৌরসভায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে।
তবে সিংহভাগ এলাকাতেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হওয়ার খবর জানিয়েছেন নিউজবাংলার প্রতিনিধিরা। এমনকি দুটি পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা ভোটের পরিবেশের প্রশংসা করেছেন, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন নির্বাচনে আর দেখা যায়নি।
শনিবার সকাল আটটায় ভোট শুরুর আগে থেকেই শীত উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে আসতে থাকেন ভোটাররা। কেন্দ্রে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিকাল চারটায় ভোট শেষ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভোট কেন্দ্রগুলোর চিত্র ছিল মোটামুটি একই রকম।
ভোটের পরিবেশ নিয়ে প্রকাশ্যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভা বিএনপির প্রার্থী কামাল উদ্দিন চৌধুরী ও কুষ্টিয়ার সদর পৌরসভার বিএনপির প্রার্থী বশিরুল আলম চাঁদ।
তবে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিএনপির প্রার্থীরা ভোট বর্জন করেছেন রাজশাহীর ভবানীগঞ্জ, বাগেরহাটের মোংলা, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর, পাবনার ঈশ্বরদী, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মেহেরপুরের গাংনীতে।
মৌলভীবাজারের একটি ভোট কেন্দ্রসংঘর্ষ ও প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে কুমিল্লার চান্দিনা, ফেনীর দাগনভূঞা, পাবনার ঈশ্বরদী, কুষ্টিয়া সদর ও ঝিনাইদহের শৈলকুপায়।
কিশোরগঞ্জ সদরের ওয়ালী নেওয়াজ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে এই কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করেছেন নির্বাচন কর্মকর্তা।
নির্বাচন কমিশন বলেছে উৎসাহের ভোট হয়েছে। তাদের ধারণা, প্রথম ধাপের মতোই এবারও ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়বে।
গত জাতীয় নির্বাচনের পর বিভিন্ন ভোটের খরা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে ব্যাপক সমালোচনায় পড়তে হয়। তবে প্রথম ধাপের পৌর নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতির কাছে ৪২ নাগরিকের চিঠির পর অনেকটাই পাল্টে গেছে পরিস্থিতি।
২৮ ডিসেম্বরের ভোটে ২৪টি পৌরসভাতেই ব্যাপক ভোটার উপস্থিতি, বেশিরভাগ এলাকাতেই নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা ছিল।
ওই অভিজ্ঞতার পর দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে প্রার্থীরা আরও বেশি সক্রিয় ছিলেন নির্বাচনি এলাকায়। সিংহভাগ এলাকাতেই ভোট নিয়ে কোনো অভিযোগ দেখা যায়নি।
যেসব এলাকায় সহিংসতা ছিল না, সেখানে ভোটার উপস্থিতিও ছিল বেশি।
সুনামগঞ্জের ছাতক পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দিয়ে আফিয়া খাতুন নামে এক জন বলেন, ‘গত ইলেকশনো (জাতীয় সংসদ নির্বাচনে) বুট দিতে ফারছি না। গ্যাঞ্জাম অইত ফারে অউ ডরে ফুয়াইনতে আইতে দিছুইন না। ইবার পরিবেশ মুটামুটি ঠান্ডা। এর লাগি নাতনিরে লই বুট দিতে আইছি। খাউন্সিলর ফ্রার্তিয়ে (প্রার্থী) রিকশাও ফাঠাইছলা।’
৫০টির মতো পৌরসভায় ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ। এর মধ্যে কয়েকটিতে অবশ্য বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগ ছিল। তবে সিংহভাগেই অভিযোগ ছাড়াই হয়েছে ভোট।
নির্বাচন কমিশনের উপসচিব আতিয়ার রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের একটি কেন্দ্র ছাড়া আর কোথাও ভোট বন্ধের খবর আসেনি। ভোটার উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক। মোটামোটি তৃণমূলের এ ভোটকে উৎসবই বলা যায়।’
নোয়াখালীর বসুরহাটে একটি কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইননির্বাচন কমিশনে ভিন্নমত দিয়ে গত কয়েক বছর ধরে আলোচনায় আসা কমিশনার মাহবুব তালুকদারও এবার আশার কথা বলেছেন।
সাভারের কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করে এসে তিনি বলেছেন, ‘আশার আলোর কথা এই মুহূর্তে বলতে পারব না। আশা করি নির্বাচন নির্বিঘ্ন হবে, শান্তিপূর্ণ হবে এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় যে সহিংসতা হয়েছে সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।…সহিংসতা আমাদের খুব কষ্ট দেয়। মানুষের জীবনের থেকেও কি নির্বাচন মূল্যবান?’
এবারের ভোটের প্রচার চালাকালে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হওয়া ঝিনাইদহের শৈলকুপায় দুই একটি ঘটনা ঘটলেও সার্বিকভাবে শান্তিপূর্ণই ছিল।
অবশ্য বিএনপির কেন্দ্র থেকে ভোটকে কারচুপি বলা হয়েছে আগের মতোই। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আমরা যতটুকু খবর পেয়েছি, ক্ষমতাসীনরা আমাদের এজেন্টদের সেন্টারে যেতে দেয়নি, অনেক জায়গায় বের করে দিয়েছে। এমনকি বিএনপি সমর্থকদের কেন্দ্রের কাছেও যেতে দিচ্ছে না।
‘তারা গায়ের জোরে ভোটকেন্দ্র দখল করেছে। জাতীয় নির্বাচনের মতো পৌরসভা নির্বাচনেও তারা একই ধরনের কাজ করছে। তারা বলে, এমপি যদি আমরা এভাবে করতে পারি তাহলে মেয়র এভাবে হবে না কেন?’
অবশ্য স্থানীয় পর্যায় থেকে বিএনপির ভিন্ন মূল্যায়নও পাওয়া গেছে।
তুমুল আলোচিত বসুরহাটের নির্বাচনের প্রশংসা করেছেন বিএনপির প্রার্থী কামাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি যেই দুই চারটা কেন্দ্রে গেসি সেখানে সুন্দর পরিবেশে নির্বাচন হচ্ছে। কোনো সমস্যা নাই। জয়-বিজয় আল্লাহর হাতে।… ‘অবশ্যই আমি ফলাফল মেনে নেব। এই সুন্দর নির্বাচনের ফলাফল না মানলে আমি কেন রাজনীতি করি?’
একই রকম মূল্যায়ন করেছেন কুষ্টিয়া পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী বশিরুল আলম চাঁদ। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন পর সুষ্ঠু পরিবেশে নিজের ভোট দিতে পারলাম।… ব্যালট সকালে কেন্দ্রে আসায় ভোটারদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে।’
গত জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে আগের রাতে ভোট নেয়ার যে অভিযোগ বিরোধী পক্ষ করে আসছিল, তা যেন এবার না হয়, সে জন্য সতর্ক ছিল নির্বাচন কমিশন। যেসব এলাকায় ব্যালটে ভোট নেয়া হয়েছে, সেগুলোতে ব্যালট পেপার পাঠানো হয় ভোরে।
শনিবার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা ৬০টি পৌরসভায় ভোট নেয়া হয়।
এসব পৌরসভার মধ্যে মেয়র পদে ভোট হয়েছে ৫৬টিতে। বাকি চারটিতে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন একক প্রার্থী হিসেবে। পৌরসভাগুলো হলো সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, পাবনার ভাঙ্গুরা, পিরোজপুর সদর এবং নারায়ণগঞ্জের তারাব।
তবে নীলফামারীর সৈয়দপুরে এক মেয়র প্রার্থীর মৃত্যুতে সেখানে স্থগিত হয়েছে নির্বাচন।
দ্বিতীয় ধাপে ২৮টিতে ইভিএম ও ৩২টিতে ভোট হয়েছে সনাতন পদ্ধতিতে ব্যালটে।
দ্বিতীয় দফার এ নির্বাচনের সব ধরনের প্রচার বন্ধ হয় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই। এর আগে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে প্রচারে শান্তি থাকলেও শেষ বেলায় নারায়ণগঞ্জের তারাব, ঝিনাইদহের শৈলকুপা ও বরগুনা পৌরসভায় কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ২২১ জন, সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী দুই হাজার ৩২০ জন, সংরক্ষিত নারী আসনে লড়েন ৭৪৫ জন।