পোশাক কারখানায় আসা ক্রেতাদের ব্যবহারের কথা বলে মাসিক চুক্তিতে ভাড়া নিতেন গাড়ি। পরে মালিকের অজান্তে ওই গাড়ির কাগজ জাল করে বিক্রি করতেন তিনি। লকডাউনে বিআরটিএ কার্যালয় বন্ধ থাকায় গাড়ির কাগজ যাচাই করতে পারতেন না ক্রেতারা। এ কারণে এ সময়কে টার্গেট করে প্রতারণায় নামেন তিনি। গত চার মাসে কয়েক কোটি টাকার মালিকও হয়েছেন।
এমন অভিনব প্রতারণার অভিযোগে আব্দুল কাইয়ুম ছোটন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। একই সঙ্গে বিক্রি হওয়া সাতটি গাড়িও উদ্ধার করেছে সংস্থাটি।
সোমবার দুপুরে সিআইডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর।
তিনি বলেন, ‘আব্দুল কাইয়ুম ছোটনের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়ায়। তিনি কক্সবাজারে প্রত্যাশা নামে একটি এনজিওতে কাজ করতেন। প্রতারণার জন্য সেখান থেকে চাকরিচ্যুত হন। এরপর ঢাকায় এসে গাজীপুর বোটবাজার এলাকায় ‘একে ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাক কারখানা চালু করেন।
বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর জানান, ছোটনের ওই পোশাক কারখানার মেশিনগুলো ভাড়া নেয়া ছিল। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিনি প্রায় ২০০ শ্রমিক নিয়ে পোশাক কারখানাটি চালু করেন। ওই কারখানায় টিশার্ট, পোলো শার্ট, প্যান্ট ও জ্যাকেট তৈরি হতো।
তিনি বলেন, ‘তিন-চার মাস পরে ছোটন ফেসবুকের বিভিন্ন রেন্ট-এ-কারের পেজে গাড়ি ভাড়া নেবেন বলে বিজ্ঞাপন দিতে থাকেন। এর মধ্যে রেন্ট-এ-কার বিডি, রেন্ট-এ-কার গাজীপুর ও রেন্ট-এ-কার ঢাকা পেজে বেশি বিজ্ঞাপন দেন। পোশাক কারখানার ক্রেতাদের ব্যবহারের জন্য ভাড়া করা এসব গাড়ি নেয়া হবে বলে বিজ্ঞাপনে জানান ছোটন।
‘বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহী গাড়ির মালিকরা যোগাযোগ করলে তিনি তাদের গাজীপুরের পোশাক কারখানায় যেতে বলেন। সেখানে মালিকরা গেলে তাদের সঙ্গে ভাড়া ঠিক করা হয়। বিলাসবহুল দামি গাড়ি মাসিক ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় ভাড়া নেন ছোটন। তবে গাড়ির মালিকদের তিনি শর্ত দেন, ক্রেতাদের নিয়ে যেহেতু রাতে চলাচল করতে হবে, তাই গাড়িটি ছোটনের জিম্মাতেই থাকবে এবং চালকের ব্যবস্থাও ছোটন নিজেই করবেন। গাড়ির মালিকের চালক ছোটন নেবেন না।’
পুলিশ কর্মকর্তা মুক্তা ধর বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি ধরলে আসল কাগজপত্র দেখাতে হবে এমন অজুহাতে গাড়ির সব আসল কাগজপত্র রেখে দেন তিনি। ছোটনের কথায় রাজি হয়ে যেসব মালিক গাড়ি মাসিক ভাড়ায় দেন, তাদের প্রথম মাসে ঠিকমতো ভাড়া দিতেন ছোটন। তবে পরের মাস থেকে ভাড়া নিয়ে টালবাহানা শুরু করতেন তিনি। এরপর মালিকানা বদলির জাল স্ট্যাম্প তৈরি করে ওই গাড়িগুলো মালিককে না জানিয়েই বিক্রি করে দিতেন।
প্রতারণা করে বিক্রি করে দেয়া কয়েকটি গাড়িও উদ্ধার করেছে সিআইডি। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে আমরা জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছি, তিনি ২০ থেকে ৩০টি গাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। গাড়ির কন্ডিশন দেখে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। সেগুলো পরে নকল কাগজপত্র তৈরি করে কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতিতে বিআরটিএ অফিস বন্ধ থাকায় ক্রেতারা এসব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে পারেননি।’
মুক্তা ধর বলেন, ‘আলমগীর নামে এক সহযোগী রয়েছে ছোটনের। তিনি এসব গাড়ি বিক্রি করতে সহযোগিতা করতেন। এ ছাড়া তুরাগ থানার নাজমুল অটোপার্টস সেন্টারও গাড়ি বিক্রি করে দিত। ১৯ লাখের গাড়ি ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকা বিক্রি করা হতো। এই প্রতারণা তারা মার্চ ও এপ্রিল মাসে বেশি করেন।
‘গাড়ি বিক্রির সময় ছোটন ক্রেতাদের বলতেন, পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে, তাই গাড়ি বিক্রি করে দেবেন। এভাবে চার মাসে তিনি ২৫ থেকে ৩০টি গাড়ি বিক্রি করেছেন। পরে গাড়ি বিক্রির ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান তিনি।’
তিনি জানান, এসব ঘটনায় গাজীপুর ও ঢাকায় মামলা করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা। সিআইডি তদন্তে নেমে চক্রের পুরো সিন্ডিকেটকে গ্রেপ্তার করেছে।
মুক্তা ধর জানান, ছোটনের সহযোগী আব্দুল হাই, আলমগীর, নাজমুল ও সানীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া চোরাই গাড়ি যারা কিনেছেন এদের মধ্যে রানা ও শামীম নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘অনেক ক্রেতা যখন জানতে পেরেছেন তারা চোরাই গাড়ি কিনেছেন, তখন তারা নিজেরাই থানায় জিডি করে এর মালিককে গাড়ি ফেরত দিয়েছেন।’