টানা শাটডাউনে প্রভাব পড়েছে জীবন-জীবিকায়। চলমান পরিস্থিতিতে দোকানপাট বন্ধ থাকায় বড় বিপদে পড়েছেন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের কম্পিউটার এক্সেসরিজের কারিগরেরা। অনন্যোপায় হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে লুকোচুরি করে মার্কেটের সামনে সিঁড়ি ও ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করছেন তারা।
কয়েক দিন ধরে রাজধানীর বৃহৎ কম্পিউটার এক্সেসরিজের মার্কেট মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে দেখা যাচ্ছে এমন চিত্র।
শাটডাউনে অন্য সব মার্কেটের মতো বন্ধ এই মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারও। তবে সকাল থেকে কিছু যুবক ও মধ্যবয়সী বসে থাকেন মার্কেটের সামনের সিঁড়িতে বা ফুটপাতে।
হঠাৎ দেখায় মনে হবে তারা ক্লান্ত তাই হয়ত বিশ্রাম নেয়ার জন্য এভাবে বসে আছেন। একটু ভালো করে খেয়াল করলেই যে বিষয়টি নজরে আসে তা হলো প্রত্যেকের পিঠে ঝুলছে স্কুলব্যাগ।
না, তারা কোনো শিক্ষার্থী নন। আর শিক্ষার্থী হলেই বা কী, শাটডাউনের কারণে তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ। তারা কারা জানতে এগিয়ে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সংবাদমাধ্যমকর্মী কাউকে দেখলেই উঠে চলে যান যে যার মতো। কেউ কোনো কথা না বলে পাশের গলিতে ঢুকে এদিক-ওদিক ছোটেন।
মাল্টিপ্ল্যানের বিপরীতে আরেকটি গলিতে তাকালে দেখা যায় সেখানে অনেকটা জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন স্কুলব্যাগধারী প্রায় ২০-২৫ জন। ওই গলিতেও আরেকটি কম্পিউটার এক্সেসরিজ মার্কেট রয়েছে। লোকগুলো নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছেন।
জটলা থেকে আলাদা দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবকের কাছে গিয়ে কৌশলে কথা বলার চেষ্টা করে নিউজবাংলার এই প্রতিবেদক। নিজের ব্যবহার করা ল্যাপটপটির ডিসপ্লে নষ্ট হয়ে গেছে, শাটডাউনের কারণে কোথাও সারাতে পারছেন না- কোনো ব্যবস্থা করা যাবে কি না জানতে চাইলে সাড়া দেন ওই যুবক।
সমস্যার কথা বিস্তারিত জানতে চান ওই যুবক। শোনার পর বলেন, ‘আপনার ল্যাপটপের ডিসপ্লে পরিবর্তন করতে হবে। রিপেয়ারিং করে হলে সেটা আমি এখনই করে দিতে পারতাম। কিন্তু পার্টসের কাজ করে অন্যরা। একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি সেখানে যোগাযোগ করুন।’
ওই যুবক বলেন, ‘ওই নম্বরে ফোন দিয়ে আপনার ল্যাপটপের মডেল নম্বর বলেন, উনি বলে দেবেন কত টাকা লাগবে। দামাদামি হয়ে গেলে উনিই বলে দেবেন কোথায় কীভাবে কাজটি করে দেবেন।’
পুলিশ বা সাংবাদিক দেখলেই এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেন কম্পিউটার এক্সেসরিজের ভ্রাম্যমাণ কারিগরেরা। ছবি: নিউজবাংলা
ওই নম্বরে ফোন করার পর অপর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি জানান তার মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে দোকান রয়েছে। ল্যাপটপটি মাল্টিপ্ল্যানের সামনে নিয়ে আসলে এবং কিছু সময় অপেক্ষা করলে তিনি সেটি সারিয়ে দেবেন। ব্যবস্থা আছে হোম সার্ভিসেরও। সে ক্ষেত্রে দূরত্ব অনুযায়ী ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বেশি খরচ হয়।
এমন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাটডাউনের কারণে টিকে থাকার জন্য তারা এই কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের জীবিকা চালাচ্ছেন। মার্কেট যেহেতু খোলা মানা, তাই তারা এভাবেই মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কাস্টমারের অপেক্ষা করেন।
কাস্টমার এলে তাকে নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে দারোয়ানকে ম্যানেজ করে মার্কেটে প্রবেশ করে দোকান খুলে তার ল্যাপটপ বা কম্পিউটার সারিয়ে দেন। ছোটখাটো মেরামতের কাজ হলে তারা রাস্তায় পাশের গলিতে বসেও সেগুলো সেরে দেন। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বহন করার জন্যই তারা পিঠে রাখেন স্কুলব্যাগ।
হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজা, নাহার প্লাজা আর ইস্টার্ন প্লাজার সামনেও একই কায়দায় যুবকদের অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তারা করেন মোবাইল সার্ভিসিং। তবে পুলিশ বা সাংবাদিক দেখলেই উধাও হয়ে যান তারা।
মোতালেব প্লাজার সামনেও একই কৌশলে মোবাইল এক্সেসরিজের সেবা দেন কারিগরেরা। ছবি: নিউজবাংলা
এসব কারিগরের কেউই শুরুতে ভয়ে কথা বলতে চান না। এমনকি বলেনও না তারা এখানে কী করছেন। এ ক্ষেত্রে সেবাদাতা এবং সেবা গ্রহণকারী উভয়ই কৌশল অবলম্বন করেন।
কৌশলেই মোবাইলের সমস্যা নিয়ে কথা হয় মোতালেব প্লাজার সামনে অপেক্ষমাণ এক যুবকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, মোবাইল দিয়ে দিলে মার্কেটের ভেতরে নিজেদের দোকান থেকে সারিয়ে আনবেন। চাইলে নেয়া যাবে হোম সার্ভিসও।
কম্পিউটার ও মোবাইল এক্সেসরিজের দোকানের এই প্রতিনিধিরা জানান, শাটডাউনের কারণে পরিবার নিয়ে টিকে থাকতেই তাদের এই কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। ঘরে বসে থাকলে পরিবারের খরচ, বাসা ভাড়া মেটাতে সংকটে পড়তে হবে। তাই বাধ্য হয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়েই সার্ভিসিংয়ের কাজ চালাচ্ছেন তারা।
এভাবে অপেক্ষা করতে দেখে অনেক সময় পুলিশও তাদের জেরা করে। তাই সব সময় মার্কেটের সামনে এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করে দিন পার করেন তারা।