ঈদুল আজহার আর মাত্র তিন দিন বাকি। প্রতিবছর এ সময় জমজমাট হয়ে ওঠে কামারশালার দা-ছুরির বেচাবিক্রি। কামারদের কাজের টুংটাং শব্দে পাড়া থাকে সরগরম।
তবে এবার পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীত। নেই সেই বেচাবিক্রি, কমে গেছে টুংটাং শব্দও।
পুরান ঢাকার এক কামারশালার মালিক আসলাম শেখ বলছিলেন, ‘এমনিতেই আমরা সারা বছর অর্থকষ্টে থাকি। দুই ঈদই আমাদের ভরসা। বিশেষ করে কোরবানির ঈদ। এ সময় দুইটা টাকার মুখ দেখি আমরা।’
‘কিন্তু এবারের টানা শাটডাউন আর লকডাউনে আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেচাবিক্রি অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে।’
একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন পাবনার নগরবাড়ি ঘাট থেকে আসা আসলাম। এ পেশায় কাজ করছেন প্রায় ২৫ বছর।
শনিবার পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার আশপাশের এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতা নেই। অলস সময় পার করছেন কামাররা।
নবাবগঞ্জ ক্লাববাড়ি রোডের একটি কামারশালার প্রধান কারিগর পদ্মা মহন্ত কাজ শুরু করেন মাত্র আট বছর বয়সে। মা-বাবা পারিবারিক কাজ ছিল এটা। তাই বয়স হওয়ার আগেই কাজে লেগে যান। তার বয়স এখন ৩৫ বছর।
দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, এর আগে কখনো এমনটা হয়নি। প্রতি ঈদে নতুন কাজের পাশাপাশি পুরোনো কাজ করতে রাতদিন ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। তিনি তো কাজ করেনই। বাড়তি কারিগরও লাগে কয়েকজন।
কিন্তু এ বছর তার ৪-৫ জন কারিগর নেই। লকডাউনের কারণে বাড়ি চলে গেছেন। আর ফেরেননি। পদ্মা একাই কাজ করছেন। তা-ও দিনের একটা বড় সময় ফাঁকা বসে থাকতে হয় তাকে। কারণ, কাজ নেই।
আসলাম ও পদ্মা মহন্ত লোহাকে আগুনে পুড়িয়ে নরম করে পিটিয়ে বিভিন্ন প্রকার দা, বঁটি, চাপাটি, ছোরা, চাকু, চায়নিজ নকশার কুড়াল, কাটারিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করেন।
এগুলো তৈরির পর পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়।
এসব জিনিসের বেশির ভাগেরই ওজনের ওপর দাম নির্ভর করে।
যেমন প্রতি কেজি লোহার স্প্রিংয়ের তৈরি বঁটির দাম ৬০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
একটি চাপাটির দামও প্রায় একই। এর ওজন ৪০০ গ্রাম থেকে শুরু করে এক বা শোয়া কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়াও একটি মাছ-মাংস কাটা বঁটির ওজন দুই কেজি পর্যন্ত করা হয়।
আরও আছে গরু-খাসি জবাই করার ছোরা। যার খুচরা বাজারমূল্য ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঈদুল আজহায় এগুলোই বিক্রি হয় বেশি।
কাঁচামাল আসে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা থেকে। পুরোনো রেলপাটি, রেলের স্প্রিং, বাস, ট্রাক, পিকআপ বা প্রাইভেট কারের স্প্রিং। এগুলো দিয়ে তৈরি করলে এসব দা, বঁটি, ছোরা বা চাকু ধার নষ্ট হয় না বলে জানান তারা।
তাই এগুলোর তৈরি যেকোনো জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি।
এসব মাল কেজিপ্রতি ৬০ টাকা দরে জিঞ্জিরার বাজার থেকে খরিদ করা হয়।
এরপর তা দিয়ে এসব মালামাল তৈরির পর প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়ে থাকে।
লালবাগের নবাবগঞ্জ বাজার ঘিরে ৬টি কামারশালা রয়েছে। এ ছাড়াও দুটি রয়েছে লালবাগ কেল্লার মোড়। নাজিরাবাজার, সিদ্দিক বাজার রয়েছে কয়েকটি কারখানা।
যেখানে নিয়মিত দা, বঁটি ও চাপাটিসহ দেশীয় এসব জিনিসপত্র তৈরি করা হয়ে থাকে।
এক শ্রণির বড় ব্যবসায়ী টাকা বিনিয়োগ করে কেরানীগঞ্জ থেকে তৈরি মাল পাইকারি কিনে আবার তা পাইকারি দামে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকেন।
এখানে হাজী মোহাম্মদ আলী মার্কেটের পাইকারি দোকান মেসার্স হারুন অ্যান্ড ব্রাদার্সের ম্যানেজার মো. আলী হোসেন জানান, ‘আমরা জিঞ্জিরা থেকে পাইকারি মাল কিনে আবার পাইকারি বিক্রি করি। তবে এ বছর বেচাবিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।’
‘আবারও সবকিছু আগামী ২৩ তারিখের পর থেকে বন্ধ হবে। আমাদের কোটি টাকার মালামাল পড়ে থাকবে।’
ধোলাইখাল ওয়ারী স্ট্রিটের এক কামারশালার মালিক সত্তরোর্ধ্ব মো. আব্দুস ছালামের দিনও ভালো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের গতর খাটিয়ে যে ইনকাম হয় তা-ও এবার কমে গেছে বাবা দিন খুব খারাপ যাচ্ছে।’