কোরবানির ঈদ সামনে রেখে টানা ১৪ দিন পর ‘শাটডাউন’ নামক কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও ঈদের এক দিন পরই আবার শাটডাউনের ঘোষণা রয়েছে সরকারের। এতে ভয়ে আছেন ঈদের ঘরমুখীরা, বাড়িতে গিয়ে আটকা পড়তে হয় কি না!
ঘরমুখীদের এই ভয় প্রভাব ফেলেছে ঈদযাত্রায়। শাটডাউন শিথিলের প্রথম দিন রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে খুব বেশি যাত্রীর চাপ দেখা যায়নি। কোনো টিকিট সংকট নেই। আশানুরূপ যাত্রী না পাওয়ায় দূরপাল্লার বাসগুলো ছাড়ছে বেশ বিলম্ব করে।
বাসসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাড়ি গেলে লকডাউনের আগেই ফিরে আসতে পারবেন কি না সেটা নিশ্চিত না করে ঢাকা ছাড়তে চাচ্ছেন না যাত্রীরা। আর যারা যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ঢাকা ছাড়ছেন একেবারেই।
করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের ভয়াবহ সংক্রমণে শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকায় গত ১ জুলাই সারা দেশে শুরু হয় কঠোর লকডাউন, যা পরিচিতি পেয়েছে শাটডাউন নামে।
তবে ঈদ ও পশুর ব্যবসার কথা ভেবে শাটডাউন আট দিনের জন্য শিথিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শিথিল লকডাউনের প্রথম দিন ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন সকাল থেকে রাজধানীর মহাসড়কগুলোতে গাড়ি ও যাত্রীর চাপ দেখা গেলেও দূরপাল্লার যানবাহনে খুব একটা চাপ দেখা যায়নি।
গত মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত সকল বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে। তবে ঈদের ছুটির পর ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত আগের কঠোর বিধিনিষেধগুলো আবারও কার্যকর হবে।
লকডাউন শিথিল হওয়ার পরপরই বুধবার মধ্যরাত থেকে রাজধানী থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যেতে দেখা যায়। শুরু হয় লঞ্চ চলাচলও। ট্রেনযাত্রা শুরু হয় সকাল থেকে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজ সকাল থেকে বাস ছাড়ার কথা থাকলেও কাল রাত থেকেই বেশ কিছু গাড়ি ঢাকা ছেড়েছে। তবে আজ ভোর থেকে অভার অল সব গাড়ি ছাড়া শুরু করছে।’
সকাল থেকে রাজধানীর গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, তুলনামূলক কম ভিড় বাসগুলোর টিকিট কাউন্টারের সামনে। যে গাড়িগুলো ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে সেগুলোতেই যাত্রী কম।
যারা যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগের চিন্তা আবার ঈদের পরদিন ফিরবেন কীভাবে। ঢাকাতে থেকেই ভাবছেন ফেরার উপায় নিয়ে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালে দেখা যায় যাত্রীদের খুব বেশি চাপ নেই। বাসের হেল্পাররা ডেকে ডেকে যাত্রী আনছেন।
ইকবাল মাহমুদ। ঢাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত তিনি। ঢাকায় একাই থাকেন। পরিবারের সবাই চুয়াডাঙ্গা সদরে। শুরুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাড়ি যাবেন না। এখন মত পাল্টেছেন।
গাবতলী বাস টার্মিনালে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স কাউন্টারের সামনে এই প্রতিবেদককে ইকবাল বলেন, ‘আমার চার বছরের একটা মেয়ে আছে। মেয়েটা ভিডিও কলে এমন করে কান্না করল। নয়তো এত কম সময় নিয়ে রিস্ক নিয়ে যেতামই না।
‘আমার তো ২২ তারিখের মধ্যে ঢাকায় ফেরাটা জরুরি। বাড়ি গিয়ে আটকে পড়লে তো ঝামেলা। ঢাকায় ফিরতেই হবে। তাই আমার দুইটা টিকিট লাগবে, যাওয়া-আসার। এটা নিশ্চিত না হইতে পারলে আমি যেতে পারব না। যাওয়ার টিকিট পাইছি। আসার টিকিট কখন দেবে, জানি না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের দায়িত্বরত শিবলী মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আপাতত অগ্রিম টিকিট দিচ্ছি না। রানিং টিকিট দিচ্ছি। ঘাটে অনেক জ্যাম। সেটা অনুযায়ী গাড়ি বের হচ্ছে সে অনুযায়ী টিকিট দিচ্ছি।’
ইকবাল মাহমুদের মতো আরও অনেকেই ফিরতি টিকিট নিশ্চিত না হওয়ায় অনেকে বাড়ি যাওয়া নিয়ে দ্বিধায় আছেন।
একই চিত্র দেখা যায়, মহাখালী বাস টার্মিনালেও। একতা বাস কাউন্টারের সামনে উপচে পড়া ভিড়। বেশির ভাগই এসেছেন বাড়ি থেকে ফেরার অগ্রিম টিকিট নিতে। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকেও টিকিট না পেয়ে যাত্রীর হট্টগোল দেখা যায় সেখানে।
একতার কাউন্টারে চুপ করে বসে আছেন হৃদয় মিয়া। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, এনারা সবাই অগ্রিম টিকিট চাইতাছে। আগেই কইয়া দিছি অগ্রিম টিকিট নাই। তাও চিল্লাফাল্লা করতাছে, গালমন্দ করতাছে। আমরা তো মালিক না। আমরা কর্মচারী। রানিং টিকিট বেচতাছি। আমরা তো বেচার জন্যই বইসা আছি। টিকিট তো জমায় রাখার জিনিস না।’
একতার কাউন্টারের সামনে হট্টগোল করা যাত্রীদের কাছে জানতে চাইলে, তারাও বলছেন, ফিরতি টিকিট চাইছেন তারা।
নওগাঁর জন্য টিকিট কাটতে আসছেন মালিহা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ফিরতি টিকিট ছাড়া বাড়ি যাব কোন ভরসায়। এই হানে তো আবার ফেরত আশা লাগবে। এইহানে সবকিছু।’
এনা বাস কাউন্টারের এজিএম মইন উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘তুলনামূলক যাত্রী কম। বাড়ি গেলে ফিরতে পারবে কি না এই ভয়ে অনেকেই বাড়ি যাইতেছে না। আর ধরেন যারা যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই এত গরিব ধরনের, আর ঢাকায় ফিরবেন না। আর ধরেন, ভাড়াটা বেশি। এত টাকা খরচ কইরা দুদিনের জন্য যাওয়ার থেকে না যাওয়াই ভালো মনে করতেছেন অনেকে।’