পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় থাকেন নির্মাণ শ্রমিক সুরুজ মিয়া। কাজ করেন আশুলিয়ায়। প্রতিদিন পারিশ্রমিক পান ৫০০-৬০০ টাকা। লকডাউনের আরোপের পর গত কয়েকদিন পিকআপে যাতায়াত করছিলেন কাজে।
তবে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনের প্রথম দিনে সেটি আর হয়নি। অনেক সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছু না পেয়ে বাসায় ফিরে যান তিনি। শাটডাউনের প্রথম দিনেই আয়হীন হয়ে পড়েন সুরুজ মিয়া।
তিনি বলেন, ‘আমাগো জন্য তো আর কেউ চিন্তা করে না। সরকার লকডাউন দিছে, ভাল কথা। আমাগো খাওনের ব্যবস্থা করে দিক না। খাওনও দিব না কেউ, কামেও যাইতে দিব না। কেমনে কী? কাম না করলেও তো খাওন লাগে। কাইল (কাল), পরশু না গেলে তো কন্টাকটর নতুন লোক কামে নিব।’
বুধবার এক সপ্তাহের জন্য বিধিনিষেধ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে এবারের বিধিনিষেধ ‘কঠোর’ই করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হলেই গ্রেপ্তার করার কথা বলেছে পুলিশ। বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য করতে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনীও।
কিস্তিতে কেনা নিজের গাড়ি চালান ড্রাইভার সারওয়ার হোসেন। যখন যেখানে ভাড়া পান সেখানেই যান। কিন্তু এবার কঠোর লকডাউনে ভাড়া পাননি তিনি।
সারওয়ার বলেন, ‘এবারের লকডাউনে বেশি কড়াকড়ি দেখছি। পাস আছে এমন কোনো কাস্টমারও পাই নাই। তাই গাড়ি বাইর করি নাই। আর গাড়ি বাইর না করা মানে আয় বন্ধ।
‘রিকন্ডিশন গাড়ির কিনার টাকা এখনও শোধ করতে পারি নাই। এক দুই দিন থাকলে না হয় রেস্ট হিসাবে ধরমু। এর বেশি হইলেই ধরা খামু। ভাড়ার টাকা দিয়াই ধারকিস্তি শোধ করতাছি।’
এবারের লকডাউনে বন্ধ শপিং মল, মার্কেট, পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার এবং বিনোদনকেন্দ্রসহ প্রায় সবকিছুই। আর সময় কাজহীন এসব খাতের মানুষের বেশিরভাগ মানুষ। তাদের আয়-রোজগারও বন্ধ।
গণপরিবহন না থাকায় হেঁটেই কারখানায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা। ছবি: নিউজবাংলা
এসব খাতের মধ্যে বেশিরভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের, তারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন। এক দুই দিন পরে মালিকপক্ষ তাদের বেতন বন্ধ করে দেয়।
২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৮ লাখ। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে (শ্রম আইনের সুবিধা পান এমন) কর্মরত জনশক্তি মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে বড় অংশ ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত।
কাজের জন্য দিনমজুরের অপেক্ষা
রাজধানীর নতুন বাজার প্রগতি সরণিতে বসে সকাল থেকে দুপর পর্যন্ত কাজের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন শতাধিক মানুষ। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি ছিল নারীর উপস্থিতিও। সবার হাতেই কোদাল, খুন্তি, ডালি বা শাবল। অন্যদিনের মতো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারের দেয়া কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিনে আজও তারা একইভাবে বসে ছিলেন একই স্থানে। কিন্তু বিধিনিষেধে স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ থাকায় কেউ তাদের কাজে নেয়নি।
ভালো যায়নি রিকশা ভ্যান চালকেরও
কড়াকড়ির কারণে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা। তাই রিকশা-ভ্যান চালকদের পথে থাকার সুযোগ থাকলেও ভাড়া ছিল কম।
ভ্যানচালক ফারুক বলেন, ‘অন্যদিন কারওয়ান বাজারের খ্যাপ (ভাড়া) মাইরা সময় ছিল না। আজ দুপর পর্যন্ত একটা মারছি। বাকিটা বইসা আছি।’
দুপরে রিকশাচালক শহিদ জানান, একে তো লডডাউন, রিকশায় প্যাসেঞ্জার নিলেও সমস্যা। পুলিশ নানা কথা জিগায়। কেন বাইর হইছে, কি দরকার, কই যাইব নানা ঝামেলা। তাই প্যাসেঞ্জার কম। লগে আবার বৃষ্টিও যোগ ওইছে। সকালের তুন বৃষ্টিত ভিজি দুইশ টাকা ভাড়া মারছি। জামায় যাইব দেড়শ টাকা। বাকি বেলা কী অয় কে জানে।’
ভোগান্তি ছিল পোশাক শ্রমিকদেরও
কারখানা খোলা থাকায় কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার ভোগান্তিতে ছিলেন পোশাক শ্রমিকরাও। বেশিরভাগ কারখানারই তাদের শ্রমিকদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করেনি।
কোনো কোনো পোশাক কারখানা তাদের শ্রমিকদের যাতায়াতে নিজস্ব পরিবহনের ব্যবস্থা করেছে। তবে সেটি প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অনেক কম। অনেকে ভাড়া করা গাড়িতে রাজধানী থেকে বের হতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে পড়েন। বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে বা রিকশায় চেপে কারখানায় যান শ্রমিকরা।