জামালপুরের তরুণ মাসুদ। অভাবে পড়াশোনা করা হয়নি। জীবিকা তাকে করেছে রাজধানীমুখী। বছর ছয়েক ধরে ঢাকায় আছেন। এই সময়ে ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন না হলেও, রিকশা চালিয়ে টানাটানির জীবনটা কেটে যাচ্ছিল।
কিন্তু হঠাৎ ঘটে বিপত্তি। কারণ করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের শাটডাউন ঘোষণা। আর এতেই নামে তার জীবনে অন্ধকার। সরকারের জারি করা শাটডাউন বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। আর শাটডাউন কার্যকরে মাঠে নেমেছে পুলিশ-র্যাব-সেনাবাহিনী-বিজিবি।
যন্ত্রচালিত যান না হওয়ায় শাটডাউনে রিকশা নিয়ে পথে নামতে পেরেছেন মাসুদ। ঘড়ির কাঁটা তখন ৩টার ঘরে। মগবাজার মোড়ে রিকশার পেছনের সিটে হেলান দিয়ে উদাসীন তিনি, কপালে চিন্তার রেখা।
রিকশা রাস্তায় নামতে দিলেও সরকারি বিধিনিষেধের কারণে সড়কে নেই কোনো যাত্রী। তাই কর্মক্ষেত্রে নেমেও অলস সময় কাটছে মাসুদের।
তার সঙ্গে কথা বলতেই অভিমান ঝরে পড়ে কণ্ঠে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সারা দিনে এখনও ২০০ ট্যাকাও ভাড়া মারতে পারি নাই। সাধারণত এই সময়ে ৬০০/৭০০ ট্যাকা পর্যন্ত ভাড়া মারি। লকডাউন মানে হইলো প্যাট ডাউন। এগুলোতে গরিবের হয় মরণ। এই লকডাউনে আমরা ধ্বংস হইয়া যাইতাছি।’
সড়কে মানুষের চলাচল ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে টহলে আছে সেনাবাহিনী, র্যাব। মোড়ে মোড়ে আছে ভ্রাম্যমাণ আদালতও।
মাসুদ বলেন, ‘এখন আমরা কোথায় যামু বলেন। বলার মতো কোনো ভাষা নাই। রাস্তায় মানুষই নাই, মানুষ না থাকলে আমরা ইনকাম করুম কেমনে? জীবনে এ রকম সমস্যায় আর পড়ি নাই।’
এমন বিপদগ্রস্ত দিনে নিজের নিয়তিকেই দোষারোপ করছেন ভাগ্যবিড়ম্বিত মাসুদ। তার ভাষায়, ‘এই লকডাউন তো আমাগো মানা সম্ভব না। এর লাইগা সবচেয়ে ক্ষতি হইতাছে আমাগো। যারা লকডাউন দিছে তারা তো বাসায় বইসা রইছে। আমাগো ভুল হইছে গরিব ঘরে জন্ম নেয়া, নইলে আমাগো এই অবস্থা হইবো কেন?’
করোনাভাইরাস যে প্রাণঘাতী এই কথা এতদিনে জানা হয়ে গেছে মাসুদের। কিন্তু তার কাছে ক্ষুধার তাড়না মৃত্যুভয়ের চেয়েও বেশি তীব্র। অন্তত তার কথায় এমনই চিত্র ফুটে ওঠে।
মাসুদ বলেন, ‘করোনা হউক আর যা-ই হউক আমি বাহির হইছি প্যাটের দায়ে। এখন আমাগো অবস্থা হইলো জীবিত থাকতে মরণের মতো। এইভাবে দিন চলবো কন?’
মাসুদের সংসারে সদস্যসংখ্যা ছয়। তাদের সবার ভরণপোষণের দায়িত্বটাও তার কাঁধে। তাই চিন্তাটাও বেশি। তার দিকে তাকিয়ে সন্তানসন্ততি।
আক্ষেপের সুরে মাসুদ বলেন, ‘আমার বাসায় ছয়ডা প্যাট। এখনও খাওনেরও ট্যাকা জোগাড় করতে পারি নাই। আবার মালিকের জমাও দিতে হইবো, এমনে সংসার কেমনে চলবো?’
সরকার শ্রমজীবীদের জন্য সহায়তার কথা বললেও সেটা মাসুদ বা তার মতো অনেকের কাছে পৌঁছায় না বলেও ক্ষোভ আছে তার। তবুও সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছেন তিনি।
মাসুদ বলেন, ‘আর কার আশায় থাকবো কন? সরকার যদি আমাগো দিকে একটু দেখতো। সরকার তো রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেয়। আমাগো দেয় না ক্যা? আমরা কি এই দ্যাশের মানুষ না?’