সর্বাত্মক লকডাউনকে সামনে রেখে মরিয়া হয়ে ঢাকা ছাড়ছেন সাধারণ মানুষ। তবে আগে থেকেই বন্ধ দূরপাল্লার বাস চলাচল। ফলে যারা ঢাকা ছাড়ছেন, তাদের যেতে হচ্ছে ভেঙ্গে ভেঙ্গে, বাস বদল করে।
ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথগুলোতে শুক্রবার থেকেই যাত্রীর চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। রোববার সকালে রাজধানীর গাবতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পায়ে হেঁটে আমিনবাজার অভিমুখে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় আন্তঃজেলা লোকাল বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি তাদের ভরসা। পাশাপাশি বাইক রাইডারদের দেখা যায় দূরপাল্লার যাত্রীদের নিয়ে ছুটে যেতে।
রোববার সকাল থেকে আমিনবাজার ব্রিজের গোড়ায় মোটরবাইক নিয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বাইক চালকদের। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যাত্রীদের কাছে তারা জানতে চাইছেন, কোথায় যাবেন। দরদাম করে ভাড়া ঠিক হলে কোনো মোটরসাইকেলে একজন, আবার কোনোটায় দুজন যাত্রী নিয়ে ছুটছেন বাইকাররা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন পাটুরিয়া ঘাটে যাবেন বলে একজন মোটরসাইকেল চালকের সাথে চুক্তি করলেন। ভাড়া ঠিক হলো ৮শ টাকা।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাস তো চলে না, হেঁটেই আমিনবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। ব্রিজের গোড়ায় আসার পর এই বাইকার ভাই বললেন, কোথায় যাব। ভাড়া ঠিক করে চলে যাচ্ছি। টাকা বেশি লাগলেও উপায় দেখি না, যেতে তো হবেই।’
আরেকটি বাইকে দুজন যাত্রীকে নেয়া হল ১২শ টাকায় পাটুরিয়া নামিয়ে দেয়া হবে বলে।
ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে বাইক চালক শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘যাত্রীরা যেতে চাইলে আমার কোনো অসুবিধা নাই। আমি দুজন নিয়ে চালিয়ে অভ্যস্ত। আর ডাবল না নিয়েও কি করব বলেন, এতো মানুষের চাপ তারা যাবে কেমনে?’
কথা হয় আমিনবাজার ব্রিজের গোড়ায় অপেক্ষমান বাইক চালক মনির হোসাইনের সাথে। তিনি পেশায় পাঠাও রাইডার। লকডাউনের কারণে পাবনায় চলে যাচ্ছেন। রওনা দেবার আগে পাবনার একজন সহযাত্রী খুঁজছেন তিনি। ভাড়া চান ৩ হাজার টাকা।
আমিনবাজার এলাকায় বাইক নিয়ে অপেক্ষমান রাইডারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের অনেকে ঢাকার ভিতরে অ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ার করে জীবিকা চালান। লকডাউনের কথা শুনে শুক্রবার থেকে তারা দূরপাল্লার যাত্রী বহন করা শুরু করেছেন। উপায় না পেয়ে যাত্রীরাও বেশি ভাড়া দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে নিজেদের গন্তব্যে ছুটছেন।
রেন্ট-এ-কারের ব্যবাসা কয়েক গুণ
গাবতলী পার হতেই মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারের দীর্ঘ সারি। বাস বন্ধ থাকায় দূরপাল্লার যাত্রীদের ভরসা এখন ভাড়ায় চালিত এসব গাড়ি।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকার বাসের মতো করে যাত্রীদের ডেকে যাচ্ছেন ভাড়া গাড়ির চালকেরা। ঢাকা থেকে খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ উত্তরাঞ্চলের সব জেলাতেই যাওয়া যাচ্ছে প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাসে করে।
আসন হিসেবে ভাড়া ধরা হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ যেতে মাইক্রোবাসের এক সিটের ভাড়া ১৬শ টাকা। খুলনা যেতে গুণতে হয় ২৫শ টাকা, যা নিয়মিত বাস ভাড়ার কয়েক গুণ বেশি। নিরুপায় যাত্রীরা এসব প্রাইভেটকার মাইক্রোবাসের যাত্রী হচ্ছেন।
এখানে কথা হয় মাইক্রোবাস চালক আব্দুল আলীমের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ২৫ বছর ধরে ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাচ্ছেন। আগে গাড়ির ট্রিপ দিয়ে যা হতো তা দিয়ে কোনো রকমে নিজের সংসার চলতো। তবে করোনা মহামারির সময় থেকে তার আয় বেড়েছে কয়েক গুণ। বিশেষ করে বাস বন্ধ থাকলে ট্রিপ দিয়ে কুলাতে পারেন না আলিম।
আব্দুল আলীম বলেন, ‘বাস বন্ধ থাকলে আমাগো সুবিধা। অনেক ট্রিপ পাওয়া যায়। আগে গাড়ি চালায়া মাসে পনের-বিশ হাজার টিকত। অহন আল্লায় ভালা রাখছে, মাসে লাখ টাকা আনন যায়।’
আরেক চালক রহমতুল্লাহ লকডাউনের সময় পুরো গাড়ি রিজার্ভে না গিয়ে আসনভিত্তিক ভাড়া নিচ্ছেন। কারণ আসন ভিত্তিক ভাড়া নিলে অনেক বেশি উপার্জন হয়। ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ রিজার্ভ গেলে পুরো মাইক্রোবাসের ভাড়া পাওয়া যায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। আর প্রতি আসনে ১৬শ টাকা করে নিলে পাওয়া যায় প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া।
আরেক প্রাইভেটকার চালক আমিনবাজার থেকে চার জন যাত্রী নিলেন খুলনা যাবেন বলে। প্রত্যেকের কাছ থেকে সিট ভাড়া নেয়া হল তিন হাজার টাকা করে।
আমিনবাজারে অপেক্ষমান গাড়ি চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেল, তাদের অধিকাংশই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কোনো রেন্ট-এ-কার কোম্পানির চালক হিসেবে অথবা ঢাকার ভিতরে অ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং চালক হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু লকডাউনের খবর পেয়ে তারা বাড়তি আয়ের জন্য এভাবেই যাত্রী বহন শুরু করেছেন।