ইউরোপ টেক্স ফ্যাশন লিমিটেডের কান্ট্রি ম্যানেজার শ্রীলঙ্কান নাগরিক প্রসন্ন গোমেজ। তার বিরুদ্ধে ২০ বছরের এক তরুণকে বলাৎকারের অভিযোগে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা হয়েছে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন তিনি।
প্রসন্নের বিরুদ্ধে মামলার আগে একই থানাতে এই ঘটনায় ভুক্তভোগীর পক্ষে একটি অভিযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে পুলিশ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। প্রসন্ন বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ‘মিষ্টি খাওয়ার’ জন্য টাকা নিতে উত্তরা পশ্চিম থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) আকিব নূর প্রস্তাব দেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর পরিবারের।
ঘটনার পর প্রায় এক মাস পর গত ১৯ জুন ইউরোপ টেক্স ফ্যাশন লিমিটেডের কান্ট্রি ম্যানেজার শ্রীলঙ্কান নাগরিক প্রসন্ন গোমেজ ও একই কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তা মহিউদ্দিন রনির বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগীর মা। মামলাটি তদন্ত করছে, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ। এই মামলায় প্রসন্নকে ২০ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। পলাতক রয়েছেন অপর আসামি মহিউদ্দিন রনি।
ভুক্তভোগী তরুণের মা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাটা আমার ছেলে প্রথমে বলেনি। ওরে থানা থেকে আকিব নূর নামে একজন এসআই ফোন করে টাকা নিয়ে আর কোনো ঝামেলা না করার কথা বলে। তখন আমার ছেলে ওই এসআইকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলে। এরপর ওই এসআই আমাকে কল করে ঢাকায় গোমেজের অফিসে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ার টাকা আনার প্রস্তাব দেয়। আমি রাজি হইনি।’
গোমেজের কাছ থেকে ‘মিষ্টি খাওয়ার’ জন্য টাকা নেয়ার প্রস্তাবের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এসআই আকিব নূর। তিনি বলেন, ‘মামলার আগে একটা অভিযোগ আমরা পেয়ে তদন্ত শুরু করি। কিন্তু ভুক্তভোগীর পরিবারকে টাকা নিয়ে মিটমাটের কোনো প্রস্তাব দেয়া হয়নি। এই অভিযোগ অসত্য।’
একই দাবি করেছেন উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মো. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ পেয়ে আমরা তদন্ত শুরু করি। ঘটনাস্থলে যাই, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলি। কথা বলার জন্য আমরা ভুক্তভোগীর পরিবারকেও ডেকেছিলাম। কিন্তু তারা আসেননি। যে কারণে তদন্ত স্থগিত থাকে। পরবর্তীতে মামলার এজাহার দেয়ায় আমরা মামলা নেই।’
প্রাথমিক অভিযোগটি এসআই আকিব নূর তদন্ত করলেও কোনো সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া হয়নি বলেও দাবি ওসি আখতারুজ্জামানের।
শ্রীলঙ্কান নাগরিকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ
ভুক্তভোগী তরুণের মা ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলায় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। প্রসন্ন গোমেজ ও মহিউদ্দিন রনির বিরুদ্ধে করা মামলাটির বাদী তিনি।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী একজন কোরআনের হাফেজ। তিনি গত বছরের ১ নভেম্বর একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানিতে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ শুরু করেন। কোম্পানির মাধ্যমে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সড়কে একটি বাড়ির গার্ড হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই বাড়ির নিচ তলায় অন্য আরও তিনজন সহকর্মীর সঙ্গে থাকতেন ওই তরুণ।
একই বাড়ির সপ্তম তলায় ইউরোপ টেক্স ফ্যাশন লিমিটেডের একটি গেস্ট হাউজ রয়েছে। সেখানেই মাঝে মাঝে থাকতেন ওই কোম্পানি কান্টি ডিরেক্টর প্রসন্ন।
এজাহারে বলা হয়, সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ওই হাফেজ তরুণের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে প্রসন্নের। ওই তরুণকে ভাল চাকুরির আশ্বাস, মাঝে মাঝে কাপড় চোপড় উপহারও দিতেন তিনি। এক পর্যায়ে ওই তরুণকে কোম্পানিতে ভাল চাকুরির দেবেন বলে জানান গোমেজ। সেজন্য টাকা চান ১ লাখ। তরুণের পরিবার ৬০ হাজার টাকা ম্যানেজ করে প্রসন্নের হাতে তুলে দেন। টাকা দেয়ার সময় তরুণের সহকর্মীরাও পাশে ছিলেন।
কিন্তু চাকরি দেননি প্রসন্ন। চাকরি না দেয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তাল বাহানা শুরু করেন শ্রীলঙ্কার এই নাগরিক।
তরুণের মা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসামি আমার ছেলেকে খারাপ কাজ করার প্রস্তাব দেয়। গত ২১ মার্চ আমার ছেলেকে ওই বাসার ছাদের ডেকে নেয় গোমেজ। তাকে জিন্সের প্যান্ট ও দুটি গেঞ্জি আরও অন্যান্য জিনিস উপহার দেয়। এক পর্যায়ে আমার ছেলের লজ্জাস্থানসহ শরীরের অন্যান্য জায়গায় স্পর্শ করে। তখন আমার ছেলে কোনোমতে পালিয়ে নিচে চলে আসে।
‘আমার ছেলে তার সাথে খারাপ কাজে রাজি না হওয়ায় বিভিন্নভাবে ফুসলাতে থাকে। আমার ছেলে রাজি না হওয়ায় ভয় ভীতি ও হুমকি দেয়া হচ্ছিল। আমার ছেলে ভয়ে এবং মান সম্মানের কথা চিন্তা করে এই বিষয়ে কাউকে কিছু বলেনি।’
এজাহারে বলা হয়, ছাদের ঘটনার দুই মাস পর গত ২৬ মে ভোর ৪টার দিকে দায়িত্ব পালন করার সময় ওই তরুণকে বলাৎকার করেন প্রসন্ন গোমেজ।
এজহারে ওই তরুণের মা বলেন, ‘আমার ছেলেকে ডিউটিরত অবস্থায় আসামি প্রসন্ন গোমেজ নিচ তলায় ম্যানেজার জাকারিয়ার রুমে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক বলাৎকার অর্থাৎ প্রকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে। তখন আমার ছেলের চিৎকারে সিকিউরিটি গার্ড রিমন ও ম্যানেজার জাকারিয়া আগাইয়া আসে এবং আমার ছেলেকে আসামির কবল থেকে বিবস্ত্র অবস্থায় উদ্ধার করে।’
ওই তরুণের মা নিউজবাংলাকে জানান, ঘটনাটি কাউকে না জানাতে প্রসন্ন তার ছেলেকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছিলেন। এসব সহ্য করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে ঝালকাঠি গ্রামের বাড়িতে চলে যায় তার ছেলে। লজ্জায় ঘটনাটি কাউকে জানাতেও পারছিল না।
ঘটনা চাপিয়ে যেতে ওই তরুণকে উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই আকিব নূর টাকা নেয়ার প্রস্তাব দেন। আর তখনই বিষয়টি মায়ের কাছে খুলে বলেন ওই তরুণ।
ঘটনাটি জেনে এবং পিবিআইয়ের একজন কর্মকর্তার সহায়তায় উত্তরা পশ্চিম থানায় গোমেজসহ দুই জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওই তরুণের মা। মামলাটির তদন্তভার নেয় পিবিআইয়ের অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ।
গোমেজের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আরও
গত ১৯ জুন মামলার পরদিনই উত্তরা থেকে প্রসন্ন গোমেজকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত তা বাতিল করে কারাগারে পাঠায়। সেই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
মামলার তদন্ত শুরুর পর প্রসন্নের বিরুদ্ধে এমন আরও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পিবিআই অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম বাবুল।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা আরও কিছু অভিযোগ পাচ্ছি। এসবেরও তদন্ত চলছে। উত্তরায় যে তরুণকে বলাৎকারের ঘটনায় মামলা হয়েছে, তা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের স্বীকারও করেছেন প্রসন্ন গোমেজ।’
মামলার অপর আসামি মহিউদ্দিন রনি এখনও পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম।