‘ওই ব্যাটা, যাত্রী তুলিস কেন?’
‘কাছে আয়, এক টাকাও বেশি ভাড়া পাবি না।’
সদরঘাট থেকে উত্তরার পথে ছেড়ে আসা ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনে গুলিস্তান গোলাপ শাহ বাজার এলাকায় দুই যাত্রী চিৎকার করে চালকের সহকারীকে হুমকি দিচ্ছিলেন।
কিন্তু তিনি গা করছিলেন না, আর একপর্যায়ে আরও অনেক যাত্রী যখন ভাড়া বাড়ানোর আগের হারে টাকা দেয়ার হুমকি দিতে থাকেন, তখন সেই সহকারী দরজা বন্ধ করেন।
ততক্ষণে বাসের বেশ কিছু আসনে দুজন করে বসেছেন। আর দাঁড়িয়েও ছিলেন অন্তত আটজন।
এটি কোনো এক দিন বা কোনো একটি সময়ের চিত্র নয়। করোনাকালে বিধিনিষেধের আওতায় বাসে যাত্রী অর্ধেক নিয়ে চলাচল করতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের যেন লোকসান না হয় সে জন্য ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
কিন্তু যখন রাস্তায় বেশি মানুষ থাকে, তখন বাসে বেশি যাত্রী তোলা হচ্ছে নিয়মিত, আর ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে ঠিকই নতুন হারে নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি এক নিয়মিত চিত্র। কিন্তু যাত্রীরা পেরে ওঠেন না কিছুতেই।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাসে ওঠার জন্য ডাকতে থাকা পরিবহন শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করলেই তারা জানান, ভেতরে আসন ফাঁকা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে যে যাত্রীরা কোনো রুটের মাঝপথ থেকে কোথাও যান, তারা জেনেবুঝেই বাড়তি যাত্রী হয়ে উঠতে চান। কারণ, তাদের হাতে এ ছাড়া উপায় অটোরিকশা ভাড়া করা। তাই কোথাও কোথাও জোর করে বাসে উঠতেও দেখা যায়।
এ ক্ষেত্রে পরিবহন শ্রমিকরা বাধা দেয়ার ভান করলেও আসলে ঠেকাতে চান না। এই ভানটা তারা আসলে করেন ভেতরে থাকা যাত্রীদের প্রবোধ দিতে।
গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে বাস ভ্রমণে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে।
যা যা ঘটে বাসে
তিন দিনের অভিজ্ঞতা সংক্ষেপ করলে যেটা হয়, তা হলো, ভোর ছয়টা থেকে যেসব গণপরিবহন চলাচল করে তা সকাল ৮টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেও ৮টার পর আর সেভাবে চলে না। তখন অফিসগামী যাত্রীর ভিড় বেড়ে গেলে যাত্রী তোলা হয় দাঁড় করিয়ে। আর দাঁড়ানো যাত্রীকে দেখে সহানুভূতিশীল হয়ে কেউ কেউ পাশের আসনে বসতে দেন।
এরপর যখন ভাড়া তুলতে আসেন তখন তখন বাসে শুরু হয় ঝগড়াঝাঁটি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাত্রীরা যখন চেপে বসেন, তখন হেলপার বলেন, ‘অফিস টাইম দুই-চাইরজন তো উঠবই’। আবার বলেন, ‘কী করুম কন, জোর কইরা তো উঠল’।
রাইদা পরিবহনের একটি বাসে পাশাপাশি আসনে বসেছিলেন স্বামী-স্ত্রী। উত্তরা থেকে যাবেন চিটাগাং রুটের একটি গন্তব্যে। তারা বলছিলেন, পাশাপাশি আসনে বসেছেন, তাই ভাড়া দেবেন আগের হারে। কিন্তু মানলেন না, ৬০ শতাংশ বেশি হারেই তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হলো।
অফিস সময় শেষে বিকেল ৫টার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যখন যাত্রী চাপ বেশি থাকে, তখন দুই আসনে একজন যাত্রীর এই নীতিমালা পালন করতেই দেখা যায় না।
রাজধানীর বাইরেও বাসগুলোতে ৬০ শতাংশ ভাড়া আদায় করার পরেও যাত্রী তোলা হচ্ছে বেশি। ছবি: নিউজবাংলা
মঙ্গলবার সকাল ১০টায় রাজধানীর মৌচাক থেকে বলাকা পরিবহনের একটি বাসে উঠে দেখা যায় পেছনের সারিতে ছয়টা সিট ফাঁকা। সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে উত্তরামুখী বাসটি মগবাজার আসার পর পাল্টে যায় চিত্র।
বাসে আসনসংখ্যার বিপরীতে বেশি যাত্রী উঠে পড়েন। চালকের সহকারী বাধা দিলেও অনেক যাত্রী রাগান্বিত হয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে বাসে ঢুকে পড়েন। তবে অনেকেই তাদের পাশের ফাঁকা আসন ছাড়তে রাজি না হওয়ায় দাঁড়িয়ে যেতে হয় তাদের। এই চিত্র চলে মহাখালী পর্যন্ত।
বাসে দাঁড়িয়ে থাকা এক যাত্রী বলেন, ‘আপনি মেবি সিট ফাঁকা থাকতে উঠতে পেরেছেন। আমি ২৫ মিনিট ধরে ওয়্যারলেস গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাসে উঠতে না পেরে হেঁটে মগবাজার আসি। বৃষ্টি ছিল। মহাখালী যাব। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব আমাকে আপনিই বলেন। আপনি হলে কী করতেন?’
অন্য কোনো বাহনে যেতে পারতেন এমন প্রশ্নে বলেন, ‘সিএনজিতে ভাড়া দেড় শ টাকা। একই অবস্থা বাইকে। আর আমি ১৫ টাকা দিয়ে যেতে পারব। এভাবে এত জনসংখ্যার শহরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসে যাতায়াত করা যায় না।’
বাসের হেলপার সুমন মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই সময়টাতে যাত্রীগো চাপ বেশি থাকে। বাস কম থাকায় আমরা নিরুপায় থাকি। অনেকেই ভাড়া নিয়া সমস্যা করেন। তবে আমি কিন্তু কাউকেই ভাই উঠতে বলি নাই।’
যাত্রী বেশি উঠলেও কারও কাছ থেকেই ভাড়া কম নিতে দেখা গেল না। দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা নিজেরাই উঠেছেন বলে আপত্তি করেননি। আর বসে থাকা যাত্রীরা হেলপারকে কিছুক্ষণ গালাগাল করে ঠিকই ৬০ শতাংশ বেশি হারে ভাড়া মিটিয়ে রাগে গজগজ করতে থাকেন।
ডেমরা থেকে বাইপাইলগামী লাব্বাইক পরিবহনেও একই চিত্র দেখা যায়। বিচ্ছিন্ন ঢাকা কার্যকর করার কারণে বাসটি এখন গাবতলী পর্যন্ত যেতে পারে। তবে নগরীর কয়েকটি স্থানে এই বাসে স্থান সংকুলন করা যায় না সময়ভেদে। আবার একই পরিবহন বাকি সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলাচল করে।
ঝগড়া যাত্রীর সঙ্গে যাত্রীরও
যেসব যাত্রী মাঝপথে ওঠেন, তখন বাসে আসন ফাঁকা না থাকলে তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দাঁড়িয়ে যেতে হয়। কারণ, বেশি ভাড়া পরিশোধ করে খুব কমসংখ্যক যাত্রীই আসন ভাগাভাগি করতে রাজি থাকেন।
লাব্বাইক পরিবহনের ওই বাসে ডেমরা থেকে বাসে ওঠেন শাখাওয়াত হোসেন। যাবেন গাবতলী। সেখান থেকে কোনো রকমে সেতু পার হয়ে যাবেন সাভারে।
কারওয়ানবাজার আসার পর এক যাত্রী জোর করে বাসে উঠে পড়েন। শাখাওয়াতের সিটে বসতে চাইলে বাধে বিপত্তি। শুরু হয় ঝগড়া।
শাখাওয়াত বলেন, ‘উনি জোর করে বাসে উঠেছেন। এটা আমি জানালা দিয়ে দেখি। বাসের সিট কিন্তু সব ভর্তি। বাসের সবাই জানালার বিপরীতে বসেছেন বিধায় উনি অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করেননি। আমিই একমাত্র জানালার পাশে বসে ছিলাম। আমার এখানে বসতে চাইলেন। আমি বললাম যে, এখন তো এক সিটে একজনকেই বসতে হবে। আপনি পেছনের সিটে গিয়ে বসুন। উনি আমার সাথে তর্ক জুড়ে দিলেন। এখন সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।’
টেকনিক্যাল মোড়ে ঘুরে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটগামী প্রজাপতি পরিবহন, পরিস্থান পরিবহন, সাভার পরিবহন, বৈশাখী পরিবহন, ডি লিংক ছাড়াও অনেকগুলো বাসে সব সিটে লোক বসানোর পর দাঁড় করিয়েও যাত্রী নেয়া হচ্ছে। তবে সকালের চিত্রে এমন দেখা গেলেও দুপুরের পর তা পালটে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনেকে প্রশ্ন এড়িয়ে যান। সাভার পরিবহনের চালক মানিক মিয়া বলেন, ‘সব সময় তো মানবার পারি না। যারা নিজেরা পরিচিত তারা দুই সিট মিলায়া বসে।’
তবে যাত্রীরা কেউ কারও পরিচিত নন। কোনো তদারকি হয় না বিধায় তারা একসঙ্গেই বসে যাতায়াত করছেন।
হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসে ভিড় আরও বেশি
বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টা। গন্তব্য রাজধানীর হাতিরঝিলের মগবাজার অংশ থেকে মেরুল বাড্ডা। এই রুটের জন্য নির্ধারিত রয়েছে হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিস। বাসে উঠেই প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়।
হাতিরঝিলে চক্রাকার বাসে প্রতিদিনই যাত্রীর ভিড় দেখা যায়। কিন্তু ভাড়া আদায় করা হয় বর্ধিত হারে।
চালক জব্বার মিয়া বলেন, ‘অরজিনালি স্বাস্থ্যবিধি যাত্রীরা মানতে চায় না। যাত্রীগো না করলে তারা ধাক্কা দিয়ে উঠতে চায়। আমি যদি যাত্রী থাকি আমিও ধাক্কাইয়া উঠি। ওই যে দেখেন একটা লোক দৌড়াইয়া আসতাছে। গাড়ির মধ্যে জায়গা আছে কি না নাই সে কিন্তু এটা বুঝে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘গাড়ি হইল ৪৫ সিটের। অফিস টাইমে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। কারণ যাত্রীদের সংখ্যা বেশি আর গাড়ির সংখ্যা কম।’
এই রুটে নিয়মিত একজন যাত্রী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের উচিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। তবে অফিস শুরু ও শেষের সময়ে অনেকক্ষণ বাসের অপেক্ষা করতে হয়। ক্লান্ত থাকার কারণে বাসে উঠতে হয় এভাবেই। কিছু করার নাই ভাই।’
দুই আসনে এক যাত্রী নীতি তুলে নেয়ার দাবি
চালক, শ্রমিকরা মানছেন না, যাত্রীরাও অনন্যোপায় হয়ে চাপছেন বাসে। এই অবস্থায় সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি যখন প্রতিপালন করা হচ্ছে না, তখন আর ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া কেন নেবে- এমন প্রশ্ন করলেন একাধিক যাত্রী।
সাখাওয়াত নামে এক যাত্রী বলেন, ‘দাঁড়িয়ে না নিয়ে বাসে সিট ফুল থাকুক। আর আগের ভাড়া ফিরে আসুক। তাহলে যাত্রীদের টাকাও বাঁচল আর ঝগড়াঝাঁটিও হলো না।’
তবে যখন সিটিং সার্ভিসে চলত, তখনও বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা ছিল এক স্বাভাবিক প্রবণতা। আর এ নিয়েই তখন পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীর ঝগড়াঝাঁটি-গালাগাল চলত।