বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলার আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ আর কতবার সময় চাইবে, এমন প্রশ্ন করেছে হাইকোর্ট।
আপিল শুনানির জন্য মামলাটি ৩৭৫ বার কার্যতালিকায় আসলেও শুনানি শেষ হয়নি। নতুন করে আবার তিন মাস সময় চাওয়ায় আদালত প্রশ্ন করে জানতে চায় আর কতবার সময় নেবেন।
বৃহস্পতিবার বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মোবিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ প্রশ্ন করে। পরে আদালত শেষবারের মতো আগামী ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দেয়। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষকে শুনানি শুরু করতেই হবে।
মামলাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি হলেও সাত বছরেও শেষ হয়নি এ মামলার আপিল। সাক্ষ্য-প্রমাণ শুনানি শেষে মামলাটি একসময় যুক্তিতর্কের পর্যায়ে গেলেও শেষ পরিণতি হয়নি। ফলে মামলাটি এখনও হাইকোর্টে শুনানির পর্যায়ে রয়ে গেছে।
সকালে শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহীন আহমেদ খান আদালতকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতির কারণে একটু সময় দরকার। যে পর্যন্ত না সামাজিক দূরত্ব বিধান পালনের বাধা দূর হবে, সে পর্যন্ত এ মামলার শুনানি করা কঠিন হবে। এ জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল সময় নিতে বলেছেন।
তখন আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, ‘ওই যে বলে না, প্রত্যেক জিনিসের একটা ভালো দিক আছে আবার মন্দ দিক আছে। কোভিড আপনাদের কত সাহায্য করছে- সময় নেয়ার জন্য আপনারা একটা ভালো গ্রাউন্ড পেয়ে গেছেন। আপনি কী করে বুঝবেন কোভিড কত দিন থাকবে? এখন আমরা আপনাদের কত দিন পর্যন্ত সময় দেব।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘আমরা আশাবাদী অবশ্যই এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। এখন তিন মাস সময় দেন আমাদের।’
তখন বিচারক বলেন, অপরপক্ষে কে আছেন, দেখি আপনি কী বলেন।
এ সময় অপরপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের পক্ষে আইনজীবী শিশির মনির তার বক্তব্য তুলে ধরেন। শিশির মনির বলেন, ‘আজ পর্যন্ত এ মামলাটি শুনানির জন্য ৩৭৫ দিন তালিকায় এসেছে। হাইকোর্টের তিনটা বেঞ্চ ঘুরেছে। প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়েছে। এরপর আবার আপনাদের কাছে এসেছে। রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় শুনানি করতে চায় না কেন এটাই এখন মিলিয়ন প্রশ্ন।’
‘যখন কোভিড ছিল না তখন কেন রাষ্ট্রপক্ষ সময় চেয়েছিল। মামলাটি প্রথম তালিকায় আসে ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল। আর মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে আসে ২০১৪ সালে। মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে সরকার পেপারবুক তৈরি করে। ২০১৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে সময় নিতে নিতে এ পর্যায়ে এসেছে।’
‘এখন রাষ্ট্রপক্ষ যদি শুনানি না করতে চায় তাহলে আপনারা সেনটেন্স সাজপেন্ড (সাজা স্থগিত) করে দেন। এই পরিস্থিতিতে সাজা স্থগিত করে কোথাও জামিন দিয়েছেন, কোথাও কনডেম সেল থেকে নামিয়ে নরমাল সেলে দিয়েছেন। পাকিস্তান ও ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এমন নজির আছে।
তিনি বলেন, ‘একজন মানুষ ৭ থেকে ৮ বছর ধরে কনডেম সেলে আছে। সময় নিতে নিতে মামলাটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অন্য সব মামলার শুনানি হবে, এটার শুনানি হবে না। কোভিড কি শুধু এই মামলার জন্য। এটা ভালো দেখায় না। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমাদের আবেদন হচ্ছে তাদের জামিন দিয়ে দেন, অথবা কনডেম সেল থেকে নরমাল সেলে দিয়ে দেন।’
তখন আদালত বলে, ‘এ বিষয়ে আপনারা লিখিত আবেদন করলে সেটি আমরা দেখব।’
আপাতত আগামী ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষকে শেষ সুযোগ দিচ্ছি। ওই দিন তাদের শুনানি করতেই হবে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু হয়। এরপর ওই বছরের ১৪ মার্চ চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ঠিক করা হয়। কিন্তু তারপর আর এগোয়নি মামলাটি। পরে আদালত মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। এরপর দীর্ঘ সময় পর প্রধান বিচারপতির নির্দেশে পৃথক আরেকটি বেঞ্চে দেয়া হয়। ওই বেঞ্চের বিচারক পরিবর্তন হওয়ায় সেখানেও শুনানি হয়নি। এভাবে কয়েক দফা আদালতের বেঞ্চ পরিবর্তন, বিচারক পরিবর্তন হয়ে অবশেষে বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মোবিনের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়।
২০১৪ সালের ২৩ জুন বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিন।
রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয় আদালত। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেয় আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামিরা।
মুফতি হান্নান ছাড়াও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন- মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা আকবর হোসেন, মুফতি আব্দুল হাই, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান ও মাওলানা আরিফ হাসান সুমন।
এর মধ্যে মুফতি আবদুল হান্নানের পৃথক একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির ওরফে আব্দুল হান্নান সাব্বির, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আব্দুর রউফ ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) জঙ্গিদের বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন ও অনেকে আহত হন। এ ঘটনায় থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করা হয়।
পরে ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে সিআইডি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেয়। পরে দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতে শেষ হয়।