রাজধানীর মালিবাগে একটি বস্তিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে যে তিনটি প্রাণ ঝরে গেল, তার পেছনে রয়েছে এক অবহেলা।
বস্তির সামনেই একটি খুঁটি থেকে নেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ-সংযোগ। সেই সংযোগটির তার অনেকটাই নড়বড়ে। ঝুলে পড়া এই তারটি বেশ পুরোনো। ওপরের আচ্ছাদন ছিঁড়ে গিয়েছিল আগেই।
ঝোড়ো হাওয়ায় এই তার প্রায়ই বাড়ি খায় লোহার ফটক আর টিনের চালে। তখন বিদ্যুতায়িত হয়ে যায় সেগুলো।
শনিবার বেলা আড়াইটার পর মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনাটিতে প্রথমে প্রাণ হারায় নয় বছরের ঝুমা। মৃত অবস্থায় সে পড়ে থাকার সময় পাশের ঘরে থাকা ১৩ বছরের পাখি এসে ঝুমাকে ছুঁলে সেও হয়ে যায় বিদ্যুতায়িত।
তার পাশের ঘরে থাকা ৬০ বছর বয়সী আবদুল হক এ অবস্থা দেখে দুটি শিশুকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু বাঁচাতে পারেননি কাউকে, প্রাণ হারান নিজেও।
ঘটনাস্থল মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার সোনামিয়া গলিতে।
এলাকায় গেলে আবদুর রহিম নামে একজন বলেন, ‘তিনজন লোক কারেন্টে বাইজ্যা মইরা গেছে।’
রহিমই সেই ঘরটি দেখিয়ে দিলেন, যেখানে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
ঘটনাস্থল একটি বস্তি। সেখানে বেশ কিছু টিনশেড ঘর আছে। একটি লোহার ফটক। ছোট্ট একটি ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল সারিবদ্ধ ছয়টি কক্ষ। দুই পাশেই আছে তিনটি করে।
মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর শুনে দলে দলে মানুষ ছুটে আসে বস্তিতেবাম পাশের যে তিনটি কক্ষ রয়েছে। তার প্রথম কক্ষে থাকত ঝুমা। পরের পক্ষে থাকত পাখি। শেষ কক্ষে থাকতেন আবদুল হক।
সেখানে তখন শত শত মানুষের ভিড়। প্রাণহানির খবর শুনে দলে দলে আসতে থাকে মানুষ।
ঝুমার মা কাজ করেন পাশের একটি পোশাক কারখানায়। খবর পেয়ে সেই কারখানা থেকেও আসেন শ্রমিকরা। সবাই বস্তির মালিকের সমালোচনা করছিলেন।
বস্তিবাসী জানালেন, গেটের পাশে বিদ্যুতের একটি খুঁটি। সেখানে বিদ্যুতের তারগুলো ছিল দুর্বল। বাতাস এলে তার লোহার ফটক ও টিনের চালে প্রায়ই বাড়ি খায়। এর আগেও কয়েকবার ঝড়-বৃষ্টিতে এ ঘটনা ঘটেছে।
বাড়িওয়ালাকে বারবার জানানো হলেও তিনি পদক্ষেপ নেননি। তিনি করছি, করব বলে সময়ক্ষেপণ করছিলেন।
এমনকি দুর্ঘটনার পরেও তিনি ঘটনাস্থলে আসেননি। বারবার তাকে ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
যেভাবে ঘটল ঘটনাটি
মর্মান্তিক এই ঘটনাটি কীভাবে ঘটল তা জানালেন ঝুমার মা।
তিনি বলেন, ‘যহন আমার মাইয়া গেট ধরছে, তহন বইয়া পইড়া এক্কেবারে জবান বন্ধ হইয়া গ্যাছে গা। আরেকটা যে বাচ্চা মরছে ঢাকা মেডিক্যালে, হ্যায় আমার মাইয়ারে কইছে ঢং করোস। কইয়া একটা লাত্থি মারছে। লগে লগে যাইয়া আমার মাইয়ার উপরে পড়ছে। আবার হ্যারে আবার বাঁচাইতে আসছে যে বুইড়া কাকা, হ্যারো বাঁচাইতে গিয়ে হ্যায়ও তাগো উপড়ে পইড়া রইছে।’
এ কথা বলেই কাঁদতে থাকেন এই পোশাকশ্রমিক। বলেন, ‘আমি এই দুঃখ কেমনে ভুলুম কন? আমি দুপুরবেলা আমার মাইয়ারে খাওয়াইয়া থুইয়া গেছি। আমার মাইয়ার লগে আমি শয়তানি কইরা গেছি। আমি আইতে না আইতে, এক ঘণ্টা যাইতে না যাইতেই আমার মাইয়ার লাশ দ্যাখলাম আমি।’
লোহার ফটকের ওপরে বিদ্যুতের যে তার ঝুলছে, সেগুলো মেরামত করতে বস্তিবাসী বারবার তাগাদা দিয়েছে। কিন্তু কান দেননি বাড়িওয়ালাতিনি বলেন, ‘একটা মেইন সুইচ নাই। বৃষ্টি আইলে কয়দিন পরে পরে আর্থইন করে বাসাবাড়ি।’
পেছন থেকে একজন বলেন, ‘সে কেমন বাড়িওয়ালা যে এত বড় বাড়িটা, তার বাড়ির মধ্যে মেইন সুইচ নাই?’
ঝুমার মা বলেন, ‘আর এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল, করুণ ঘটনা। বাড়িওয়ালার কি কোনো প্রস্তুতির দরকার ছিল না? তিনডা মানুষ মারা গেল, সে কিমুন বাড়িওয়ালা? কেমন টাকাপয়সাওয়ালা যে দেখতে আইল না, ঘরে ঢুকল না?
‘তার কাছে কি টাকা চাই না পয়সা চাই? সে কে? আমার মাইয়ার জীবন বড় না, টাকা বড়? আমার মেয়ে তো মারাই গেছে গা।’
সেখানে ঝুমার সঙ্গে প্রাণ হারানো পাখি বা আবদুল হকের কোনো স্বজন ছিলেন না।
পাখিকে নিয়ে তার স্বজনরা তখন ঢাকা মেডিক্যালে। আর আবদুল হক তার কক্ষে নিথর পড়ে ছিলেন। লোকজন যারা দেখতে এসেছিলেন, তাদের গায়ে রাখা চাদর তুলে দেখাচ্ছিলেন এক প্রতিবেশী।
এই আবদুল হক সম্পর্কে খুব একটা তথ্যও পাওয়া গেল না। বস্তিতে থাকা একজন জানান, এই মানুষটি একাই থাকতেন সেখানে। তার সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য অন্যরা জানেন না।
একজন বলেন, ‘তার আত্মীয়স্বজন থাকলে তো চোখে দ্যাখতাম।’
পাখিদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে। তার মা কুলসুম বেগম গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তিনি জানান, দুপুরের দিকে বৃষ্টির সময় মালিবাগ চৌধুরীপাড়া আবুল হোটেলের পেছনে বস্তিতে জমে থাকা পানিতে ঘরের বিদ্যুতের সংযোগ এক হয়ে যায়। এতে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
এরপর মালিবাগ রেলগেটে একটি হাসপাতালে নেয়া হয় ঝুমা ও আবদুল হককে। আর পাখিকে তার বাবা-মা নিয়ে যান ঢাকা মেডিক্যালে।
ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার (খিলগাঁও) মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই বডি তিনটা হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। একটা মেয়ে প্রথমে বিদ্যুতায়িত হয়। তাকে ধরতে গিয়ে আরও দুজন আক্রান্ত হয়। বজ্রপাতের কারণেও বিদ্যুতায়িত হতে পারে। এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।’