বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ডা. সাবিরা বাসায় একা, খুনি জানল কীভাবে

  •    
  • ১ জুন, ২০২১ ০০:১৮

কলাবাগানের যে বাসায় ৪৭ বছর বয়সী এই নারী চিকিৎসক থাকতেন, সেখানে থাকতেন তার মেয়েও। আগের দিন মেয়েকে নানির কাছে দিয়ে আসেন তিনি। সেই বাসায় দুই তরুণী সাবলেট থাকতেন। তাদের একজন ঈদের পর বাড়ি গিয়ে ফেরেননি। অন্যজন একজন মডেল যিনি ভোরে শরীর চর্চার জন্য বের হন। তিনি ফিরে আসার পর খুনের বিষয়টি প্রকাশ পায়। প্রশ্ন উঠেছে, সাবিরা যে ঘরে একা, সেটা খুনিরা কীভাবে জানত?

নৃশংস খুন। ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা। এরপর পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে মরদেহ। জিঘাংসা দেখে হতবাক পুলিশও।

নিহত কাজী সাবিরা রহমান একজন চিকিৎসক। কলাবাগান প্রথম লেনের ৫০/১ ভবনের তিনতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন মেয়েকে নিয়ে। আগের দিন মেয়েকে দিয়ে আসেন নানির বাসায়।

ওই ফ্ল্যাটে সাবলেট হিসেবে থাকেন দুই জন নারী। একজন ঈদের আগে বাড়ি গিয়ে ফেরেননি। অপরজন ভোরে বাসা থেকে বের হন ব্যায়াম করতে। পৌনে ১০টায় ঘরে ফিরে দেখেন চিকিৎসকের কক্ষ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

এই তরুণী একজন মডেল। স্নাতক পাস করেছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

এই তরুণীর বর্ণনা সঠিক হয়ে থাকলে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে।

প্রশ্ন হলো, সাবিরা যে তখন একা, সেটা খুনি বা খুনিরা কীভাবে জানল?

সেই বাসার নিচতলায় দারোয়ান থাকেন। সকালে কেউ বাসায় ঢুকেছেন, এমনটি দেখেননি বলে দাবি করেছেন তিনিও। তাকেও নিয়ে গেছে ডিবি।

সেই মডেলের এক ছেলেবন্ধুকেও নিয়ে গেছে পুলিশ।

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সাবিরা তার কর্মস্থল গ্রিন লাইফ হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে কয়েকজনের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার কথা ছিল বলে জানিয়েছেন একজন স্বজন। তবে কাদের সঙ্গে কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, তা এখনও জানা যায়নি।

সাবিরা ৮ থেকে ৯ বছর ধরে গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চাকরি করেছেন। বছর পাঁচেক আগে তার চাকরি স্থায়ী হয়। কাজ করতেন রেডিওলজি বিভাগে।

তার বয়স ৪৭। কার সঙ্গে কী নিয়ে দ্বন্দ্ব বা বিরোধ ছিল, তার ওপর কার ক্ষোভ ছিল, বিষয়টি হত্যার পর বড় হয়ে উঠলেও প্রথম দিন কোনো ধারণাও করতে পারছে না পুলিশ।

দুপুরের পর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ডা. সাবিরার কক্ষটি এলোমেলো। তবে কোনো জিনিসপত্র খোয়া গেছে কি না সেটি জানা যায়নি। আলমিরা তালাবদ্ধ অবস্থাতেই দেখা গেছে।

খুন হওয়ার চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান

সেই বাসায় কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই বলে জানিয়েছেন বাড়িওয়ালা। ফলে কে বা কারা ঘরে ঢুকেছেন সেটি দেখার সুযোগ নেই। খুনি সেই ফ্ল্যাটেও অবস্থান করতে পারেন, তবে আপাতত কাউকে সন্দেহও করতে পারছে না পুলিশ।

কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় সাবিরার স্বামী মারা যান। পরে তিনি আরেকজনকে বিয়ে করেন।

তবে দ্বিতীয় স্বামী শামসুদ্দীন আজাদের সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না। এক বছর ধরে তারা আলাদা থাকছিলেন। অবশ্য তাদের মধ্যে যোগাযোগও ছিল বলে জানিয়েছেন সাবিরার একজন স্বজন।

আজাদের বাসা ঢাকারই শান্তিনগরে। সাবিরা খুনের সংবাদ পেয়ে তিনি কলাবাগানের বাসায় আসেন।

সাবিরা কলাবাগানে থাকতেন নানা কারণে। তার চাকরিস্থল কাছে হওয়া ছাড়াও গ্রিন রোডেই তার মায়ের বাসা। অসুস্থ মাকেও দেখভাল করতে যেতে হতো মাঝেমধ্যে। আবার মেয়ের স্কুল ধানমন্ডিতে।

আগের সংসারেও সাবিরার একটি ছেলে আছে। তিনি ইংলিশ মিডিয়ামে ‘এ’ লেভেল শেষ করে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। থাকেন গ্রিনরোডে নানির কাছে।

যেভাবে ঘটনা জানতে পারে পুলিশ

কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ চন্দ্র ঠাকুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাবিরার পাশের রুমে একজন মডেল থাকতেন। তিনি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মেয়েটি এই বাসায় সাবলেটে ওঠেন।

‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছি, সেই মডেল সকাল ৬টা ১০ মিনিটের দিকে ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে যান। সকাল আনুমানিক ৯ টা ৪০ মিনিটে বাসার প্রধান গেট খুলে ভেতরে ঢুকে ধোঁয়া এবং পোড়া গন্ধ পান। তিনি তখন বাসার দারোয়ানকে জানান। এর পরে ফ্লাটের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা আরেক নারীকে জানান।

‘লোক জানাজানি হলে বাসার পাশের এক মিস্ত্রিকে এনে রুমের দরজার লক খুলে ভেতরে গিয়ে দেখেন ধোঁয়াচ্ছন্ন। যারা আসছিল তখন তারা আগুন মনে করে পানি মারে। এর পরে তারা ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দিয়েছে বলে জানায়। আর পুলিশ পরে খবর পায়।’

প্রথমে বাসায় যায় কলাবাগান থানা-পুলিশ। পরে তারা খবর দেয় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে। পরে ঘটনাস্থলে আসেন ডিবি, র‌্যাব, তদন্ত সংস্থা পিবিআই এর সদস্যরা।

চিকিৎসক সাবিরার বাসা থেকে নানা আলামত সংগ্রহ করছে পুলিশ

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছেন বলে জানানো হয়েছে। তবে কী কী আলামত পাওয়া গেছে, সেটি জানানো হয়নি। এটা জানানো হয়েছে, যে ধারাল অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটা নেই আলামতের তালিকায়।

জখম দেখে ওসি পরিতোষের ধারণা, ধারাল অস্ত্রটি চাকু ছিল।

শরীরে আঘাত চারটি, দেয়া হয়েছে আগুন

ওসি পরিতোষ জানান, ক্রাইম সিন ইউনিট ওই নারীর শরীরে রক্তাক্ত কাটা জখমের চিহ্ন পেয়েছে। এর মধ্যে দুটি ক্ষত বেশ গভীর, দুটি কম। গলার জখম দুটি বড়। পিঠের দুটি ছোট।

মরদেহ পড়েছিল খাটের ওপর উপুড় হয়ে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে আঘাত করা হয়েছে পেছন থেকে।

ওসি পরিতোষ বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা যে তথ্য পেয়েছি, তাতে আমাদের কাছে এটি একটি হত্যাকাণ্ড মনে হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মডেল ও তার এক ছেলেবন্ধু এবং ওই বাসার দারোয়ানকে ডিবি নিয়ে গেছে।’

ঘটনাস্থলে যাওয়া ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের নিউমার্কেট জোনের উপ কমিশনার শরীফ মাহমুদ ফারুকুজ্জামান বলেন, ‘মৃতের পিঠে কোমরের ওপরে ধারাল অস্ত্রের দুটি আঘাতের জখম দেখা যায় এবং তার গলায় দুটি রক্তাক্ত ও গভীর (জবাই সদৃশ) জখম দেখা যায়। একজন নারী এসআই এবং নারী কনস্টেবলের সহায়তায় মরদেহের সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।’

‘খুন শত্রুতা থেকে’

সাবিরাকে হত্যার খবর শুনে ঘটনাস্থলে আসা স্বামী শামসুদ্দিন আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি বেলা ১১টার দিকে খবর পেয়ে এখানে আসি। পুলিশ প্রথমে ভেতরে ঢুকতে দেয় নাই। পরে পরিচয় জেনে দিয়েছে। আর ঢুকে দেখি রক্তাক্ত লাশ।’

কারা এই ঘটনা ঘটাতে পারে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে সন্দেহ করতে পারছি না। পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে আমি এর সঠিক বিচার চাই।’

সাবিরার খালাতো বোন জাকিয়া খন্দকার মমি বলেন, ‘আজকে সাবিরার অফিস ছিল এবং বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। মেয়ে গতকাল নানুর বাসায় গিয়েছিল। ছেলে নানুর বাসায় থাকে। আমার মনে হয় আশপাশের কেউ শত্রুতার জের ধরে তাকে হত্যা করেছে।’

সাবিরাকে হত্যার পর তার কক্ষটি এলোমেলো দেখা যায়। তবে কিছু খোয়া গেছে কি না তা জানা যায়নি

নিহত চিকিৎসকের মামাতো ভাই রেজাউল হাসান দুলাল বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম গ্যাসের সিলিন্ডার ব্লাস্ট হইছে। পরে এসে দেখি মরদেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ঘাড়ে ও পিঠে ক্ষতের চিহ্ন আছে। এই হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’

কাকে বা কাদের সন্দেহ করছেন- এমন প্রশ্নে কলাবাগান থানার ওসি পরিতোষ চন্দ্র ঠাকুর বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন। তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি নিয়ে গেছে। এখনও বলা যাচ্ছে না কে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি উঠে আসবে।’

‘তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন খুব ভালো’

গ্রিন লাইফ হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, ডা. সাবিরা রোববার রাতে বলে এসেছিলেন তিনি সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে আসবেন।

হাসপাতালের আয়া সাথি বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ম্যাডামের ফোন দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু ম্যাডাম রিসিভ করতেছিলেন না। সকাল সাড়ে ৯টায় রোগী দেখার টাইম দেয়া ছিল। ম্যাডাম বলে গেছিলেন আমি ৯ টায় আসব।’

রাজধানীর গ্রিন রোডের এই হাসপাতালটিতে রেডিওলজি বিভাগে চাকরি করতেন সাবিরা রহমান

হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের কম্পিউটার অপারেটর অমলা বিশ্বাস বলেন, ‘সব কিছু মিলিয়ে তিনি (সাবিরা) খুব ভালো মানুষ ছিলেন। উনি আমাদের সঙ্গে ডাক্তার হিসেবে মিশতেন না। উনি খুব মিশুক মানুষ ছিলেন। এখানে ছোট বড় সবাইকে খুব ভালোবাসতেন।’

এ বিভাগের আরো খবর