রাজধানীর একটি ট্রাফিক সিগন্যালে সম্প্রতি সবুজ, হলুদ ও লাল বাতি একসঙ্গে জ্বলে ওঠায় বিভ্রান্তিতে পড়েন এক গাড়িচালক। সেই দৃশ্যের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেন তিনি। লেখেন, ‘আমি এই সবগুলো সিগন্যাল লাইট একসঙ্গে দেখলে কী করব? ট্রাফিক বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, এই সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান চাই।’
বিষয়টি নজরে এলে এই বিভ্রান্তির কারণ খুঁজতে নামে নিউজবাংলা। শুরুতেই তেজগাঁও বিভাগ ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শামীম আহমেদের কাছে তিন ধরনের বাতি একসঙ্গে জ্বলে ওঠার কারণ জানতে চাওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘ঢাকার ট্রাফিক বাতি ম্যানুয়ালি চলে। ট্রাফিক সিগন্যালগুলো সিটি করপোরেশন থেকে ইনস্টল করা হয়।’
এরপর নিউজবাংলার এই প্রতিবেদক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (নগর ভবন) বিদ্যুৎ বিভাগে গেলে সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জাফর আহমেদ বলেন, ‘এটি আমাদের দেখার বিষয় না। এটি দেখে সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল।’
গাছের আড়ালে রাজধানীর একটি ট্রাফিক সিগন্যালের বাতি। ছবি: সাইফুল ইসলাম
এই সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিনের কাছে গেলে বিরক্তি প্রকাশ করে নিউজবাংলার কাছে পাল্টা প্রশ্ন রাখেন তিনি। বলেন, ‘আমার কাছে কে আসতে বলেছে? আমার রুম কে দেখিয়ে দিয়েছে?’
নিজেই জানতে এসেছি বলার পর কাজী বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘এটি দেখভালের দায়িত্ব বিদ্যুৎ বিভাগই নিয়েছে। আগে আমাদের দায়িত্বে থাকলেও এখন বিদ্যুৎ বিভাগই ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। আপনি সেখানকার প্রধান প্রকৌশলীর কাছে গেলে প্রকৃত তথ্য পাবেন।’
তার এমন তথ্যে এই প্রতিবেদক ফের সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) জাফর আহমেদের কাছে যান।
আপনার কাছেই নাকি প্রকৃত তথ্য- নিউজবাংলার এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে ভালো বলতে পারব না। আপনি আমার বিভাগের এক্স ইঞ্জিনিয়ার (এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার) মাহতাবের কাছে যান।’
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহতাব আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পুলিশকে দিয়ে দেয়ার অর্ডার হয়েছে। এটি এখন পুলিশ দেখছে। আমাদের কাছে নেই।’
পুলিশকে দায়িত্ব দেয়ার অর্ডারের কপি আপনাদের কাছে আছে কি না, জানতে চাইলে মাহতাব বলেন, ‘এ বিষয় আমি বলার কেউ না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাই না। ইতিমধ্যে আপনাদের কারণে দুই দফায় দুদকে (দুর্নীতি দমন কমিশন) হাজিরা দিয়েছি।
‘আমার নাকি কানাডায় বাড়ি আছে, জেলায় জেলায় সম্পদ গড়েছি। আমি ভাই আপনাদের সঙ্গে কথা বলব না। আপনি জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছেরের কাছে যান।’
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছেরের কাছে ট্রাফিক বাতির নিয়ন্ত্রণকারী কে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি সিটি করপোরেশনই দেখে।’
তাহলে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের এই ঠ্যালাঠেলির কারণ কী? জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
গাছের আড়ালে রাজধানীর আরেক ট্রাফিক সিগন্যালের বাতি। ছবি: সাইফুল ইসলাম
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ ও ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং- এই দুই বিভাগের কর্মকর্তাদের ঠ্যালাঠেলিতেই রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালের বাতি কখনো জ্বলে, কখনো নেভে। রাস্তার গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি ব্যবহার হয় না।
তারা আরও জানান, এই ট্রাফিক বাতির কেনাকাটা, নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় এটি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার কথাবার্তা চলছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এ জন্যই ট্রাফিক সিগন্যালের নিয়ন্ত্রণ, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কোনো বিভাগই নিতে চাইছে না। ফলে রাজধানীর বিভিন্ন ইন্টারসেকশনের ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিগুলো বিনা কারণে জ্বলে উঠছে। কোথাও একেবারেই অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের অধীনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। ২০০৯ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প শেষ হয় ২০১৯ সালের জুন মাসে।
এ প্রকল্পের আওতায় অত্যাধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপদে পথচারী চলাচল, জলাবন্ধতা নিরসন ও যানজট হ্রাস করার জন্য রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাতের উন্নয়ন, বিদ্যমান ট্রাফিক সিগন্যালের উন্নয়ন ও নতুন ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা।
এর আগে ২০০১-০২ অর্থবছরে ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যমান ৭০টি ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়। প্রকল্পটির আওতায় আরও ২৯টি ইন্টারসেকশনে নতুন ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়।
রাজধানীর একটি ট্রাফিক সিগন্যালের হলুদ ও লাল বাতি একসঙ্গে জ্বলে আছে। ছবি: সাইফুল ইসলাম
নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের অতিরিক্ত বরাদ্দের (অ্যাডিশনাল ফিন্যান্সিয়ালের) আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা মহানগরের ৪৩টি ইন্টারসেকশনে পুনরায় ট্রাফিক সিগন্যাল সচল করা হয়।
২০১৯ সালের জুনে কেইস প্রকল্প সমাপ্তির পর থেকেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকাভুক্ত ৫৩টি ইন্টারসেকশনে স্থাপিত ট্রাফিক সিগন্যালের স্থাপনাসমূহ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সে হিসেবে এখন বিদ্যুৎ বিভাগের আওতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অংশে বিদ্যমান ট্রাফিক সিগন্যালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা।
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্প চলাকালীন ট্রাফিক সিগন্যালগুলো সচল অবস্থায় থাকলেও প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরই নানা ত্রুটি ধরা পড়তে থাকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, প্রকল্পের আওতায় ঢাকা মহানগরের ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক সিগন্যাল উন্নয়নকাজ চলার সময় ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা ট্রাফিক সিগন্যালের কাজসমূহ বাস্তবায়নে সহযোগিতা এবং উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের পর সিগন্যালসমূহ সচল অবস্থায় কার্যকরের বিষয়ে মাঠপর্যায়ে তদারকি করেছেন।
তাদের ভাষ্য, কেইস প্রকল্প বাস্তবায়নকালে প্রকল্পের আওতায় কেনা রিমোট কন্ট্রোলগুলো মাঠপর্যায়ে পরিচালনার জন্য ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে রিমোট কন্ট্রোলগুলো ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
রাজধানীর একটি ট্রাফিক সিগন্যালের কোনো বাতিই জ্বলছে না: ছবি সাইফুল ইসলাম
ট্রাফিক পুলিশের ভাষ্য
ট্রাফিক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সিটি করপোরেশন। তাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়ার কথাবার্তা চললেও ডিএমপির ট্রাফিক কারিগরি ইউনিট গঠিত না হওয়ায় এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না পাওয়ায় রাস্তার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ ম্যানুয়ালি করা হচ্ছে।
কেইস প্রকল্পের আওতায় পুলিশের তদারকিতে কিংবা পুলিশকে বুঝিয়ে দেয়ার যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে, তা মোটেও ঠিক নয়। কারণ, প্রকল্পের অধীনে মাঠপর্যায়ের পুলিশের কাছে যেসব রিমোট কন্ট্রোল দেয়া হয়েছিল, তার সবই নষ্ট ছিল। এ কারণেই প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, ট্রাফিক বাতিতে না চলে ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণের ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছিল, কেন ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে?
সে বিষয়েও তারা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জবাব দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত সিদ্ধান্তেই সড়কের অটোমেটিক ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের ভার পুলিশের কাছে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির নিয়ন্ত্রণ সিটি করপোরেশনের হাতে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে তাদের কেইস প্রজেক্টের আওতায় কিছু রিমোট কন্ট্রোল পরীক্ষামূলকভাবে আমাদের হাতে দিয়েছিল। দেয়ার দু-এক দিন পর থেকেই সুইচ অপারেট করতে গেলে আর চলেনি। কোথাও দুই দিন, কোথাও তিন দিন, কোথাও সর্বোচ্চ সাত দিন চলেছে। তারপর আর সেগুলো কাজ করেনি। রিমোটগুলো আমাদের হাতে দিলেও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি তো তাদের হাতে ছিল।’
রাজধানীর একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল। ছবি: সাইফুল ইসলাম
সে জন্য সেগুলো ফেরত দিতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে আবার কোভিড শুরু হয়ে গেল। পরে একটা গ্যাপ হয়ে গেল। প্রজেক্টের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বিষয়টি আর আমাদের কাছে পুরোপুরি বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। আমরাও বুঝে পাইনি।
‘কোভিড আসায় গ্যাপ হয়ে যাওয়ায় আগের ম্যানুয়াল সিস্টেমেই ফিরে যেতে হয়েছে। বাই দিস টাইম কিছু কিছু সিগন্যাল চালু করা হয়েছিল। কিছু কিছু সিগন্যাল একেবারেই অকার্যকর ছিল। কিছু কিছু জায়গায় সব বাতিই জ্বলে। অনিয়ন্ত্রিত সিস্টেমের জন্যই এমন হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রিমোট কন্ট্রোল ফেল করাতে সিগন্যাল বাতি ওন মেকানিজমে (একাই জ্বলে ওঠে, আবার একাই নিভে যায়) কাজ করছে। মেশিনের ত্রুটির কারণেই কোথাও তিনটি, কোথাও একটি বা দুটি বাতি জ্বলে থাকে। এ রকম বিবিধ সমস্যা আছে।
‘যেহেতু সমস্যা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম, সে জন্য বৃহত্তর স্বার্থে আমরা ম্যানুয়াল সিস্টেম চালু করেছি।’
এখন সিটি করপোরেশন ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হয়েছে জানিয়ে ট্রাফিক বিভাগের শীর্ষ এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের একটা কারিগরি টিম তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের কাজ এগিয়েও গেছে। আমাদের কারিগরি টিম পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত হওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে সিটি করপোরেশনের কারিগরি টিম আমাদের পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর অটোমেটিক সিস্টেমে যেতে পারব। এ জন্য সময় লাগবে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওরা ঠিক করে, আবার নষ্ট হয়। ওরা যেসব জিনিসপত্র আনে, আমার ধারণা সেগুলো বেটার কোয়ালিটির আনলে এই সমস্যা হতো না। মানুষ আরও বেশি উপকার পেতেন।
‘আমি আসলে জানি না। ওরা যেসব জিনিস আনে, সেগুলো সাসটেইন করতে পারে না, এগুলো পার্টসের সমস্যা, নাকি তাদের সিস্টেমের সমস্যা, কোনো না কোনো একটা সমস্যা আছেই।’