পোশাকশ্রমিক মো. আজহার। আরবি পড়েন ইমাম আবদুর রহমানের কাছে। সেই সুবাদে পরিবারে যাতায়াত।
এর মধ্যে স্ত্রী আসমা আক্তারের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে দুই সন্তানের জনক ইমাম আব্দুর রহমানের। টের পেয়ে যান আজহার। ইমামের সঙ্গে করেন রাগারাগি। বলেন, আর বাসায় যেন তিনি না যান।
হঠাৎ করেই ১৯ মে থেকে নিখোঁজ আজহার। স্ত্রী কিছু জানাননি পুলিশকে। তবে ভাই জানান র্যাবকে।
২৫ মে খোলাসা হয় অনেক কিছু। মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ার পর ঘটনাস্থলে আসে র্যাব। ট্যাংক খুলে দেখা যায়, টুকরা টুকরা মরদেহ। সব মিলিয়ে ছয়টি।
আজহারকে খুন করে ছয় টুকরা করে সেখানে ফেলা হয়।
এর মধ্যে ইমাম আবদুর রহমান ও আজহারের স্ত্রী আসমার মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার তথ্য জানে র্যাব। দুজনের ফোনে কথোপকথনও খতিয়ে দেখে তারা। আর এতেই হত্যারহস্য উঠে আসার কথা জানিয়েছে বাহিনীটি।
র্যাব জানায়, রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগে আজহারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আসমা ও ইমাম আবদুর রহমান। কিন্তু আজহার অসুস্থ হওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সুস্থ হওয়ার পর চলে আসে ঈদ। আজহার সে সময় স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে।
ঈদের পর অনেকটা জোর করে আজহারকে ঢাকায় পাঠান আসমা। আর ফেরার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী মসজিদে ডেকে নিয়ে তাকে হত্যা করেন ইমাম আবদুর রহমান।
দুজনকেই গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তাদের নেয়া হয়েছে রিমান্ডেও।
যেভাবে পরিকল্পনা
তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য গণমাধ্যমকে জানাতে বুধবার র্যাব সদরদপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করেন বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ‘মার্চের শেষের দিকে ভুক্তভোগীর স্ত্রী ও মসজিদের ইমাম দুজনে মিলে আজহারুলকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে তারা সিদ্ধান্ত নেন ভাড়াটে খুনির মাধ্যমে বা অন্য কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে আজহারুলকে হত্যা করবেন। পরে আসমা পরামর্শ দেন হত্যার ঘটনাটি যেন ইমামের রুমে করা হয়।’
হত্যার পরিকল্পনা করতে আলাপ-আলোচনার জন্য মক্তবের এক ছাত্রের নামে একটি সিমকার্ড ও একটি মোবাইল ফোন আসমাকে দেন ইমাম। এর মাধ্যমে তাদের নিয়মিত সলাপরামর্শ চলে।
র্যাব পরিচালক মঈন বলেন, ‘রমজান মাসের ৭ দিন আগে আজহারুলকে তারা হত্যার পরিকল্পনা করেন। এ সময় আজহারুল কলেরা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তাদের হত্যার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
‘ওই সময় হাসপাতলে ভর্তি ছিলেন আজহারুল। আজহার সুস্থ হলে ঈদের আগের দিন তারা টাঙ্গাইলের কালিহাতী গ্রামের বাড়ি চলে যান। সেখানেও নিয়মিত আসমা আক্তারের সঙ্গে আবদুর রহমানের যোগাযোগ চলছিল।
‘পরে আসমা আক্তার ইমামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে সলাপরামর্শ করে গত ১৮ মে অনেকটা প্ররোচনা দিয়ে আজহারুলকে ঢাকায় পাঠান। পরদিন আজহারুলকে ফোন করে মসজিদে আসার জন্য বলেন ইমাম।”
খুন যেভাবে
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আজহারুল কাজ শেষে গার্মেন্টস থেকে সরাসরি ইমামের সঙ্গে দেখা করতে এশার নামাজের সময় মসজিদে যান। তখন ইমাম তাকে বলেন, ‘তুমি আমার কক্ষে বিশ্রাম নাও। নামাজ শেষ করে আমি আসছি’।
‘তখন আজহারুল ইমামের কক্ষে গিয়ে বিশ্রাম নেন। সারা দিন কাজের ফলে ক্লান্ত থাকায় সে ঘুম ঘুম অনুভব করতে থাকেন।
‘ওই সময়টি কাজে লাগান ইমাম আবদুর রহমান। কাছে থাকা কোরবানির পশু জবাইয়ের ছুরি দিয়ে আজহারুলকে আঘাত করতে যান। ভুক্তভোগীও টের পেয়ে যান। এতে তাদের দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। আজহারুল ইমামের কক্ষ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সিঁড়িতে পড়ে যান।
ইমাম তখনই তার গলার ডান দিকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। মারা গেলে তিনি মরদেহ টেনেহিঁচড়ে তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে ওই ছুরি-চাপাতি দিয়ে মরদেহ ছয় খণ্ডে খণ্ডিত করেন।’
‘এরপর খণ্ড করা মরদেহ নিয়ে ব্যাগে ভরে দক্ষিণখানের সরদারবাড়ি জামে মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেন এবং ওই ট্যাংকের মুখটি সিমেন্টের বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখেন’- বলেন র্যাব পরিচালক।
খুন করে মসজিদ ত্যাগ ইমামের
ঘটনার পর থেকে মসজিদের ওই কক্ষে অবস্থান না করে ইমাম আবদুর রহমান পাশের ঢাকা মাদ্রাসায় অবস্থান নেন।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, ২৫ মে এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের জানান, সিঁড়ির মধ্যে রক্তের দাগ ছিল এবং সেপটিক ট্যাংক থেকে প্রচুর দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। পরে র্যাব ছায়া তদন্ত করে এবং আজহারুলের নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পারে।
অধিকতর তদন্ত করে ইমামকে গ্রেপ্তার করে এবং তার দেখানো ওই সেপটিক ট্যাংক থেকে আজহারের মরদেহের খণ্ডিত অংশগুলো উদ্ধার করে। আর তার তথ্যে গ্রেপ্তার করা হয় আসমাকে।
খুন করে আসমাকে ফোন
র্যাব কর্মকর্তা জানান, হত্যার আগে এবং পরে মসজিদের ইমাম আবদুর রহমান মোবাইল ফোনে আসমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই হত্যা কীভাবে করা হয়েছে, সে বিষয়টি তাকে জানান।
জিজ্ঞাসাবাদে ইমাম রহমান র্যাবকে জানান, আজহারকে হত্যার জন্য আগে থেকেই একটি চাপাতি ও একটি ছুরি তার কক্ষে এনে রেখেছিলেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, আজহারুল ছিলেন আসমার তৃতীয় স্বামী। তিনি ২০১৫ সালে আজহারুলের বড় ভাইকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন। পরে আসমার সঙ্গে আজহারুলের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর তারা পালিয়ে বিয়ে করেন।
তিনি বলেন, আসমাই হত্যার পরিকল্পনা ও প্ররোচনা দেন। তিনি বলতেন, আজহারুলকে খুন করলে তিনি ইমাম আবদুর রহমানকে বিয়ে করবেন।
ইমামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।