বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

স্কুলের প্রধান শিক্ষক এখন চা বিক্রেতা

  •    
  • ২৩ মে, ২০২১ ১৯:২৫

লন্ড্রির দোকান দেয়ায় আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতরা ‘নানা কথা’ বললেও তাতে এখন আর কিছু যায়-আসে না নিজাম উদ্দিনের। তিনি বলেন, ‘লন্ড্রির দোকান দিয়েছি বলে আত্মীয়স্বজন আর পরিচিত মানুষ অনেক রকম কথা বলে। আগে লজ্জা পেতাম। এখন আর পাই না। লজ্জা পেলে তো আর আমার জীবন চলবে না।’

মোহাম্মাদ নিজাম উদ্দিন। রাজধানীর দুটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক তিনি। গত বছরের শুরু দিকেও দুটি স্কুলের ৬০০ ছাত্রছাত্রী ও ৩০ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে বেশ ভালোই সময় কাটাচ্ছিলেন তিনি।

তবে করোনা মহামারির কারণে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো তার দুটি স্কুলও বন্ধ রয়েছে প্রায় ১৪ মাস ধরে। স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন এখন তার কাছে অতীত। করোনা আসলেই তাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই এখন তার একমাত্র সংগ্রাম।

এই জীবনসংগ্রামে টিকতে না পারলে গ্রামে ফিরে যাওয়ার চিন্তায় আছেন তিনি, যদিও এই স্কুলের জন্যই গ্রামের শেষ সম্বলও খুইয়ে বসে আছেন।

নিজাম উদ্দিন ২০০৩ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবরে স্থাপন করেন আঞ্জুমান রেসি. মডেল স্কুল। আর ২০১২ সালে গাবতলীতে দেন ইউিএনবি মডেল স্কুল। দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই প্রধান শিক্ষক তিনি।

করোনা মহামারিতে স্কুল দুটি বন্ধ হয়ে গেলে প্রথমে ধার করে কিছুদিন চললেও একটা পর্যায়ে তাকে আর কেউ সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি। সুদের বিনিময়ে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করেও সফল হননি। এমন পরিস্থিতিতে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২৮ জন শিক্ষক ও দুই কর্মচারীর বেতন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। বাধ্য হন নিজের ভাড়া বাসা ছেড়ে পরিবার নিয়ে আঞ্জুমান স্কুলের দুটি কক্ষে উঠতে।

নিজাম উদ্দিনের দোকান। ছবি: নিউজবাংলা

কিন্তু সংসার চলবে কীভাবে? সেই দুশ্চিন্তা থেকে গত বছরের মে মাসে স্কুলের পাশেই ছোট একটি দোকান ভাড়া নেন। নাম দেন সততা লন্ড্রি। কিন্তু শুধু লন্ড্রির কাজ করে সংসার চালাতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে সেই লন্ড্রির দোকানেই তোলেন অল্প করে চাল-ডাল, বিস্কুট-চানাচুরের মতো পণ্য। এতেও কাজ না হওয়ায় সর্বশেষ এই রমজান মাসের শুরুতে সেই সততা লন্ড্রিতেই চা বিক্রি শুরু করেন এই শিক্ষক।

কেমন চলছে দিনকাল- জানতে চাইলে নিজাম উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনোরকম দুবেলা খেয়ে বেঁচে আছি ভাই। জানি না আর কত দিন বাঁচতে পারব! এখনো প্রতি মাসেই ধারদেনা করতে হয়। তবে অনেকেই এখন আর ধার দিতে চায় না।’

তিনি জানান, দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন এবং লন্ড্রির দোকানের ভাড়া মাসে মোট ৪০ হাজার টাকা। দোকান থেকে আয় হয় ১০-১৫ হাজার টাকা। দোকান খরচ ৪ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মাসে ৩০ হাজার টাকা ঘাটতি থাকে।

নিজের লন্ড্রির দোকানে কাজ করছেন নিজাম উদ্দিন। ছবি: নিউজবাংলা

নিজাম উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিকে থাকার জন্য ভাড়াবাসা ছেড়ে দিয়ে স্কুলেরই দুই রুমে পরিবার নিয়ে উঠে পড়েছি। আগামী জুন-জুলাই মাস পর্যন্ত দেখব। তারপর সব ছেড়ে রংপুরে গ্রামে চলে যাব ভাবছি।’

কন্নাজড়িত কণ্ঠে এই শিক্ষক বলেন, ‘আমার কথা না-ইবা বললাম। এই ঈদে ছেলেমেয়েকে কিছু দিতে পারিনি, ভাই। এমনকি ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতেও পরি না। এমনও দিন গেছে দুই কেজি চালও কিনতে পারিনি।

‘আমরা খাই আর না খাই প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। অথচ আমার এই দোকানে প্রতি মাসে আয় হয় মাত্র ১০-১৫ হাজার টাকা, যা দিয়ে কোনো রকম সংসার চলে।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির জন্য গত এক বছরে গ্রামের বাড়ির শেষ সম্বলও খুইয়েছেন নিজাম উদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে গ্রামে আমার নামে থাকা সব সম্পদ বিক্রি করা শেষ। ঢাকার দুই স্কুলভবনের মালিকই অন্য রকম মানুষ। তারা ভালো বলে গত পাঁচ-ছয় মাস ভাড়া নেননি। স্কুল খুললে সব দিয়ে দেব বলে কথা দিয়েছি। তারাও আপত্তি করেননি।

‘দুই-আড়াই লাখ টাকা দেনা হয়ে গেছি। এই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চলছি। ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছি, ভাই।’

লন্ড্রির দোকান দেয়ায় আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতরা ‘নানা কথা’ বললেও তাতে এখন আর কিছু যায়-আসে না নিজাম উদ্দিনের। সবকিছু আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।

নিজের লন্ড্রির দোকানের সামনে নিজাম উদ্দিন। ছবি: নিউজবাংলা

তিনি বলেন, ‘লন্ড্রির দোকান দিয়েছি বলে আত্মীয়স্বজন আর পরিচিত মানুষ অনেক রকম কথা বলে। আগে লজ্জা পেতাম। এখন আর পাই না। লজ্জা পেলে তো আর আমার জীবন চলবে না।

‘প্রথমে লন্ড্রির দোকান দিলাম। সেখান থেকে ৫-৭ হাজার আয় হতো। পরে দোকানে ছোট পরিসরে মুদিখানার মাল উঠালাম। তাতেও চলে না। তাই কয়েক মাস আগে দোকানের সামনে চা বানানোর টেবিল বসিয়েছি। এখন দেখি আর কত দিন চালাতে পারি। এখন সব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছি।’

নিজাম উদ্দিন তার কষ্টের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘এমনও দিন গেছে টাকার অভাবে ডাক্তারের কাছে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারিনি। তবে ছেলেমেয়ে এখন একটু বোঝে। তাই তারাও আর বেশি আবদার করে না। মেয়ের বয়স ১৪ বছর। আর ছেলের ৩ বছর। ছেলে মাঝে মাঝে দোকানে এসে এটা-ওটা আবদার করে। চকলেট বা বিস্কুট হাতে দিলে আর কিছু বলে না। চুপচাপ চলে যায়।’

জানুয়ারি মাসে স্কুল খুলতে পারে- এমন খবরে সুদিনের আশায় নিজাম উদ্দিন দুই লাখ টাকার বেশি খরচ করেন প্রায় বছর ধরে পড়ে থাকা স্কুল দুটিতে। এই দুই লাখ টাকা তিনি জোগাড় করেন সুদ দেয়ার শর্তে। এটাই এখন তার গলার কাঁটা হয়ে বিঁধছে।

নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে জানুয়ারি মাসে। ওই সময় শুনলাম সরকার স্কুলগুলো খুলে দেবে। এ কারণে দুই লাখ টাকা ধার করে স্কুল সংস্কার করে খোলার প্রস্তুতি নিলাম। পরে তো আর স্কুল খুলল না। এই ধকল এখন আর কাটিয়ে উঠতে পারছি না।’

এ বিভাগের আরো খবর