ক্ষেতে ক্ষেতে ব্যস্ত পাটচাষিরা। একদিকে চলছে পাট কাটা, আরেকদিকে জাগ দিয়ে চলছে আঁশ ছাড়ানোর কাজ। আইলের দুপাশে সবুজ, আর চাষিদের উঠানে সোনালি কাঠির ছড়াছড়ি।
ফলন ভালো হওয়ায় দিনভর কাজ করেও ক্লান্তি ছাপিয়ে কৃষকদের চোখেমুখে স্বস্তির ছাপ। বিভিন্ন জেলার পাটক্ষেতে হাসিমুখে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এবার ৮ থেকে সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। আর এ থেকে মোটামুটি ৯০ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মাদারীপুর
এরই মধ্যে মাদারীপুরের শিবচরে পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলার কৃষি বিভাগ।
শিবচরের পাটচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও সোনালি আঁশ থেকে লাভ মিলত না। অনেকে পাট ছেড়ে অন্য ফসল চাষ শুরু করেন। যারা আবাদ ধরে রেখেছিলেন, তারা এখন লাভবান হয়েছেন। তাদের দেখেই আবারও পাট চাষে ফিরতে শুরু করেছেন কেউ কেউ।
উপজেলার বাশকান্দি গ্রামের চাষি ছালাম ফকির জানান, এবার তিন বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। গত বছর দাম ভালো পাওয়ায় এ মৌসুমের শুরুতে অনেকেই পাটচাষ শুরু করেন। এতে আবাদও বেড়েছে, অনুকূল আবহাওয়ায় ফলনও ভালো হয়েছে।
মুর্জারচর এলাকার জাকির বেপারী বলেন, ফরিদপুর থেকে সার, বীজ এনে ও অন্যান্য সব খরচ মিলিয়ে এক মন পাট উৎপাদনে লেগেছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। দাম ভালো পেলে খরচ মিটিয়ে লাভই হবে।
কাদিরপুর এলাকার কৃষক মোন্তাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার দাদার আমল থেকে আমরা ধান পাট চাষ করি। প্রায় ৫০ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। দাম যাই হোক এ ছাড়া তো আমাদের উপায় নেই। তবে সব বছরের চেয়ে এবার পাটের দাম ভালো।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অনুপম রায় জানান, উপজেলায় চলতি বছর ৩৪ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে যা গতবারের চেয়ে ৪০০ হেক্টর বেশি। বাম্পার ফলনই হয়েছে।
ঝিনাইদহ
এ মৌসুমে ঝিনাইদহের ৬ উপজেলায় ২২ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে বলে জানিয়েছে এই জেলার কৃষি বিভাগ। চাষিরা বলছেন, দামও ভালো পাচ্ছেন তারা।
শৈলকুপা, লাঙ্গলবাদ ও ভাটই উপজেলার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি মণ পাট প্রকারভেদে ২৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
শৈলকুপার উত্তর মির্জাপুর গ্রামের চাষি শাহিন আলী বলেন, ‘আমি এবার দুই বিঘে জমিতে পাট বুনিছিলাম। একুন এক বিগে জমির পাট কাটে জাগ দিয়ে ধুয়ে শুকায়ছি। কালকে হাটে ৫ মণ পাট নিয়ে গিছিলাম। ২৯০০ টাকা করে বিক্রি করিছি। দাম মোটামুটি ভালোই আছে। আর একটু বাড়লি লাভটা ভালো হতো।’
উপজেলার খন্দকবাড়ি গ্রামের কৃষক আকরাম হোসেন বলেন, ‘এবার তিন বিঘে জমিতে পাটের আবাদ করিচি। এক বিঘা জমিতের পাট বুনার আগে জমি চাষ, সার দেয়া, বীজ কিনা, বীজ বুনার পর সেচ দেয়া, নিড়ানী দেয়া, পাট কাটা, টেনে জাগ দেয়া আর ধুয়ে শুকোনা পর্যন্ত মনে করেন ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
‘এবার গড়ে ১০ থেকে ১২ মণ পাটের আবাদ হইছে। হাটে আগে সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে বিক্রি হইছে। এখন ৩ হাজার করে বিক্রি হচ্ছে। গড়ে ৩ হাজার টাকা করে দাম ধরে ১০ মণ হারে পাট হলি ৩০ হাজার টাকা হয়। এতে মনে করেন ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা লাভ। তারপরও পাটকাটি তো থাকছেই। এক বিঘা জমিতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার পাটকাঠি হয়। এবার দামডা ভালো হওয়ার কারণে লাভই হইচে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আজগর আলী জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকা আর পরিচর্যা ভালো হওয়ায় এবার কৃষক পাটের ভালো ফলন পেয়েছে। এতে আরও কৃষকরা অনুপ্রাণিত হবে; আগামীতে পাটের আবাদ বাড়বে।
মাগুরা
পাট জাগ দেয়া পচা মাটি ও কাঁদার গন্ধ ছড়িয়ে আছে মাগুরার ক্ষেতগুলোতে। সরু রাস্তার দুপাশে সোনালী পাট, বাঁশের উপর ঝুলিয়ে রাখার দৃশ্য এখন প্রতিদিনকারই। নদী, খালে, বিলে ডুব পানিতে পাটের আঁশ ছাড়াতে ব্যস্ত কৃষকরা।
তবে এ জেলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, যে অনুপাতে পাটের ফলন, সে পরিমাণ আঁশ বাজারে আসছে না। তাদের অভিযোগ, কৃষকের ঘরে সোনালী আঁশ ভর্তি থাকলেও দাম বেশি পাওয়ার জন্য তারা হাট-বাজারে তা বিক্রি করছেন না। এ কারণে ভরা মৌসুমেও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মুখ মলিন।
মাগুরা সদরের রাওতড়া গ্রামের চাষি নাজমুল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, গত বছর পাটের দাম মণপ্রতি ৫ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা উঠেছে। তখন প্রথম দিকে মাত্র আড়াই হাজার টাকা ছিল।
তিনি বলেন, ‘যে জন্য এবার আমি পাট শুকিয়ে বাড়ি রেখে দিয়েছি। আরো দুসপ্তাহ দাম দেখব তারপর বেচতি যাব... এ মৌসুমে তিন একর জমিতে পাটচাষ করেছি। ফলনও খুব ভালো হয়েছে। জমি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ মণ পাট পেয়েছি।’
রামনগর গ্রামের কৃষক আনোয়ার মোল্লা বলেন, ‘চার একর জমিতে এবার পাট চাষ করিছি। গতবার পাটের দাম বেশি পাইছি, তাই এবারও আশা করছি ভাল দাম পাব... এ সপ্তাহে পাটের কেনাবেচা ভালো না দেখছি... মাগুরা নতুন বাজার পাইকারি মহাজনরা দাম কম দিচ্ছেন। তাই পাট ছাড়তেছি না। দু সপ্তাহ দেখব।’
মাগুরায় পাটের সবচেয়ে বড় হাট আলমখালী বাজার। সদর উপজেলার এ হাটে পাইকারি বাজারের গুদাম ভরা মৌসুমেও ফাঁকা।
পাট মাপার দাড়িপাল্লা নিয়ে অলস বসে থাকতে দেখা গেছে গুদামমালিকদের। এমনই একজন আব্দুর রহিম। নিউজবাংলাকে তিনি জানান, কৃষক বেশি দামের আশায় সময় গুনছে। তাই পাট বাড়ি থেকে বের করছে না। এভাবে পাট বাড়ি রেখে দিলে দাম যে বাড়বে না, তা চাষিরা বুঝছেন না।
পাইকারী ব্যবসায়ী সদরের গাঙনালীয়া বাজারের আকরাম মিয়া বলেন, ‘পাটের ফলন খুবই ভাল দেখেছি। দাম আমরা ভালই দিচ্ছি। তবে যে পরিমান পাট হাটে বিক্রি হবার কথা, তার এক তৃতীয়াংশ পাট হাটে আসছে না।
‘পাটের দাম বাড়বে এটা আগেই বলা যায় না। পাটের প্রকার ও গুণগত মান বুঝে দাম উঠানামা করে। দুই যুগের বেশি ধরে পাটের ব্যবসা করছি। কৃষক বাড়িতে পাট রেখে দিলে বর্তমান আবহাওয়ায় পাটের মান খারাপ হবার সম্ভাবনা আছে। এতে কৃষকের লাভের থেকে ক্ষতি হতে পারে।’
মাগুরা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলার সদর, মহম্মদপুর, শ্রীপুর ও শালিখায় ৩৫ হাজার ৮৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। এ মৌসুমে নতুন পাট প্রতিমণ ৩৪০০ টাকা থেকে ৩৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে হাট-বাজারে পাট তেমন দেখা যাচ্ছে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার প্রামাণিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অধিক জমিতে পাটচাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগ প্রশিক্ষণ, পরামর্শসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করায় সঠিকভাবে পাটচাষ সম্পন্ন করতে পেরেছেন কৃষকরা। ফলে ফলনও হয়েছে কয়েকগুন।
‘পাট বপনের সময় একটু পানির সংকট ছিল। কিন্তু পাট বড় হওয়া থেকে শুরু করে পানিতে জাগ দেয়া পর্যন্ত সময়টা খুব জরুরি। এ সময়পর্যাপ্ত পানি পেলে পাটের মান ভালো হয়। এবার বৃষ্টিতে পানি পর্যাপ্ত থাকায় আশা করছি পাটের মান অনুযায়ী দাম ভাল পাবে কৃষক।’
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। মাঝে তা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা বাড়ায় ২০১০-১৫ সাল নাগাদ চাষের এলাকা বেড়ে ৭ লাখ হেক্টরে পৌঁছায়। এরপর থেকে তা আরও বাড়ছে।
আগে ১২ লাখ হেক্টর এলাকা থেকে যে পরিমাণ পাট পাওয়া যেত, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এখন ৭-৮ লাখ হেক্টর জমি থেকেই তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানান।
সরকারি হিসাবে পাটচাষির সংখ্যা ৫০ লাখ হলেও কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ পাট চাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া, যেমন প্রক্রিয়াজাতকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, পরিবহন/স্থানান্তর ও বিপণনের মতো কাজে যুক্ত।
আঁশ ছাড়ানোর পর পাওয়া পাটকাঠি গ্রামে জ্বালানির প্রধান উৎস; পাটচাষ কমে গেলে পাটকাঠি না পেয়ে বৃক্ষ নিধনের প্রবণতা বাড়তে পারে, যা পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।
কৃষিবিদরা বলছেন, পাট চাষ কৃষকদের অন্য পেশায় বা অন্য স্থানে পেশার তাগিদে উপার্জনের জন্য স্থানান্তর কমাতেও ভূমিকা রাখে।