সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নের দাতিনাখালি গ্রামের বাসিন্দা মাহবুবুর সানা। বাবা শাহ আলম সানার হাত ধরে তার সুন্দরবনে যাওয়া। মাছ ও কাঁকড়া ধরে ভালোই চলছিল সংসার। তাতে ছন্দপতন ঘটিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি নিষেধাজ্ঞা।
খুলনা বিভাগীয় বনসংরক্ষক ও সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষককে পাঠানো এক চিঠিতে মন্ত্রণালয় জানায়, ২০ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের নদ-নদীতে কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখতে হবে।
এর আগে প্রজনন মৌসুম ও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরতে যেতে পারেনি জেলেরা।
এসব নিষেধাজ্ঞার জালে আটকে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে সানার মতো অনেক জেলের।
সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরার ওপর নির্ভরশীল সাতক্ষীরার শ্যামনগরের পাঁচ হাজারের বেশি পরিবার। এসব পরিবারের জেলেদের ধরা কাঁকড়া যায় চীন, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে।
রপ্তানি বৃদ্ধির সঙ্গে দাম বাড়ায় সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার বুড়িগোয়ালিনি, দাতিনাখালি, কলবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জসহ কয়েক জায়গায় কাঁকড়ার হ্যাচারি গড়ে ওঠেছে। এসব হ্যাচারিতে নরম খোলসের কাঁকড়া শক্ত করা হয়।
শ্যামনগরের দাতিনাখালি গ্রামের মাহবুবুর সানা জানান, নিষেধাজ্ঞা থাকায় অনেক সময় চুরি করে বনে ঢুকে কাঁকড়া ধরছেন।
একই গ্রামের বারেক গাজীর পাঁচ সদস্যের সংসার। ৪০ বছর আগে বাবার সঙ্গে প্রথম কাঁকড়া ধরতে যান। বাবা মারা গেছেন ২২ বছর আগে। এখনও সেই পেশাতেই আছেন।
বারেক জানান, তিনি তার মহাজনের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেন। বন থেকে কাঁকড়া ধরে এনে বিক্রি করে শোধ করেন মহাজনের পাওনা টাকা। কয়েক মাস ধরে সরকার কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখায় মহাজন কোনো টাকা দিচ্ছেন না।
তিনি জানান, এভাবে সংসার চালাতে পারছেন না। আর কোনো উপায় না পেয়ে এক দিন হয়তো আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পেশা ছেড়ে শহরে রিকশা চালাতে হবে।
বুড়িগোয়ালিনি গ্রামের সামছুর ঢালী ৩০ বছর ধরে সুন্দরবনের নদী থেকে কাঁকড়া ধরেন।
তিনি জানান, সমিতি থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। এখন সংসারই চালাতে পারছেন না। কিস্তি আদায়কারীদের কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে সংসার ফেলে পালানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
কেমন আছেন খামারি-ব্যবসায়ীরা
শুধু কাঁকড়া শিকারিরাই নন, দুর্ভোগে খামারি, ব্যবসায়ীরাও।
কলবাড়ি বাজারের আড়তদার দাতিনাখালি গ্রামের মনিরুল তরফদার জানান, জেলেরা কয়েক মাস ধরে কাঁকড়া ধরতে না পারায় তার ব্যবসা বন্ধের পথে। তার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত সাত বছরের মেয়েকে তিন মাস পর পর রক্ত দিতে হয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তাকে রক্ত দেয়া হয়েছে। পরেরবারের টাকা এখনও জোগাড় করতে পারেননি।
বুড়িগোয়ালিনির হ্যাচারি মালিক কামাল হোসেন জানান, চার বছর ধরে হ্যাচারিতে কাঁকড়া চাষ করছেন। কাঁকড়া আহরণ ও বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুই লক্ষাধিক মানুষের ভাগ্য জড়িত। এতদিন ধরে কাঁকড়ার পাস বন্ধ থাকায় তার হ্যাচারিতে কর্মচারীদের কোনো কাজ নেই। একই অবস্থা অন্য হ্যাচারিগুলোতে।
তিনি আরও জানান, তিন মাস পরপর কাঁকড়া মারা যায়। তা ছাড়া কাঁকড়া ধরলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সরকারের ফের বিবেচনা করা উচিত।
বুড়িগোয়ালিনির অ্যাকোয়া ম্যাক্স সি ফুড নামের কাঁকড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ দোকানের মালিক শহীদুল ইসলাম জানান, সাড়ে পাঁচ বছর আগে চার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কাঁকড়া রপ্তানি শুরু করেন। ব্যবসা ভালোই চলছিল।
করোনায় নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হলেও প্রচুর অর্ডার পেয়েছেন। নিষেধাজ্ঞায় এতদিন কাঁকড়া ধরা বন্ধ থাকায় পড়েছেন বিপাকে।
বন বিভাগ-প্রশাসনের ভাষ্য
বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কর্মকর্তারা জানান, সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য পাঁচটি স্টেশন থেকে প্রতি বছর ২ হাজার ৯০০টি অনুমতিপত্র ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে শুধু কাঁকড়ার পাস ইস্যু হয় প্রায় ১ হাজার ৭০০টি। এক সপ্তাহ মেয়াদি এসব পাসের জন্য সরকারি ফান্ডে দিতে হয় ৩৫০ টাকা করে।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক এম এ হাসান নিউজবাংলাকে জানান, বনবিভাগের গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস সুন্দরবনে বিচরণকারী পশু-পাখির প্রজনন মৌসুম। বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও বংশ বিস্তারের স্বার্থে এ বছর প্রথমবারের মতো পর্যটক ও বননির্ভর পেশাজীবীদের প্রবেশ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত রাখা হয়েছে।
এ কারণে সুন্দরবনের বনজীবীদের এখন কোনো পাস ইস্যু করা হচ্ছে না। সেপ্টেম্বর থেকে আবারও পাস দেয়া হবে।
বুড়িগোয়ালিনি স্টেশনের সহকারী বন কর্মকর্তা এস এম সুলতান আহমেদ জানান, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তারা পাস দেয়া বন্ধ রেখেছেন। পাস বন্ধ থাকার কারণে প্রতিটি জেলেকে ৪০ কেজি করে চাল দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জেলা প্রশাসককে (ডিসি) এ সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হবে।
সাতক্ষীরার ডিসি হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিষয়টি জানা নেই। বনবিভাগের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’