বর্ষায় টলমলে পুকুর। পাড়ে কাছে মাচায় ঝুলছে তরমুজ। সেগুলো প্রায় ছুঁয়ে ফেলছে পুকুরের পানি।
এ পুকুরের উপর মাচায় তরমুজের এই চাষ দেখা গেছে বরগুনা সদরের কালিরতবক গ্রামে। অসময়ে তরমুজ, তাও আবার মাচায়; বিষয়টি জেলায় বেশ সাড়া ফেলেছে। আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন প্রতিদিনই এই দৃশ্য দেখতে আসছেন।
পুকুরটি আবদুল মান্নানের। দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি গত এপ্রিলে ইউটিউব দেখে এভাবে তরমুজ চাষ শুরু করেন।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা যায়, দেশে তরমুজ চাষের মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এর জন্য বীজ বোনার উপযুক্ত সময় ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে। সেখানে মৌসুম শেষে তরমুজের বীজ রোপন করেও ফল পেলেন আবদুল মান্নান।
মান্নানের বড় ছেলে আবদুল আলীমের আছে হ্যাচারির ব্যবসা। বাড়ির ওই পুকুরে মাছের ঘেরও গড়েছেন তিনি। আর ছোট ছেলে বনি আমিন পরিবহণ শ্রমিক। এবার মৌসুমে তরমুজ পরিবহন করতে করতে এটি চাষ করার আগ্রহ জাগে তার।
নিউজবাংলাকে বনি জানান, তরমুজ চাষের পদ্ধতি ইউটিউবে ঘাঁটতে গিয়ে মাচায় চাষের কৌশল শেখেন তিনি। এরপর বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে নেমে যান কাজে। গত এপ্রিলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ নিয়ে পুকুরে মাছের ঘেরের পাড়ে শুরু করেন বীজ বপন।
আবদুল আলীম জানান, ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ৮০ শতাংশ জমিতে তরমুজের আবাদ করেছিলেন। দুই মাসের মধ্যেই ফলন শুরু হয়। জুলাই মাসেই প্রায় দেড় হাজার তরমুজ বিক্রির উপযোগী হয়।
তিনি জানান, এত তরমুজ টানা বৃষ্টির কারণে বিক্রি করতে পারছিলেন না। স্থানীয় বাজারে নিলেও ক্রেতা মেলেনি। পরে স্থানীয় মৎস খামারী জাকির হোসেন মিরাজের পরামর্শে ফেসবুকে তারা এই তরমুজের প্রচার শুরু করেন।
মান্নান ও তার ছেলেরা জানান, ফেসবুকের মাধ্যমে এই তরমুজের খবর দ্রুতই ছড়িয়ে পরে বরগুনাবাসীদের কাছে। আসতে থাকে অর্ডার। আলিম ও বনি তরমুজ পৌঁছে দেন ক্রেতাদের বাড়িতে।
আলিম বলেন, ‘দেওই (বর্ষা) বৃষ্টির দিনে এইরহম যে পুহুইরের মইদ্দে জাহা (মাচান) দিয়া তরমুজ ফলান যায়, মোরা নিজেরাও বুজিনায় পেরথম (প্রথম)। চিন্তা হরছিলাম, দেহি লাগাইয়া, অইলেও অইতে পারে। এত তরমুজ ফলবে চিন্তাও হরিনায়। তরমুজ বেইচ্চা তিরিশ আজার (হাজার) টাহা খরচায় তিন লাক টাহার তরমুজ বেচতে পারমু মোরা।’
বনি আমিন জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে তাদের ‘বেঙ্গল টাইগার’, ‘কারিশমা’ ও ‘কানিয়া’ জাতের তরমুজ চাষের পরামর্শ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী এই তিন জাত রোপন করা হয়েছিল।
বনি বলেন, ‘২ হাজার ৭০০ টাহা দিয়া ৩০ গ্রাম বীজ কিনছিলাম। সেই থেকে ৫০০ গাছ হয়েছে। আর গাছে প্রায় দেড় হাজার তরমুজ ফলছে। তয় দেওইতে (বর্ষায়) অনেক তরমুজ নষ্ট অইয়া গ্যাছে। এহন পর্যন্ত দুই লাক টাহার তরমুজ বেচছি, আরও এক লাকটাহার বেচতে পারমু।’
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান গিয়েছিলেন মাচার তরমুজ দেখতে। তিনি জানান, মৌসুমের তরমুজের মতোই স্বাদ এ তরমুজের।
তিনি বলেন, ‘আমার কাছে পরামর্শের জন্য আসার পর আমি ওনাদের চাষ উপযোগী তিনটি জাতের তরমুজের বীজ কেনার পরামর্শ দেই। পরে একাধিকবার পরিদর্শন করে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি। মাচায় তরমুজ চাষে উৎপাদন খরচ খুব একটা বেশি না। তবে নিয়মিত ক্ষেতের যত্ন নিতে হয়। ওনাদের শ্রম ও কৃষিবিভাগের পরামর্শে এ সফলতা এসেছে।’
পুকুরের ওপর তরমুজের এই ছোট্ট বাগান দেখতে স্বস্ত্রীক সেখানে গিয়েছেন জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান। কিনেছেন কয়েকটি তরমুজও।
তিনি বলেন, ‘এখানে যে নতুন উদ্যোগে নতুন প্রযুক্তিতে অসময়ে তরমুজ চাষ ও অন্যান্য কৃষি কাজ শুরু হয়েছে, এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ। এভাবেই বাংলাদেশের কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের কৃষকরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।’