সমন্বিত চাষাবাদের পরিকল্পনায় পাল্টে গেছে চাঁদপুরের মেঘনা নদীর নীলকমল চর। যেখানে বছরে একবার ফসল ফলানোই ছিল কষ্টসাধ্য, সেখানে পরিকল্পিত চাষাবাদে সারা বছরই ফলানো হচ্ছে হরেক রকমের সবজি ও ফল। ঝিলে চাষ হচ্ছে মাছ।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দিন প্রতি আয় হচ্ছে লাখের উপরে। এ কৃষি বিপ্লবে সুযোগ হয়েছে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের। এতে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান বেড়েছে।
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার এক দুর্গম জায়গা এই নীলকমল চর। মেঘনার বুকে জেগে থাকা এই চরে যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌকা কিংবা জলযান। বর্ষায় তলিয়ে থাকে এই চরের অধিকাংশ জমি।
নীলকমল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন সর্দারের উদ্যোগে বদলে গেছে চরের চিরায়িত এ চিত্র। শুধু শীত মৌসুমেই নয়, এখন সারা বছরই চাষাবাদ চলছে এই চরে।
চর ঘুরে দেখা যায়, জঙ্গলে ভরা এই চরের বিরাট একটি অংশে ফল আর ফসলের সমারোহ। মাটি কেটে জায়গা উঁচু করে গড়ে তোলা হয়েছে পরিকল্পিত কৃষি খামার।
শসা তোলায় ব্যস্ত দুর্গম চরের কৃষি খামারের এক কর্মী। ছবি: নিউজবাংলা
কৃষি উদ্যোক্তা সালাউদ্দিন সর্দার বলেন, ‘জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের পরের সময়টুকু কাজে লাগানোর ইচ্ছাতেই পরীক্ষামূলকভাবে চাষাবাদ শুরু করি। চরাঞ্চল হওয়ায় নীলকমল চর বর্ষা মৌসুমে পানিতে তলিয়ে যায়। শুধুমাত্র শীতকালে চাষাবাদের সুযোগ পাওয়া যেত। আমি সেই প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি বদলে দিতে পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করি।’
তিনি জানান, শুরুটা হয় তিন বছর আগে। পৈত্রিক জমিতে মাটি কেটে মাছ চাষ শুরু করেন সালাউদ্দিন। এতে সফলতা পেয়ে ১২০ একর জমির ৭০ একরে চাষাবাদ করেন বিভিন্ন শাক-সবজি ও ফলের।
অল্প দিনেই ব্যাপক সফলতা পাওয়ায় বাড়ান বিনিয়োগের পরিমাণ। বর্তমানে ১২০ একর জমিতে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। সালাউদ্দিনের প্রতিদিন আয় এখন প্রায় এক লাখ টাকা।
খামারে ঝুলছে ক্ষতিকর কীটনাশকমুক্ত করলা। ছবি: নিউজবাংলা
এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘কাজের শুরুর দিকে অনেকে নিরুৎসাহিত করেছে। অনেকে বলেছেন, বিনিয়োগের টাকা সব জলে যাবে। আমি মনোবল না হারিয়ে কাজ চালিয়ে যাই। আজ আমার এই সফলতায় তারাই মুগ্ধ। বর্তমানে অনেকেই আসছেন আমার খামার দেখতে। নিজেদের জমিতে এমন বাগান গড়ে তুলতে চাচ্ছেন পরামর্শ। আমিও সানন্দে তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।’
সালাউদ্দিন জানান, এই কৃষিখামার এখন অনেকের কর্মসংস্থানের উৎস। এখানে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রমিক। অস্থায়ীভাবে আরও ৩০ থেকে ৪০ জন বেকার যুবক কাজ করছেন।
খামারের শ্রমিক জব্বার সিকদার বলেন, ‘বর্ষায় চর আগে পানিতে ডুইবা থাকত। কোনো ফসল ফলানো যাইতো না। এখন এই কৃষি খামারে কাজ করে যেই টাকা পাই, তা দিয়ে সুন্দর মতো সংসার চইলা যায়।’
১২০ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা সমন্বিত কৃষি খামারে হরেক সবজি। ছবি: নিউজবাংলা
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফারুখ বলেন, ‘শুরুর দিকে আমরা সন্দিহান ছিলাম ওনার (সালাউদ্দিন) কর্মকাণ্ডে। চরে কোনোদিন সারা বছর ফসল ফলাইতে দেখি নাই। কেউ চিন্তাও করে নাই। তার সফলতায় আমরাও এভাবে চাষাবাদ করতে চাচ্ছি।’
কৃষি উদ্যোক্তা সালাউদ্দিন সর্দার বলেন, ‘আমার এই খামারের ফসল কীটনাশকমুক্ত। বর্তমানে এখানে আম, কাঁঠাল, তরমুজ, কলা, শসা, করলা, লাউ, বেগুন, চালকুমড়ো, বরবটি, ঝিঙে, মরিচসহ বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি চাষাবাদ করা হচ্ছে। একাধিক ঝিলে করা হচ্ছে মাছ চাষ।’
খামার থেকে দিনে ৩০-৩৫ মন শসা তোলা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
বর্তমানে এই কৃষি খামার থেকে গড়ে প্রতিদিন ২০-২৫ মণ করলা, ৭০০-৮০০টি লাউ, ৩০-৩৫ মণ শসা, ২-৩ মণ বরবটি, ৫-৭ মন ঢেঁড়শ তোলা হয়। এগুলো চাঁদপুরের স্থানীয় বাজারসহ বিক্রি করা হচ্ছে শরীয়তপুর, ফেনী, লক্ষ্মীপুর জেলায়।
সালাউদ্দিন সর্দার বলেন, ‘আমার এই কাজে কৃষি কর্মকর্তাদের খুব একটা সহায়তা পাইনি। তাই যেকোনো প্রয়োজনে ইন্টারনেটের সহায়তায় নিয়েছি। এই কৃষি খামার থেকে প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকা আয় করার লক্ষ্য আমার, যাতে এই অঞ্চলের আরও অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়।’
দুর্গম চরের খামার থেকে প্রতিদিন ৭০০-৮০০ লাউ তুলে বিক্রির জন্য নিয়ে যান কর্মীরা। ছবি: নিউজবাংলা
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ জালাল উদ্দিন বলেন, ‘সাধারণত চরাঞ্চলের জমি শীতকাল ছাড়া অন্য সময় পানিতে তলিয়ে থাকে। তাই একাধিক বার চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। মেঘনার নীলকমল চরে সমন্বিত চাষাবাদ করছেন সালাউদ্দিন। তাকে দেখে উৎসাহিত হচ্ছে অনেক মানুষ এবং আশপাশে অনেকে গড়ে তুলছেন খামার।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তার এই কাজে পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করেছি। জায়গাটি দুর্গম হওয়ায় ও আমাদের প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় হয়ত কিছুটা ঘাটতি থাকতে পারে। তবে ভবিষ্যতে আরও বেশি সহায়তার চেষ্টা করব আমরা।’