জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, পানিদূষণ, অতি আহরণ, বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় রানি মাছের প্রাপ্যতা ব্যাপকভাবে কমেছে। দীর্ঘ এক বছর এ মাছ নিয়ে গবেষণা করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা।
বিএফআরআই সূত্রে জানা যায়, ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে রানি মাছের সংরক্ষণ, প্রজনন এবং পোনা উৎপাদন বিষয়ে গবেষণা কর্মসূচি নেয়া হয়। প্রজননের জন্য এই মাছটি যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও কংস নদ এবং নেত্রকোণার হাওর থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং গবেষণাকেন্দ্রের পুকুরে প্রতিপালন করা হয়।
গবেষণার আওতায় জুন মাসের চলতি সপ্তাহে দেশে প্রথমবারের মতো রানি মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনকৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে।
গবেষক দলে ছিলেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সেলিনা ইয়াছমিন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রবিউল আওয়াল, পরিচালক এ এইচ এম কোহিনুর ও স্বাদুপানি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহা আলী।
সেলিনা ইয়াছমিন নিউজবাংলাকে জানান, পুকুর থেকে পরিপক্ব মাছ নির্বাচন করে কৃত্রিম প্রজননের পাঁচ-ছয় ঘণ্টা আগে স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে হ্যাচারিতে হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয়। ইনজেকশন দেয়ার ১০-১২ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছ ডিম দেয়। ডিম দেয়ার ২২-২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু বের হয়ে আসে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ডিম নিষিক্ত ও ফোটার হার যথাক্রমে ৭৫ ও ৫০ শতাংশ। রেণুর ডিম্বথলি দুই-তিন দিনের মধ্যে নিঃশেষিত হওয়ার পর প্রতিদিন তিন-চারবার সেদ্ধ ডিমের কুসুম খাবার হিসেবে হাঁপায় সরবরাহ করা হয়। হাঁপাতে রেণু পোনা ছয়-সাত দিন রাখার পর নার্সারি পুকুরে স্থানান্তরের উপযোগী হয়।বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রবিউল আওয়াল বলেন, রানি মাছ মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রজনন করে থাকে। জুন-জুলাই এদের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম। একটি পরিপক্ব স্ত্রী মাছে প্রতি গ্রামে ৮০০-৯০০টি ডিম পাওয়া যায়। এ মাছের ডিম্বাশয় এপ্রিল মাস থেকে পরিপক্ব হতে শুরু করে।
রবিউল আওয়াল আরও বলেন, অক্টোবরের শেষ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যখন বিলের পানি কমে যেতে থাকে, তখন রানি মাছ জালে ধরা পড়ে বেশি। এ মাছ খালবিল, নদীনালা, হাওর-বাঁওড় ইত্যাদির তলদেশে পরিষ্কার পানিতে বসবাস করতে পছন্দ করে। তবে কখনও কখনও ঘোলা পানিতেও এদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, পরিপক্ব স্ত্রী মাছের জননেন্দ্রিয় গোলাকার ও হালকা লালচে রঙের হয় কিন্তু পুরুষ মাছের জননেন্দ্রিয় পেটের সঙ্গে মেশানো, কিছুটা লম্বাটে ও ছোট হয়। এ মাছের মুখ আকারে ছোট এবং চার জোড়া ক্ষুদ্রাকৃতির স্পর্শী থাকে। তবে এর দেহে ইংরেজি ‘ওয়াই’ বর্ণমালার মতো চারটি কালো দাগ থাকে এবং দুটি দাগের মধ্যবর্তী অংশে একটি কালো দাগ অবস্থিত। আঁশ অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতির, যা প্রায় সাধারণ দৃষ্টিতে বোঝাই যায় না। রানি মাছ প্রায় ৬-৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তবে সর্বোচ্চ ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হওয়ার রেকর্ডও রয়েছে।বিএফআরআই মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, এ মাছটি বউ মাছ, বেটি মাছ, পুতুল মাছ, বেতাঙ্গী মাছ প্রভৃতি আঞ্চলিক নামে পরিচিত। অনেকেই আবার ‘গাঙ্গ রানি’ বলেও ডাকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ভুটান ও মিয়ানমারে এ মাছ পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া রানি মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনকৌশল উদ্ভাবন করতে পেরেছেন। ফলে মাছটি চাষের আওতায় আসবে এবং সহজলভ্য হবে। সর্বোপরি শিগগিরই মাছটি সাধারণ ভোজনরসিকদের খাবার টেবিলে ফিরবে। ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, বিপন্ন মাছ পাতে ফেরাতে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। গবেষণার ৩০তম সাফল্য হিসেবে রানি মাছ এসেছে।
গত ১২ বছরে চাষের মাধ্যমে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে একটি ‘লাইভ জিন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ এবং পোনা উৎপাদনে গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করে।