শহরের পার-নওগাঁ মহল্লার বাসিন্দা রিকশাচালক আজগর আলী। সারাদিন রিকশা চালিয়ে যা আয় হয় সেটা দিয়েই চলে সংসার। দিনের আয় দিয়ে বিকেলে চাল কিনতে যান আজগর আলী। গিয়ে দেখেন চালের দাম বেড়েছে। তাই চিন্তার ভাঁজও পড়েছে তার কপালে।
আজগর বলেন, ‘গত ১০-১২ দিন আগেও লওগাঁত চালের দাম কম আছলো। একন দেকি সব ধরনের চালোত ৪ থ্যাকা ৫ টেক্যা করা বাড়িছে।
‘জিরাশাল চাল ১ কেজি কিনবার আচ্ছি, কয়েক দিন আগেও ৪৭-৪৮ টেক্যা কেজি বিক্রি হচ্ছিলো; একন ৫০ থ্যাকা ৫২ টেক্যা কেজি। গরীব মানুষ হামি, আবার লওগাঁত লকডাউন হচ্ছে, চালের দাম বাড়লে হামরা চলমু কি করা।’
দেশের পাইকারি ও খুচরা চাল বিক্রির অন্যতম বৃহৎ মোকাম নওগাঁ। সেখানে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা ও হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলেন আজগর আলী।
জেলায় করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চলছে লকডাউন। এতে আয় কমেছে রিকশাচালকসহ খেটে খাওয়া মানুষের।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নওগাঁর মোকাম ও বাজারে চালের দাম গত কয়েক দিন ধরে বেড়েই চলেছে। ১০-১২ দিনের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে চালের প্রকারভেদে কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে।
ধান-চালে সমৃদ্ধ উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ চাল সরবরাহ করা হয়। পাইকারি বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে বলে জানান একাধিক খুচরা ব্যবসায়ী।
ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষরা।
নওগাঁর রাণীনগর আবাদপুকুর হাট, রাতোয়াল হাট, সদরের হাঁপানিয়া হাট, মহাদেবপুর উপজেলার স্বরস্বতীপুর ও মহিষবাথায় হাট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে হাইব্রিড জাতের ধান প্রতি মণ ৯০০-৯২০ টাকা, জিরাশাইল ১০০০-১০৭০ টাকা, কাটারিভোগ ১১০০-১১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি মণ ধান ৭০-১৫০ টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে।
নওগাঁর রাণীনগরের দেউলা গ্রামের কৃষক অনুপ চন্দ্র বলেন, ‘বোরো মৌসুমে ২০ বিঘা জমিতে জিরাশাইল ৫৭ জাতের ধান আবাদ করেছিলাম। যেখানে বিঘাপ্রতি ফলন হয়েছে প্রায় ১৮ মণ হারে। ১০ দিন আগে জিরাশাইল ১ হাজার ২০ টাকা মণ দরে প্রায় ২০০ মণ ধান বিক্রি করেছি। বর্তমানে বাজারে মণে প্রায় ১০০ টাকা দাম বেড়েছে।’
মহাদেবপুর উপজেলার মহিষবাতান গ্রামের কৃষক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমার ১৫ বিঘা জমিতে কাটারি ধান আবাদ করেছিলাম। গত প্রায় ১০ দিন আগে প্রতিমণ ধান বাজরে বিক্রি হচ্ছিল এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০ টাকা দরে। বর্তমান বাজারমূল্য প্রতিমণ ১১০০-১১২০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।’
শহরের মাস্টার পাড়া মহল্লার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কাটারি চাল কয়েকদিন আগে প্রতি কেজি ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল। আমি ১ কেজি চাল কিনে নিয়ে গেছি। এখন সেই চাল খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকা করে। আমাদের মত খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষদের অনেক বড় সমস্যা যা বোঝার কেউ নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘লকডাউন চলায় তেমন কাজ নেই। এর মাঝে চালের দাম বেড়েছে। অন্য জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। সবমিলে পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।’
নওগাঁ শহরের পৌর খুচরা চাল বাজারের বিক্রেতা উত্তম কুমার জানান, ১০-২০ দিনের ব্যবধানে চালের প্রকারভেদে প্রতিকেজির দাম ৪-৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে জিরাশাইল ৫০-৫২ টাকা কেজি, কাটারি ৫৫ টাকা ও খাটো দশ ৪৬ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া ৫০ কেজি ওজনের প্রকার ভেদে চালের প্রতি বস্তার দাম বেড়েছে ১০০-১৫০ টাকা।
তিনি আরও জানান, ধানের জেলা হয়েও ধানের ভর মৌসুমের চালের দাম বেড়েছে। অন্য বছরগুলোতে কখনোই এমনটা হয়নি। ব্যবসায়ীদের বেশি দামে ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে খরচও বেশি পড়ছে। এ কারণেই হয়তো বাজারে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে।
নওগাঁ জেলা চাউল কল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘নওগাঁর বাজারে চালের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ধানের দাম বৃদ্ধি। বিগত বছরে কৃষকরা ধান উঠানোর আগেই কাটা মাড়াই করে হাটে বিক্রি করত। চলতি বছর অল্প ধান হাটে বিক্রি করে বাকি ধানগুলো বাড়িতে মজুদ করে রেখে দিয়েছিল।
‘হাট-বাজারে ধানের আমদানি কম হওয়ায় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদার তুলনায় বাজারে ধানের আমদানি কম হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে ধান কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে চালের বাজারে প্রভাব পড়েছে। তবে এ বছর ধানের ফলনও ভালো হয়েছে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি নওগাঁর উপপরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, ‘চলতি মৌসমে নওগাঁ জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো আবাদ করা হয়েছে। এবার গত বছরের চেয়ে জেলায় বেশি ধান উৎপাদন হয়েছে। কৃষকরাও ধানের দাম ভালো পাচ্ছে।
‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ধানের রোগবালাই তেমন ছিল না, যার কারণে ধান উৎপাদনে কৃষকরা উৎপাদনের চেয়ে ধানের দাম আশানুরূপ বেশি পেয়েছে বিগত বছরের চেয়ে।’