বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ধানে নয়, আমে খুশি কৃষক

  •    
  • ১১ মে, ২০২১ ০৯:১১

আমচাষি তাজুল ইসলাম বলেন, আট থেকে ১০ বছর আগেও জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ চরম অভাবে ছিলেন। তিন বেলা তো দূরের কথা, অনেকের এক বেলাও খাবার জুটত না। এলাকার মাটি লাল হওয়ার কারণে এখানে বছরে একবার ধান হতো। বাকি আট মাস জমি পড়ে থাকত। কিন্তু হাঁড়িভাঙা আম ভাগ্য বদলে দিয়েছে।

রংপুর অঞ্চলের মানুষ একসময় ধানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রতি মৌসুমে পাঁচ থেকে ১০ বিঘা জমি চাষ করে কষ্টে জীবন চালাতেন তারা। এখন সে জমিতে আম চাষ করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন কৃষকরা। রংপুরের এই ‘আম অর্থনীতি’ বদলে দিয়েছে মানুষের জীবন।

হাঁড়িভাঙা জাতের আমকে এখন রংপুরের নতুন অর্থকরী ফসল বলা হচ্ছে। জেলার মিঠাপুকুর, রংপুর সদর, বদরগঞ্জের বিস্তৃত এলাকার হাজার হাজার কৃষক এ আম চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। পরিবারে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা।

কৃষক, দিনমজুর থেকে অনেকেই হয়েছেন আমচাষি। প্রতি বছরই বাড়ছে আম চাষের পরিধি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর রংপুরের আট উপজেলায় ১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির আমগাছে ফলন এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে বদরগঞ্জ উপজেলায়।

এরপর রংপুর মহানগর এলাকায় ২৫ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৬০ হেক্টর, কাউনিয়ায় ১০ হেক্টর, গঙ্গাচড়ায় ৩৫ হেক্টর, মিঠাপুকুরে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর, পীরগঞ্জে ৫০ হেক্টর, পীরগাছায় ৫ হেক্টর ও তারাগঞ্জ উপজেলায় ১৫ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে।

রংপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ। এর সীমানায় পৌঁছালেই চোখে পড়ে এক নতুন দৃশ্য। কোথাও কোথাও ধানি জমির আইলের চারদিকে সারি করে আমগাছ লাগানো হয়েছে।

পথের ধারে, প্রতিটি বাসাবাড়ির পরিত্যক্ত জায়গা, বাড়ির উঠানেও আমগাছ। সব গাছেই প্রায় একই আকারের শ শ আম ঝুলছে।

শনিবার জেলার মিঠাপুরের আখিরাহাট, পদাগঞ্জ, মাঠেরহাট, বদরগঞ্জের গোপালপুর, নাগেরহাট, সর্দারপাড়া, রংপুর নগরের বড়বাড়ী, সদর উপজেলার সদ্যপুষ্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি এলাকায় গিয়ে একই দৃশ্য দেখা যায়।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জুন মাসের শুরুর দিকে হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আসতে শুরু করবে।

মিঠাপুকুরের গোপালপুর উত্তরপাড়া এলাকার কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, এক দোন (২৪ শতক) জমিতে ধান আবাদ করতে পানি, সার, হাল-চাষ, শ্রমিক এবং কাটা-মাড়াই করতে কমপক্ষে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা লাগে। খুব ভালো আবাদ হলে এই জমিতে ধান হয় ২০ মণ, যার মূল্য ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা।

তিনি জানান, এক দোন জমিতে আমগাছ থাকে ৪০ থেকে ৪৫টি। কীটনাশক, সার আর শ্রমিকসহ খরচ হয় সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। আম বিক্রি হয় সর্বনিম্ন ৪০ হাজার টাকায়।

আমজাদ বলেন, ‘এক দোন জমিতে ধান আবাদ করে লাভ তিন হাজার টাকা আর আম বিক্রি করলে লাভ ৩২ হাজার টাকা। তাই ধান চাষ করা হচ্ছে শুধু খাবারের জন্য। আর আম চাষ করা হচ্ছে লাভের জন্য।’

গোপালপুর এলাকার আমচাষি আসাদুজ্জামান লিটন জানান, এ বছর পাঁচ দোন জমির ২০০টি আমগাছে মুকুল আসার সময়ই দেড় লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। আরও পাঁচটি বাগান আছে তার। এসব আমবাগানে গত দুই বছর আগেও তিনি ধান চাষ করেছিলেন। আমে লাভ বেশি হওয়ায় ধান চাষ বাদ দিয়েছেন।

মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ সরদারপাড়া গ্রামের নুরুল ইসলাম জানান, তার বাড়ির ভিটা এক একর (১০০ শতক) জমিতে। বাড়ির উঠান থেকে শুরু করে ১৫০টি আমগাছ লাগিয়েছেন তিনি।

নুরুল ইসলামের দাবি, আমে পরিশ্রম ও ঝুঁকি কম হলেও লাভ বেশি। এই জমির আম তিনি কমপক্ষে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। তার অন্য কোনো আবাদ নেই। আম বিক্রির টাকা দিয়ে এক ছেলেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন।

হাঁড়িভাঙা আমকে ঘিরে বেকারের সংখ্যাও কমেছে রংপুরসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায়। বিশেষত মিঠাপুকুরের লালপুর, পদাগঞ্জ, তেয়ানিসহ আশপাশের গ্রামের বেকার যুবকরা এখন আম ব্যবসায় জড়িয়ে বেকারত্ব দূর করেছেন।

আজহারুল ইসলাম নামের এক আমচাষি বলেন, ‘আমি আগে কৃষিকাজ করতাম। এখন হাঁড়িভাঙা আমের ব্যবসা করি। গত বছর পাঁচ একর জমির আম আগাম কিনে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি।

‘এবার ১০ একর জমির আম কেনা হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে ৫০ লাখ টাকার আম বিক্রি করতে পারব।’

মিঠাপুকুরের আখিরাহাট এলাকার তাজুল ইসলাম জানান, আট থেকে ১০ বছর আগেও এসব এলাকার মানুষ চরম অভাবে ছিলেন। তিন বেলা তো দূরের কথা, অনেকের এক বেলাও খাবার জুটত না। এলাকার মাটি লাল হওয়ার কারণে এখানে বছরে একবার ধান হতো। বাকি আট মাস জমি পড়ে থাকত। কিন্তু হাঁড়িভাঙা আম তাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।

সদরুল ইসলাম নামের এক আমচাষি জানান, এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় প্রচুর আম ধরেছে। কিছুদিন আগের শিলাবৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতি হলেও সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে পারলে এলাকার হাজার হাজার আমচাষি লাভবান হবেন।

রংপুরে হাঁড়িভাঙা আম চাষের পথিকৃৃৎ মিঠাপুকুরের আঁখিরাহাটের বাসিন্দা আব্দুস সালাম।

তিনি বলেন, ‘স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই আমের বাগান এখন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় করা হয়েছে। ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় আমটির সুনাম দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এটি রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতির সার্বিক চিত্র বদলে দিচ্ছে।’

আব্দুস সালাম বলেন, ‘এখানে প্রতি বছর প্রচুর আম উৎপাদন হয়। টেকসই অর্থনীতির জন্য আমরা শুরু থেকেই আম সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আম চাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং গবেষণা কেন্দ্র খোলার দাবি করে আসছিলাম।

‘এ ছাড়া চাষিরা সহজ শর্তে ঋণ পেলে আম চাষে আরও উৎসাহী হবেন। এতে এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও সচল হবে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, ‘রংপুরে এখন ব্যাপকভাবে হাঁড়িভাঙা আম চাষ হচ্ছে। কৃষি বিভাগ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে।’

তিনি বলেন, ‘খুব একটা পরিশ্রম ও অর্থ খরচ না হওয়ায় মানুষ আম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’

মাসুদুর আরও বলেন, ‘রংপুরের আট উপজেলায় এ বছর ১৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। অন্যদিকে হাঁড়িভাঙা আম চাষ হয়েছে ১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে।

‘৩ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে অন্যান্য জাতের আম।’

জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, ‘আম বাজারজাতে যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয় এবং পরিবহনে ব্যবসায়ীদের কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সে জন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলব।’

এ বিভাগের আরো খবর