বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অথচ চাষিদের বলা হয়, ঢাকায় তরমুজের ‘পানির দর’

  •    
  • ৭ মে, ২০২১ ২০:৫০

'দেড় লাক (লাখ) টেহা (টাকা) খরচ হচি (হওয়া) তিন বিঘে জমিত। এহন ঢাকা বলতিচে দাম কম। বিধায় হেটি আমাগড়ে (আমাদের) বিঘে (বিঘা) ধরি (ধরে) ৮ হাজার, ৫ হাজার টেহাও দাম কচ্ছি।’

নাটোরের তরমুজ চাষিদেরকে বেপারিরা বলেন, ঢাকায় ফলটির দাম অনেক কম। তাই তারাও টাকা কম দেবেন। আর পাইকাররা একজোট হয়ে দাম কম বলার কারণে কৃষক ক্ষতির মুখে।

গ্রীষ্মের রসাল ফল তরমুজ নিয়ে এবার যে আলোচনা, তা এর আগে কখনও হয়নি। রোজার শুরু থেকে ফলটির দাম ধাপে ধাপে বাড়তে থাকায় এক পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে অভিযানও চালাতে হয়েছে।

রোজার আগে যে ফলের দাম ছিল কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা, সেটি এক পর্যায়ে ৫০ থেকে ৬০, পরে ৭০ টাকাও ছাড়িয়ে যায়।

ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান শুরু করলে জানা যায় আরেক ফাঁকি। বিক্রেতারা পাইকারিতে ফলটি কিনে আনেন শ হিসেবে, কিন্তু ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন কেজি হিসেবে। এটি কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কেবল তাই নয়, পাইকারিতে শ হিসেবে কিনলে তরমুজের দাম কেজিতে পড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা। খরচ ও অপচয় ধরলেও তা ২০ থেকে ২৫ টাকার বেশি হয় না। আইন অনুযায়ী ফলে কেজিপ্রতি লাভ করা যায় ১০ টাকা। আর তরমুজের ক্ষেত্রে সেটি ৩ থেকে ৫ টাকা বলা আছে। এই হিসেবে বিক্রেতারা ঠকাচ্ছেন ক্রেতাদেরকে। তারা অনুমোদিত হারের কয়েক গুণ বেশি মুনাফা করছেন।

কিন্তু বাজারে এত দাম হলেও তাতে কৃষকদের কিছু যায় আসে না।

কিন্তু নাটোরের কৃষকরা জানাচ্ছেন, বেপারিরা তাদেরকে বলছেন, ঢাকায় তরমুজের দাম অনেক কম।

এই জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার চরকাদহ এলাকাসহ চলনবিল জুড়েই শতশত হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হয়েছে তরমুজ। এসব তরমুজের ওজন সর্বনিম্ন ৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৬ কেজি পর্যন্ত।

গত সপ্তাহে কৃষকরা শ হিসেবে হিসাব ধরে ১৫ থেকে ২৩ হাজার টাকা পর্যন্ত জমিতেই বিক্রি করেন তরমুজ।

অথচ এক সপ্তাহের ব্যবধানেই দাম কমেছে অর্ধেকের নিচে। প্রতি শ তরমুজ এখন ১০ হাজার টাকার নিচেও। অর্থাৎ একেকটির দাম পড়ে ১০০ টাকা।

তরমুজের ব্যাপক ফলনেও হাসি নেই কৃষকের মুখে

আবার বিট কাভার পদ্ধতির মাধ্যমে বিঘা ধরে জমির তরমুজ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন এখানকার কৃষক।

চলনবিল এলাকার চরকাদহ গ্রামের আশরাফুল ইসলাম দুই বিঘা জমিতে চাষ করেছেন এশিয়ান-টু (বাংলালিংক নামে পরিচিত) জাতের তরমুজ। খরচ হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা।

শুক্রবার প্রতি ১০০ তরমুজ ১৮ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেন তিনি। সঙ্গে বিনামূল্যে দিয়েছেন পাঁচটি তরমুজ।

জমিতে বিক্রি উপযোগী পাঁচ শতাধিক তরমুজ থাকলেও পাইকারের দেখা না মেলায় জমিতেই তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম।

বেপারিরা একজোট। এই অবস্থায় মাঠে নষ্ট হওয়ার উপক্রম ফসল

আশরাফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হেদিন (সেদিন-শুক্রবার) বেচনো (বেচা) আঠারো হাজার টেহা শও (শত)। আজ বেচাহালামু (বিক্রি); কিন্তু একটা পার্টিও (ক্রেতা) নাই। বেইচতে পারতিছিনা; কয় ৭ হাজার; ৬ হাজার টেহা শও-নি। এহন তাও নিচ্ছে না নি।’

তিনি বলেন, ‘দুই বিঘা জমি আবাদ করিছি (করা)। এক লাখ ২০ হাজার টেহা খরচ পড়িছি। বেচিছি (বিক্রি) ১৮ হাজার।। এহন (এখন) কোন পার্টিই তরমুজ লিচ্ছে (নেয়া) না কো। এহন গোটাটাই (সমস্ত) তো আমোরে (আমাদের) লচ।’

পাইকারি ব্যবসায়ী না পেলে তরমুজ কীভাবে বিক্রি করবেন?

এমন প্রশ্নের জবাবে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘এই তরমুজ এহন কী করমু; জমিতেই পঁচি (নষ্ট) যাবি। আর না হয় গরু-বাছুর দিই (দিয়ে) খওয়াইলাগবি। তাছাড়া তো বুদ্ধি নাই কো।’

তার পাশে সাত বিঘা জমিতে ফলটির চাষ করেছেন তিন ভাই ফরিদুল ইসলাম, আনারুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম। আনারুল ১৫ হাজার ও সাইফুল ১৭ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। তারাও পাইকার পাচ্ছেন না।

আবু তালেব মিয়া দেড় বিঘা জমিতে চাষ করেছেন ৮০ হাজার টাকা খরচ করে। কিন্তু তরমুজ বিক্রির উপযোগী হওয়ার পর তিনি ভুগছেন হতাশায়।

তিনদিন ধরে পাইকারের দেখা পাচ্ছেন না। পরে এক হাজার ১৫০ তরমুজ একসঙ্গে বিক্রি করে দেন ৬০ হাজার টাকায়।

এতে করে প্রতি পিস তরমুজ এই কৃষক বিক্রি করেন মাত্র ৫২ টাকায়। আর এই উৎপাদিত তরমুজ তিন থেকে ১৪ কেজি পর্যন্ত ফলন দেয়। যার গড় ওজন ছিল ৫ কেজি। তাহলে প্রতি পিস তরমুজ ৫২ টাকায় বিক্রি হলে তা কেজিতে দাঁড়ায় সাড়ে ১০ টাকা।

আবু তালেব মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার জমির তরমুজ বিক্রি হচ্চি না। কিন্তু খরচ করছি প্রচুর টেহা (টাকা)। এহন (এখন) বিচা (বিক্রি) না হওয়ায় সব একিবারে (এক সঙ্গে) বিচ্চি (বিক্রয়) ৬০ হাজার টেহায়। খরচ হলি (হয়েছে) ৮০ হাজার টেহা; বিচ্চি ৬০ হাজারত। তাইলে বউ-ছোল খাইটা (পরিশ্রম) তরমুজ বইয়ে (চাষ) কী হলি? তালি (তাহলে) কয় টেহা করি পড়িছে। কৃষক হামরা তালি পরি বাঁচি কিবা কইরে।’

আরেক চাষি আরিফুল ইসলাম বলেন, 'দেড় লাক (লাখ) টেহা (টাকা) খরচ হচি (হওয়া) তিন বিঘে জমিত। এহন ঢাকা বলতিচে দাম কম। বিধায় হেটি আমাগড়ে (আমাদের) বিঘে (বিঘা) ধরি (ধরে) ৮ হাজার, ৫ হাজার টেহাও দাম কচ্ছি।’

তিনি বলেন, 'এহনও খরচি (খরচ) তোলতি (উঠানো) পারি নাই কো। লচে (ক্ষতি) আছি এক লাক (লাখ) টেহা। কালি (গতকাল) বিচ্ছি (বিক্রয়) ৯ হাজার টেহা শও। আজ ফির কচ্ছি শও হবেরলয় (হবে না); বিট কাভার। হামাগকে ওরা দাম দিচ্ছি না কো তরমুজের।'

বাধ্য হয়েই এসব কৃষক জমি থেকে তরমুজ তুলে পথে-ঘাটে পিস হিসেবে বিক্রি করছেন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে নাটোর-পাবনা আঞ্চলিক মহাসড়কের গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিসা এলাকায় সড়কের পাশে পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রি করছিলেন সিধুলি গ্রামের সেন্টু মিয়া।

তিনি বলেন, 'কয়েকদিন ধরে তরমুজের পাইকার নেই। বিঘা প্রতি তরমুজের দাম উঠছে মাত্র ১৫ হাজারে। যা খরচের তিনগুণেরও কম।

'ছোট ভাই করিছে দেড় বিঘে। আমার বড় ভাই করিছে এক বিঘে। এমনিভাবে আমরাই পাঁচ বিঘে জমিতে তরমুজ করিছি। কিন্তু পাইকারি খরিদার নাই। জমিতেই নামে না। যার কারণে অল্প কিছু তুলি; রোডে লিয়েআইসে এই যে বেচ্চি।'

চলনবিলসহ এই জেলার উর্বল মাটিতে এশিয়ান-২ (বাংলালিংক), বিগ ফ্যামিলি, ব্লাক সুইট, থাইল্যান্ড-টু, মিঠাল সুইট ও কালো জাম্পুসহ বেশ কয়েকটি জাতের দেশি-বিদেশি তরমুজ চাষ করা হয়।

এ বছরের জানুয়ারিতে শীষ্মকালীন এই ফলের বীজ বপনের চার মাস পর ফলন আসে এপ্রিলে। ভালো ফলনে কৃষকরা আর্থিক দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠতে তাই আগাম তরমুজ চাষ করেছিলেন। কিন্তু প্রথম দিকে অল্প সংখ্যক কৃষক লাভের মুখ দেখলেও বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই ক্ষতির মুখে।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুব্রত কুমার সরকার জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ৮৬৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৫৬ মেট্রিক টন।

তরমুজের বড় দরপতন ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট সম্পর্কে সুব্রত কুমার সরকার বলেন, 'ইতোমধ্যে গত ২ মে থেকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে তরমুজ সংগ্রহের পর বিক্রি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট ভেঙে কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে তরমুজের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়।'

এ বিভাগের আরো খবর