কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মালিউন্দ গ্রামের ফয়সাল মো. মুর্শেদ। ২০০৭ সালে ব্যবস্থাপনায় স্নাতক শেষ করে পাড়ি জমান ইতালিতে। বছরের অর্ধেকটা সময় কাটান দেশে। করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে গত বছর এসেছিলেন বাংলাদেশে। পরে আর যাওয়া হয়নি।
দেশে আসার পর থেকেই অলস সময় পার করছিলেন তিনি। ইউটিউবে হলুদ রঙের তরমুজ গোল্ডেন ক্রাউন চাষ দেখে তিনি চিন্তা করলেন, তাদের গ্রামে এত পতিত জমি, সেখানে চাষ করবেন।
কৃষক পরিবারে জন্ম হলেও এর আগে জীবনে কখনও ফসল ফলানোর কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন না তিনি। আবার হাওরে ধানের বাইরে নতুন ফসল আবাদের ব্যাপারে ধারণাও একবারেই সাম্প্রতিক।
তিন থেকে চার বছর ধরে ধানের পাশাপাশি সূর্যমুখী, সরিষা ও ভুট্টা চাষ শুরু করেছেন অনেকে। তবে তরমুজ চাষও যে সম্ভব, সেটা করে দেখালেন ফয়সাল।
ইউটিউবে চাষপদ্ধতি দেখে বাবার ৯ একর পতিত জমিতে চাষ করেছেন গোল্ডেন ক্রাউন, জেসমিন-২, ব্লাক জাম্বু, ফাইজা-১ জাতীয় তরমুজ। পাশাপাশি ইউরোপের ফল রকমেলন আর দেশি বাঙ্গি ও শসা।
এর মধ্যে গোল্ডেন ক্রাউন ও জেসমিন-২ চাষ করেছেন এক একর করে জমিতে, ব্ল্যাক জাম্বু করেছেন ৫০ শতাংশ জমিতে।
শসার আবাদ করেছেন ১.১৫ একর জমিতে। আর বাঙ্গি আবাদ করেছেন এক একর জমিতে। বাকি জমিতে করেছেন ধনেপাতা।
হাওরে নতুন ফসল ফলিয়ে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ফয়সাল। তার ক্ষেত দেখতে আসছেন অন্যরা। নিজেরাও এমন ফসল ফলাতে চান তারা।
লোকমুখে শুনে তরমুজ ক্ষেত পরিদর্শন করে এসেছেন রাষ্ট্রপতিপুত্র ও কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকও।
সরাসরি ক্ষেত থেকে পাইকারি মূল্যে কিনে এনে ইটনা উপজেলা সদরের বাজারে বিক্রি করেন ফল ব্যবসায়ী বাকি বিল্লাহ। তিনি শহর থেকে তরমুজ এনে বাজারে বিক্রি করতেন। হাওরেই পাওয়া যাচ্ছে বলে তাকে এখন আর শহরে যেতে হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘ফয়সাল ভাইয়ের ক্ষেতের মধ্যে হলুদ তরমুজ আর জেসমিন-২ তরমুজ পাইয়া আমি অহন আর শহরে যাই না। প্রতিদিন অহন ক্ষেত থাইক্যে তুইল্ল্যে আইন্নে বেচি। আগে আমার খরচও বেশি পড়ত আর মাঝেমধ্যে মালও থাকত নষ্ট। আর অহন আমার ব্যবসাও বালা, খরচও কম।’
মিঠামইনে বাজারের ফলের দোকানগুলো এখন ফয়সালের খামারের তরমুজে সাজানো। উপজেলার ঘাগড়া বাজারের বিভিন্ন ফলের দোকান ঘুরে গিয়েও দেখা গেছে একই চিত্র।
এই বাজারের ফল ব্যবসায়ী মো. সায়েম। তিনি জানান, নিজের এলাকার ফসল হওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে বাড়তি কথা বলতে হচ্ছে না। মানুষ আসে আর ওজন দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আগে একটা তরমুজ বেচলে একেকজনে ১০ বার জিগাইত তরমুজ ভিতরে কিমন? মিষ্টি অইব কি না? আর অহন নিজের গেরামো অইছে তো সবাই জানে। হের লাইগ্যে বাড়তি কথা কওন লাগে না।’
কথা হয় গোন্ডেন ক্রাউন কিনতে আসা খলাপাড়া গ্রামের মফিজ মিয়ার সঙ্গে। বলেন, ‘জীবনে ম্যালা তরমুজ খাইছি। কিন্তু এই অইলদা (হলুদ) তরমুজের মতো আর পাতার রঙের (জেসমিন-২) তরমুজের মতো মিষ্টি আর ফাইছি না। বাড়ির ফুলাপানেও অহন আর অন্য তরমুজ খায় না। আর এই তরমুজ কিনলেও টেনশন নাই।’
তিন মাস বাবা কথা বলেননি রাগ করে
ফয়সাল নিউজবাংলাকে বলেন তার চাষের কাহিনি। পরিচিতজন এমনকি পরিবার থেকে শুরুতে সমর্থন পাননি। তাদের ধারণা ছিল, হাওরে এসব ফসল হবে না। আর এর আগে কখনও কৃষিকাজ করেননি, তাই তিনিও সফল হবেন না।
তার পরেও অনড় থাকায় বাবা রাগ করে তিন মাস তার সঙ্গে কথা বলেননি বলেও জানান প্রবাসী ফয়সাল।
তিনি বলেন, ‘করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে এসেছিলাম দেশে। পরে আর যাওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন এলাকায় অলস সময় পার করতাম ইউটিউব দেখে। তখন ইউটিউবে চুয়াডাঙ্গার এক লোকের গোন্ডেন ক্রাউন, জেসমিন-২ আর ব্লাক জাম্বু তরমুজের চাষ দেখে আগ্রহ জাগে। তখন ওনার নম্বর সংগ্রহ করে পরামর্শ নিতে থাকি। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিই পতিত জমিতে এইগুলো চাষের।’
আগে কখনও কৃষিকাজ করেননি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ জন্যই ফ্যামিলি থেকে কোনো সাপোর্ট পাচ্ছিলাম না। তারপরেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকি। আমাকে দিয়েও যে কৃষিকাজ সম্ভব সেটা আর পরিবারকে বোঝাতে পারছিলাম না। কারণ তাদের ধারণা ছিল আমি সফল হতে পারব না।’
এ জন্য পরিশ্রমের মাত্রটা বাড়িয়ে দেন ফয়সাল। বলেন, ‘ভোর হওয়ার আগেই চলে যেতাম বাগানে। দিনভর কর্মচারীদের সঙ্গে নিজেও কাজ করতাম। আর নিয়মিত চুয়াডাঙ্গার সেই ভাই আর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম।’
‘বাগানে এত সুন্দর ফসল হবে আমি নিজেও কল্পনা করিনি’- বলেন তিনি।
‘এখন প্রতিদিন শত শত মানুষ এসে বাগানটা যখন দেখে, তখন সবাই এর রহস্য জানতে চান। জানতে চান এই কাজ আমার দ্বারা কীভাবে সম্ভব হয়েছে?’- কণ্ঠে গর্ব ঝরে পড়ে তার।
ধান চাষ থেকে বের হয়ে আসতে হবে
ধানের জন্য প্রসিদ্ধ হাওর কখনও কখনও চাষিদের দুশ্চিন্তারও কারণ হয় আগাম বন্যায়। দুই বছর আগেও ফসলহানি হয়েছে ব্যাপক। ধান কাটার আগেই পানি এসে তলিয়ে গেছে চারপাশ।
ফয়সাল বলেন, ‘ধান চাষের গণ্ডি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আগামীতে এই প্রজেক্টকে আরও বড় করব আমি।’
কাছেই বসা ছিলেন মালিউন্দ গ্রামের ২৫ বছর বয়সের যুবক নাঈম। বলেন, ‘ফয়সাল ভাইয়ের এই সাফল্য দেখে আমারও এগুলো চাষের প্রতি আগ্রহ জেগেছে। আগামীতে আমিও ভাইয়ের কাছ থেকে কৌশল নিয়ে কাজ শুরু করব।’
একই কথা জানাচ্ছিলেন আরেক যুবক তপন। বলেন, ‘কৃষিকাজের প্রতি ভাই আমাদের উৎসাহ বাড়িয়েছেন। আমরাও আগামী বছরের শুরুতে ওনার মতো করে শুরু করতে চাই।’
এই এগ্রো ফার্মে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন হারুণ অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘বুঝেশুনে করতে পারলে এইটা খুবই লাভজনক। তবে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে এবং নিয়মিত সময় দিতে হবে। তবেই ভালো ফসল পাওয়া যাবে।’
মিঠামইন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমান আনিছ বলেন, ‘ওনি প্রথমে যখন আমাদের সঙ্গে এই বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলেন, তখন আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম তার বাবা চেয়ারম্যান, তিনি আবার ইতালিপ্রবাসী। মাঝেমধ্যে দেশে আসেন। উনি কীভাবে এত পরিশ্রমের কাজ করবেন? বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।
‘ভেবেছিলাম কয়েক দিন হাওরে গিয়ে পরে বোধহয় আর যাবেন না। কিন্তু উনি আমাদের সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন পরিশ্রমের মাধ্যমে। কৃষি অফিসের সঙ্গে ওনার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আমরাও নিয়মিত তার জমি পরিদর্শন করতাম।
‘হাওরে ওনার সফলতার মধ্য দিয়ে আরও নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে এবং নতুনভাবে কিছু একটা করার সাহস পাবে।’
ফয়সালরাই আদর্শ: সংসদ সদস্য
ফয়সালের জমি পরিদর্শন করে সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, ‘আমাদের হাওর অঞ্চলের মানুষ এত উর্বর জমি থাকা সত্ত্বেও সেগুলো পতিত রাখে। ধানের বাইরে অন্য কোনো ফসল ফলানোতে তাদের আগ্রহ কম। বছরে একটিমাত্র ফসল ধানের উপর নির্ভর করে সবাই। অনেক সময় অকাল বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জমি ডুবে গেলে বা ফসল নষ্ট হয়ে গেলে তাদের আর কোনো উপায় থাকে না। এ জন্য আমি সবাইকে বলি ধান চাষের পাশাপাশি অন্যান্য ফসলের দিকেও মনোযোগ দিতে।’
ফয়সালের প্রশংসা করে তাকে তরুণ উদোক্তাদের আদর্শ বলেও উল্লেখ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। বলেন, ‘তার পুরো জমিটা আমি ঘুরে ঘুরে একদম মাচার নিচে পর্যন্ত গিয়ে পরিদর্শন করেছি। তার এই সফলতা দেখে আমি খুবই আনন্দিত। আমি মনে করি হাওরের প্রতিটি এলাকার তরুণরা তার এই সফলতা দেখে উৎসাহ পাবে।
‘আমি চাই, প্রতিটি গ্রামে ফয়সালের মতো উদ্যোক্তার জন্ম হোক। চৈত্র মাসে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় তার পানির সমস্যা হয়েছিল। আগামীতে যেন এই সমস্যা আর না হয় সে জন্য একটি সাবমার্সেবল নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নেব।’