কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের সামনের বিক্রেতা মো. রফিক ছোট আকারের একটি তরমুজের দাম চাইলেন ৪০০ টাকা। সে তরমুজ মেপে দেখা যায় ৫ কেজি ৩০০ গ্রাম হয়েছে।
বাজারে কেজি দরে যারা বিক্রি কর3ছেন, তারা দাম চাইছেন ৬০ টাকা। এই দরে কেজিতে কিনলে দাম পড়ত সর্বোচ্চ ৩২০ টাকা। কিন্তু সেই বিক্রেতা দাম বেশি চাইছেন ৮০ টাকা।
বিক্রেতা বলছেন, এবার দাম গত বছরের চেয়ে বেশি। আর কেজিদরে তরমুজ বিক্রি নিয়ে তোলপাড় হলেও এই প্রবণতা একেবারে নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরেই এভাবে বিক্রি হচ্ছিল। তবে কেউ কেজি দরে, কেউ পিস হিসেবে বিক্রি করত। তবে এবার প্রায় সবাই বিক্রি করছেন কেজিতে।
তবে আড়তে তরমুজ কেজিদরে বিক্রি হয় না। আর এ কারণেই খুচরা বিক্রেতারা পড়েছেন আইনি ঝামেলায়। ভ্রাম্যমাণ আদালত এতে যখন পাইকারি বাজারের কথা বলছেন, তখন বেকায়দায় পড়ছেন। সব আড়তে পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রি হয় না। আর কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী পাইকারিতে পিস হিসেবে বিক্রি করলে খুচরাতেও সেভাবেই বিক্রি করতে হয়। আর সেখানে কেজিতে কিনে আনলে বেচতে হবে কেজিতে।
কারওয়ান বাজারের একাধিক বিক্রেতা স্বীকার করেছেন, তারা পাইকারিতে পিস হিসেবে কিনে এনেছেন। আর পিস হিসেবে কিনে কেজিতে বিক্রি করা যে আইনবিরুদ্ধ, সে বিষয়ে ধারণাও নেই তাদের।
তবে ক্রেতা পিস হিসেবে কিনলেই যে লাভবান হবেন, তা নয়। দীর্ঘদিন ব্যবসায় ফলে ব্যবসায়ীদের একটা আন্দাজ রয়েছে কোন তরমুজ কেমন ওজনের হতে পারে। তাই তারা পিস হিসাবে বিক্রি করলেও ক্রেতাকে দাম বলছেন নিজের ধারণা করা কেজির মাপের চেয়ে বেশি।
কেজির তুলনায় পিস হিসেবে বিক্রি করা বিক্রেতা মো. রফিক তুলনামূলক বেশি দাম চাওয়ার বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেজিতে বেচি আর পিচে বেশি, ব্যবসা করণ লাগব। লসে তো মাল বেচুম না। পিস হিসাবে দাম চাইলে মানুষ মুলামুলি বেশি করে। দাম বেশি চাওন লাগে। পরে যারতন যা লন যায়।’
গত কয়দিনের অভিযান নিয়ে তুমুল আলোচনায় বাজারে দামের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়েছে, এমন লক্ষণ দেখা যায়নি শুক্রবার।
কারওয়ান বাজারে ছোট আকারের (চার থেকে পাঁচ কেজি) একটি তরমুজ কিনতে গেলেই ২৫০ টাকা ৩০০ টাকা গুণতে হচ্ছে ক্রেতাকে। কেউ কেজি দরে কিনতে চাইলেও তাকে কিনতে হচ্ছে পুরোটাই। কেটে অল্প নিতে চাইলে বিক্রেতা রাজি হচ্ছেন না।
বিক্রেতারা প্রতিকেজির দাম চাইছেন ৬০ টাকা। একে গরম, তার ওপর রোজা। বাজারে চাহিদা বেশি। তাই ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার জোর বেশি বাজারে।
কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, ফলের ক্ষেত্রে কেজিতে সর্বোচ্চ ১০ টাকা লাভ করা যাবে। তবে তরমুজের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনায় বলা আছে, তরমুজে কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকার বেশি লাভ করা যাবে না।
তবে খুচরা পর্যায়ে এর চেয়ে বেশি হারে লাভ করার বিষয়টি উঠে এল মো. রফিকের বয়ানেই। তিনি বলেন, ‘একশ তরমুজ কিনলে ১০ টা পচাও থাহে। প্রতিশর দাম ২৫ হাজার ট্যাকা। তার উপর আছে খরচা। সব মিল্যা হিসাব করলে দেহন যাইব দাম পড়ছে কেজিতে ৪৫ ট্যাকার মতো।’
এই হিসেবে এই বিক্রেতা অনেক বেশি হারে মুনাফা করতে চাইছেন।
আইন অনুযায়ী তার মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার বিষয়টি বুঝিয়ে বললে তিনি সেই ‘মুলামুলি কইরা কিনবেন’ এই যুক্তি তুলে ধরেন।
তবে ‘মুলামুলিতে’ তাকে খুব একটা ছাড় দিতে দেখা গেল না।
এদিন তরমুজসহ বিভিন্ন নিত্য পণ্যের বাজার তদারকি চালায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তদারকি শেষে মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা বলেন, ‘পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে জিম্মি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখন থেকে সবাই তরমুজ পিস হিসাবেই বিক্রি করছে। কিন্তু দাম অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। কৃষকের কাছ থেকেই এ তরমুজ পাইকারি ব্যবসায়ীরা (প্রতি মণ) ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকায় কিনছে। ফলে অন্য খরচ মিলে দাম বেশি পড়ছে।’
তিনি যখন কথা বলছিলেন তার পাশেই তরমুজ বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দাম বেশির কারণে কাস্টমার কম। আমরা কী করমু? আড়তেই কেজিতে ৩০ থেকে ৩৫ খরচ। আনা নেয়ার সময় দুই-চাইরটা নষ্ট হয়। সদরঘাট তন আনতে ভাড়াও লাগে। কম বেচলে পোষায় না।’
তবে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্যের পরই পাল্টে যায় তার বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘স্যার তো ঠিকই বলছেন। ফোনে খোঁজ খবর নিছেন। আমাগো তো বড়-ছোড সব এক দামে কিনতে অয়। ছোডর যেই দাম বড়ও হেই দাম। এক মণ কিনতে ১৮০০-১৯০০ ট্যাকা লাগে। কেজিতে ৪০ থেকে ৪৫ ট্যাকা খরচ অয়। লাভ না করলে খামু কী?’
পিস বা কেজির বিতর্ক নয়, ক্রেতারা চান কম দাম
তরমুজ কিনতে আসা আজমল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেজির পরিবর্তে পিসে তরমুজ বিক্রি হলে কম দামের আশা করেছিলাম। কিন্তু যে লাউ সে কদু। আগে যে দাম ছিল এখনও তাই। তরমুজ পুরোটাই পানি তিন জনের ছোট ছোট পরিবারের জন্য কিনতে গেলেও ৫ কেজির নিচে হয় না। ৩০০ টাকার বেশি খরচ পড়ে। আর ৫ জন হলেও ৫০০ টাকা। যে দাম তাতে নিম্ন আয়ের মানুষ তো খেতে পারছেই না, মধ্যবিত্তরাও কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ বছর দেশে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। এর প্রায় ৬২ শতাংশ হয়েছে বরিশাল বিভাগে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় হেক্টরপ্রতি গড়ে ৫০ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদিত হয়েছে, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বেশি।
মাঠে দাম কত?
খুলনার উপজেলা বটিয়া ঘাটা গঙ্গা রামপুর গ্রাম দেব প্রদাস এবং গাউঘরা গ্রামের ফরিদ রানা জানান তারা এখন এক বিঘায় তরমুজ বিক্রি করছেন ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায়। এক বিঘায় ১৪০০ থেকে ১৫০০ তরমুজ হচ্ছে।
এসব তরমুজ আকারে কিছুটা ছোট। প্রতিটি তিন কেজির মতো হচ্ছে এসব তরমুজ। তবে প্রথম দফায় ক্ষেত থেকে একই পরিমাণ বড় তরমুজ প্রতি বিঘা এক লাখ ২৫ হাজার টকায় বিক্রি হয়েছিল।
খুচরায় কেজি দরে বিক্রি হলেও পাইকারিতে ‘শ’ হিসেবে বিক্রি হয়। খুলনায় আড়ত পর্যায়ে থেকে পাঁচ থেকে ছয় কেজি ওজনের তরমুজের প্রতিশ ১২ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ কেজি ওজনের তরমুজ বিক্রি হয়েছে ২২ হাজার থেকে ২৩ হাজার টাকায়।
বরিশাল সদর উপজেলার বালিয়াতলী ইউনিয়নের চালিতাতলী এলাকার চাষি মোজাম্মেল হোসেন জানান, তিনি ৩৬ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। ক্ষেত থেকে ৩১ লাখ টাকায় ফসল বিক্রি করেছেন। মোট ২৫ হাজারের মতো তরমুজ গড়ে ছোট বড় গড় প্রতিটা তরমুজ বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়।