পাকা ধানে নুয়ে আছে গাছ। সবুজের বুকে এখন তাই সোনালি আভার আধিক্য। বাতাসে ভেসে আসা শিষের শব্দে আনন্দিত চাষি। তার হাসির ঝলক ফসলের মাঠ থেকে ছড়িয়ে পড়ে নীল দিগন্তে।
এই দৃশ্য হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের। বোরো ফসল ঘরে তুলতে শুরু করেছেন চাষিদের কেউ কেউ। ধান কাটা নিয়ে তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে ভীষণ।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফল হয়েছে। তবে শ্রমিক-সংকট ভাবাচ্ছে চাষিকে। যদিও কৃষি বিভাগ বলছে, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ফসল কাটতে বিতরণ করা হয়েছে শতাধিক ধান কাটার যন্ত্র।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গেল বছর হবিগঞ্জে ১ লাখ ২১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এ বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ১৩০ হেক্টরে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার ১ হাজার ৩৩০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে।
জেলায় চলতি বছর বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ১৪ হাজার টন। যা গত বছর ছিল ৫ লাখ ৫ হাজার টন। চলতি বছর ৯ হাজার টন ধান বেশি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং ও লাখাই উপজেলার হাওর ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন হাওরে শ্রমিকরা ধান কাটছেন।
কথা হয় আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা গ্রামের কৃষক হোসেন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি ৬০-৭০ কের (২৮ শতকে ১ কের) জমি করছি। এর মধ্যে ২০-২৫ কের জমিতে কারেন্ট পোকায় ধরছে। এ ছাড়া বীজও বালা পড়ছে না। যে কারণে জমিত ধান কম হইছে।’
তিনি বলেন, ‘যাঅই ধান হইছে- ইতা ঘরে তুলা নিয়াও এখন দুশ্চিন্তায় আছি। শ্রমিকসংকটের কারণে ধান কাটতে পারতেছি না। ই-বছর বাহির থেকে শ্রমিক আইছে না, এলাকার শ্রমিকরাও রোজা রাইখা ধান কাটতে চায় না।’
তবে তিনি ছাড়া আর কোনো কৃষক ফলন কম হওয়া বা পোকার আক্রমণের অভিযোগ করেননি।
আগাম বন্যার শঙ্কায় নেত্রকোণার হাওরাঞ্চলর কৃষকদের ২৫ এপ্রিলের মধ্যে ৮০ শতাংশ ধান কাটার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি বিভাগ। এই খবর জেনেছেন হবিগঞ্জের চাষিরাও। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয়ার আগেই ফসল বিক্রি করতে চান তারা।
বানিয়াচং উপজেলার কাগাপাশা গ্রামের কৃষক মোতাহের মিয়া বলেন, ‘আমি অত বড় কৃষক না। ১৫-২০ কের ক্ষেত করছি। এখন কামলা না থাকায় এক কের ক্ষেতের ধানও কাটতে পারতাছি না। রাতে ঘুম আয় না, কখন ঝড়-তোফান আয়, শিলা বৃষ্টি আয়। পুলাপুরি (ছেলে-মেয়ে) নিয়া নিজে নিজেই কিছু কাটতাছি।’
আরেক কৃষক মো. রুবেল মিয়া বলেন, ‘আমার অনেকগুলা ক্ষেতের ধান পাইখা গেছেগা। কিন্তু কামলা (শ্রমিক) না পাওয়ায় ধান কাটতে পারতাছি না। গ্রামের কামলার কাছে গেলে কয় রোজার মাঝে তারা ধান কাটত না। আবার হবিগঞ্জের বাহির থাইকাও এ বছর কোনো কামলা আইছে না। এখন কীভাবে ধান কাটতাম বুঝতে পারতাছি না।’
দাম নিয়ে শঙ্কা
ভালো ফলন হওয়ায় ধানের দাম নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক কৃষক। তারা বলছেন, যে বছরই ধানের ভালো ফলন হয় সেই বছরই ধানের দাম কম থাকে।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকাইলছেও এলাকার কৃষক মতিন মিয়া বলেন, ‘এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে বছর ধানের ভালো ফলন হয় এই বছর ধানের দাম কম থাকে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে আমাদের কৃষকদের কথা মাথায় রেখে যেন ধানের দামটা ঠিক রাখা হয়।’
বানিয়াচং উপজেলার হারুণী গ্রামের কৃষক সুশীল দাস বলেন, ‘জমি করতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়। আমাদের সারা বছরের পরিশ্রমের একমাত্র সম্ভল এই ধান। কিন্তু ধানের দাম যদি ঠিক না তাকে তহলে আমরা কীভাবে বাচমু। গেল কয়েক বছর ধরে বোরো চাষ করে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে আমরা যেন ধানের ন্যায্য দাম পাই।’
একই উপজেলার সুজাতপুর গ্রামের কৃষক মঈন উদ্দিন বলেন, ‘শ্রমিকরা রোজার কারণে ধান কাটতে চায় না। যারা কাটতে রাজি হন, তারা আবার দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরি চায়। এর কের ক্ষেতের ধান কাটতে লাগে ৫-৬ জন শ্রমিক। আর এক কের জমি কইরা ২০ মণ ধান পাওয়া যায়। তাহলে আমারা কৃষকরা কীভাবে লাভবান হইতাম।’
তিনি বলেন, ‘সরকার যদি ধানের দাম ঠিক রাখে তাহলে কিছুটা লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। না হলে আমাদের পথে বসা ছাড়া কোনো গতি নাই।’
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. তমিজ উদ্দিন বলেন, ‘এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। অন্য বছর ধান কাটার শ্রমিক-সংকট হলেও এ বছর তা হবে না। জেলায় স্থানীয় শ্রমিক রয়েছে ২০ হাজার ৫০০ জন এবং বাহির থেকে আনা হয়েছে ৬ হাজার ১০০ জন শ্রমিক। স্থানীয় ও বাইরের শ্রমিক মিলিয়ে ২৬ হাজার ৫০০ শ্রমিক রয়েছে। এ ছাড়া গেল বছর এবং চলতি বছর মিলিয়ে জেলায় ১০৩টি হারভেস্টার মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। যেগুলো পুরোদমে ধান কাটার কাজ করছে। এরপরও কেন কৃষকরা শ্রমিক-সংকট বলে আমি বুঝতে পারছি না।’
ধানের দাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গত বছর ধানে অনেক দাম ছিল। ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে। সুতরাং এ বছরও ধানের দাম ঠিক থাকবে। দাম নিয়ে কৃষকদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।