বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে মাটি কেটে উদ্বোধন করা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বদলে দিয়েছে পাবনার কৃষি অর্থনীতি। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মুজিববাঁধ রক্ষাকবচের মতো কাজ করছে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করছে লাখো মানুষের জীবন ও সম্পদ।
মুজিববাঁধের কল্যাণে জেলার সুবিশাল ভূমি হয়েছে বন্যামুক্ত, কৃষিতে এসেছে সমৃদ্ধি।
প্রমত্তা পদ্মা ও যমুনা নদী দিয়ে ঘেরা পাবনা জেলাকে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে আগলে রেখেছে প্রায় ১৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মুজিববাঁধ। মৌসুমি বন্যায় তো বটেই, ১৯৮৮ সাল কিংবা ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায়ও এখানে লাখো মানুষের ফসল ও সম্পদরক্ষায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে বাঁধটি।
মুজিববাঁধ নির্মাণের আগে প্রতিবছর বন্যায় সহায়সম্বল ও ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হতো এই অঞ্চলের লাখো মানুষ। ৫০ ও ৬০-এর দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবনার নগরবাড়ী ঘাট হয়ে উত্তরবঙ্গে রাজনৈতিক সফরে এসে নিজে দেখেছেন সেই দুর্দশার চিত্র।
তিনি ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বেড়া উপজেলার বসন্তপুরে নিজে মাটি কেটে উদ্বোধন করেন বন্যা নিয়ন্ত্রণের এই বাঁধ নির্মাণ। জনসভায় বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ায় আত্মনিয়োগের আহ্বান জানান সাধারণের মানুষের প্রতি। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার জাদুকরি ডাকে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ। স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ শেষে, কৃতজ্ঞতায় তারাই নাম দেন মুজিববাঁধ।
পদ্মা ও যমুনা ঘেরা পাবনাকে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে আগলে রেখেছে প্রায় ১৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মুজিববাঁধবাঁধ নির্মাণের পর জেলায় প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর জমি বন্যার কবল থেকে বাঁচে। জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেয়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮১২ হেক্টর জমি এক ফসলি থেকে হয়েছে তিন ফসলি।
জাতির পিতার দূরদর্শিতায় কৃষি অর্থনীতিতে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ঘাটতি পূরণ করে উদ্বৃত্ত খাদ্যে পাবনা পরিণত হয় শস্যভান্ডারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশে খাদ্যের অভাব দূর করার লক্ষ্যে বাঁধটি নির্মাণ করেনএলাকার বাসিন্দারা নিউজবাংলাকে বলেন, বাঁধ নির্মাণের আগে তাদের বিস্তৃত এলাকা পানিতে ডুবে যেত। বাড়িঘর, কৃষিজমি পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো। কিন্তু এই বাঁধ নির্মাণের পর থেকে তারা ফসলের আবাদ করে ঘরে তুলতে পারছেন।
তারা আরও বলেন, ‘এই বাঁধ নির্মাণের ফলে আমাদের এলাকায় উন্নয়নের ব্যাপক ছোঁয়া লেগেছে।’
বেড়া উপজেলার আমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ছয়টি ওয়ার্ডই বাঁধের বাইরে। আমার এলাকাবার গরিব দুঃখী মানুষের একমাত্র ভরসা এই মুজিববাঁধ।’
১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বেড়ার বসন্তপুরে এই বাঁধ উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুর কাদের বলেন, পাবনা জেলা একসময় বন্যাকবলিত ছিল। সেই সময়ে কোনো ফসলই হতো না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশে খাদ্যের অভাব দূর করার লক্ষ্যে বাঁধটি নির্মাণ করেন। এই মুজিববাঁধ নির্মাণ করায় বন্যার সময় অতিরিক্ত পানি বেড়া উপজেরার কৈটুলা পাম্পের মাধ্যমে যমুনা নদী দিয়ে বের করে দেয়া সম্ভব হয়। এর ফলে জেলায় ১ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমির মধ্যে ৯০ হাজার হেক্টরে বছরে তিন দফা ফসলের আবাদ হয়। ফলনও হয় ভালো।
অন্যদিকে বোরো মৌসুমে খুব সস্তায় এই পাম্পের মাধ্যমে পানি ওঠানোর ফলে জমিতে সরাসরি সেচ দেয়া যায়। এতে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের অতিরিক্ত চাষ করা যায়। সবজি থেকে শুরু করে পেঁয়াজ, রসুনের চাষ হয়।
মুজিববাঁধ জেলার সুবিশাল ভূমিকে করেছে বন্যামুক্ত, সমৃদ্ধি হয়েছে কৃষিকৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুর কাদের বলেন, ‘আগে মানুষের খুব অভাব অভিযোগ ছিল। এখন মানুষের কোনো অভাব নাই। বছরে তিনটি সফল উৎপাদন করে সবাই। এতে অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।’
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুফল ধরে রাখতে, মুজিববাঁধটির সময়োপযোগী ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।