কয়েক জেলায় শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধান, লেবুসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জে সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোরের মধ্যে বিভিন্ন সময় ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়। কোথাও কোথাও প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে শিলাবৃষ্টি।
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচংয়ে মঙ্গলবার ভোরে প্রায় ঘণ্টাখানেক কালবৈশাখীসহ হয় শিলাবৃষ্টি। এতে হাওরের বোরো ধানের গাছ ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়।
সবচেয়ে বেশি ফসলের ক্ষতি হয়েছে বানিয়াচং উপজেলার আড়িয়ামুকুর হাওর, হারুণী হাওর, কাটখালী হাওর, আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বদলপুর হাওর, ভেড়ারডোর হাওর, চর ভেড়ারডোর হাওর ও পাহারপুর হাওর এলাকায়।
তবে কৃষি বিভাগের দাবি, শিলাবৃষ্টিতে ফসলের তেমন ক্ষতি হয়নি।
বানিয়াচং উপজেলার কৃষক ব্রজেন্দ্র দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অখনও (এখনও) জমিত ধান আইছে না (আসেনি)। কিন্তু গতকাল রাত্রে পাথর পইরা (শিলা বৃষ্টিতে) সব গাছ নষ্ট হইয়া গেছেগা। কোন কোন (কোনো কোনো) জমির ধানগাছগুলো একবারে গুড়িত ভাইঙা শেষ। ইতাত আর ধান আইত না।’
একই গ্রামের কৃষক মতিলাল দাস বলেন, ‘আমার দুই আল (৪৫৬ শতক) জমি একবারে নষ্ট হইয়া গেছেগা। এই জমির ধান দিয়া আমার জীবন চলে। পুলাপানরে লেখাপড়া করাই। অখন নিজেই কিতা খাইমু, পুলাপানরে কইতিক্কা লেখাপড়া করামু বুঝতেছি না।’
বদলপুর এলাকার কৃষক আহাদ আলী বলেন, ‘রাতে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। সঙ্গে বড় বড় শিলাবৃষ্টিও শুরু হয়। সকালে হাওরে গিয়া দেখি জমিগুলো একেবারে মাটির সঙ্গে মিশাইলাইছে। এই জমিগুলা থাইক্কা আর ধান পাওয়ার আশা নাই।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ তমিজ উদ্দিন বলেন, ‘শিলাবৃষ্টি হয়েছে। তবে জমির তেমন ক্ষতি হয়নি। আমাদের মাঠকর্মীরা হাওরে রয়েছেন। তারা এলেই আসলে ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানা যাবে।’
নেত্রকোণায় শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধান, সবজি ছাড়াও লিচু ও আমের মুকুলের ক্ষতি হয়েছে।
জেলার সদর, কলমাকান্দা, মদন, খালিয়াজুরি ও পূর্বধলা উপজেলায় মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা থেকে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে শিলাবৃষ্টি।
স্থানীয় লোকজন জানান, বেশি ক্ষতি হয়েছে সদর উপজেলায়। এর মধ্যে অনন্তপুর, ফচিকা, দেওপুর, বালি এলাকায় অনেক বাড়ির টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে।
শিলাবৃষ্টিতে ফুটো হয়ে গেছে টিনের চাল। ছবি: নিউজবাংলা
অনন্তপুর গ্রামের আছিয়া বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভোরে পয়লা (প্রথমে) বৃষ্টি পড়তে থাকলেও শিল আছিলনা। কিছুক্ষণ পরেই শিল পড়া আরম্ভ হইছে। ছয় থেকে সাত মিনিট পড়ছে। চাল ভাইঙ্গা ছিদ্রি কইরালছে। তহন ঘরের ভিতরে শিল পড়ছে।’
একই গ্রামের কৃষক আইন উদ্দিন বলেন, ‘আমার সবজি ক্ষেতের গাছ মাটিতে মিশাইয়া ফালাইছে।’
দেওপুর গ্রামের কৃষক রফিক মিয়া। জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বৃষ্টিটা বোরো ফসলের লাইগ্যা ভালোই হতো। কিন্তু পাথর পইরা ধান গাছের গজানো শিষ নষ্ট অইয়া গেছে।’
ফচিকা গ্রামের কৃষক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘এইবার আম ও লিচুগাছে ফলন ভালো অইতো। অনেক মুকুল ধরছিল। কিন্তু শিলে অনেক ক্ষতি অইছে। মুকুল পইরা গেছে। গাছে যা আছে ওইগুলাতেও ফলন অইব না। শিলের আঘাতের লাইগা টিকব না।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাবিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলার সদরসহ পাঁচ উপজেলায় শিলাবৃষ্টি হয়েছে। তবে সদরের তিন-চারটা গ্রামে বেশি শিলাবৃষ্টি হওয়ায় আম, লিচুর ক্ষতি হয়েছে।’
তবে বোরো জমির গাছ এখনও কোশা অবস্থায় ও সবজি মৌসুম শেষ দিকে থাকায় তেমন ক্ষতি হয়নি বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
এদিকে শিলাবৃষ্টিতে মৌলভীবাজারে লেবুবাগানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই জেলায় প্রায় তিন হাজার কৃষক লেবু চাষের সঙ্গে জড়িত। ফসলের ক্ষতি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা।
সোমবার রাতে মৌলভীবাজারে ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হওয়ায় ঝরে পড়েছে বাগানের লেবু। কিছু কিছু লেবুতে শিলের আঘাতে গর্ত তৈরি হয়েছে। কৃষকরা জানান, এই লেবুগুলোও কদিনের মধ্যে ঝরে পড়বে। এ ছাড়া কিছু কিছু গাছও প্রায় উপড়ে গেছে।
লেবুচাষি শামছুল হক, অনিরুদ্ধ সেন ও রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, তাদের কারও ৬০ কেদার, কারও কারও ৫০ কেদার করে লেবুবাগান রয়েছে। কিন্তু শিলাবৃষ্টিতে বাগানের ৪০ শতাংশ লেবু ও ২০ শতাংশ গাছ নষ্ট হয়ে গেছে।
তারা বলেন, সারা বছর কষ্ট করে গোবর, পানি সেচ দিয়ে চাষ করেছেন। এই সময়ে লেবু বিক্রির উপযোগী হয়, আর এখনই এই ক্ষতি হলো।
তারা আরও জানান, সামনে রমজান মাসে প্রতিটি লেবু ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হতো। কিন্তু ঝড় তাদের স্বপ্ন ভেঙে দিল।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, শ্রীমঙ্গলে ১ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হয়। লেবুচাষি আছেন ৩ হাজার ১৬৫ জন।
লেবুচাষি কাজল রায়, হারভিন ভর ও মনা সাঁওতাল নিউজবাংলাকে জানান, তারা অল্প পরিসরে ২০ থেকে ২৫ কেদার জায়গাতে লেবু চাষ করেন। কারও কিছু নিজের জমি আছে, আবার কারও বর্গা নেয়া জমি। অনেকেই ঋণ নিয়ে লেবু চাষ করেছেন। কিন্তু শিলাবৃষ্টিতে লেবুর এত ক্ষতি হওয়ায় কীভাবে ঋণ শোধ করবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না এই চাষিরা।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াসমিন মোনালিসা সুইটি নিউজবাংলাকে জানান, শিলাবৃষ্টিতে কত হেক্টর জমির লেবু নষ্ট হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি।
এর আগে সোমবার আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, সোমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট বিভাগ ও কুমিল্লা জেলার দুই-এক জায়গায় দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।