পটুয়াখালীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক চর জাহাজমারা। মানুষের আনোগোনা তেমন না থাকায় চাষবাসও কোনোদিন এখানে হয়নি। সেই জমিই এখন ছেয়ে গেছে সবুজে। পাতার মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে তরতাজা তরমুজ।
এই চরের অবস্থান রাঙ্গাবালী উপজেলার মৌডুবী ইউনিয়নে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী তরমুজ চাষের জন্য উপযোগী। আর এই জেলায় উৎপাদিত তরমুজের অর্ধেক পাওয়া যায় রাঙ্গাবালীতে। রাঙ্গাবালীর অধিকাংশ মানুষ তরমুজ চাষের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত।
কৃষকরা জানান, পটুয়াখালীর কৃষি অনেকটাই আমন ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল। ডিসেম্বরে আমন ধান ঘরে তোলার পর জানুয়ারি থেকে তরমুজের আবাদ শুরু হয়। এপ্রিল মাসে ক্ষেতের তরমুজ বাজারে বিক্রি শুরু হয়।
কিন্তু জাহাজমারা চরে অন্য কোনো ফসলের আবাদ করা হতো না। চরের এই পোড়ো জমিতে চাষিরা বেশি লাভের আশায় গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আগাম তরমুজের আবাদ শুরু করেন।
জাহাজনামা চরসহ একই উপজেলার কলাগাছিয়া চরেও বালুর মধ্যে আগাম তরমুজ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন ভূমিহীন কৃষকরা। এই দুটি চরের প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে এ বছর আগাম তরমুজ চাষ হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি অফিস।
তরমুজ খেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক ফারুক হোসেন। ছবি: নিউজবাংলাভরদুপুরে মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য, পায়ের নিচে গরম বালু। এর মধ্যেই জাহাজনামায় তরমুজ ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক ফারুক হোসেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত হাত-আষ্ট (সাত-আট) বছর মানষের জমিতে তরমুজের চাষ হরছি (করেছি)। ছিজন শ্যাষে আতে টাহা ত্যামন থাকতো না। হ্যারপর চিন্তা হরছি মোর নিজের যদি এট্টু জমি থাকতো হ্যারে (তাহলে) ভালো অইতো। দুইডা টাহা বেশি পাইতাম।’
আফসোস করে ফারুক বলেন, ‘কিন্তু তা মোর কপালে নাই। মুই (আমি) থাহি আবাসনে। ঊনিশ সালে এক বেডায় এইহানে (জাহাজনামা সৈকত) ঘুরতে আইছিল। হেই বেডায় মোরে কইছিল যে, এই বালিতে তরমুজ লাগাইলে ভালো অয়।’
চরের পাশে বেড়িবাঁধের ধারে সরকারি আবাসন প্রকল্প এলাকায় থাকেন ফারুক। তার উদ্যোগে উপজেলা কৃষি বিভাগের পরামর্শে আবাসনে বসবাসকারীরা এই বালুচরে আগাম তরমুজের আবাদ শুরু করেন। প্রতিদিন তারা ভোরবেলা চরে আসেন। সারা দিন কাজ শেষে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরেন।
ফারুক বলেন, ‘গেলবার মোর তিন লাখ টাহা লাভ অইছিল কিন্তু এবার বৃষ্টি না অওয়ায় আর মিডা পানির অভাবে ফলন নিয়া মুই ট্যানশনে আছি।’
স্ত্রী হাসি বেগম আর সন্তান রুবেলকে নিয়ে ফারুক দিনভর পরিচর্যা করে যাচ্ছেন তার সাত একর জমিতে করা তরমুজের। অনাবাদি জমি হওয়ায় তরমুজ আবাদে খরচও অনেক কম হয়েছে।
এখন পর্যন্ত তার সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। বিক্রি করতে পেরেছেন ৩৭ হাজার টাকার তরমুজ।
মিঠাপানির তীব্র সংকটে চাষিরা
তরমুজচাষে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ মিঠাপানি। সেজন্য চাষিরা ডিসেম্বর থেকেই বালুচরের মধ্যে বড় বড় কূপ খনন করে সেখানে বৃষ্টির পানি জমা করেন। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুরোটা সময় তরমুজ গাছের গোঁড়ায় সেই মিঠাপানি দিতে হয়। এর ফলে গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং অল্প সময়ে গাছে তরমুজ ধরে।
কিন্তু এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ পানি সংগ্রহ করতে পারেননি চাষিরা। মিঠা পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে জাহাজমারা আর কলাগাছিয়া চরে। পানি সংকটে দুশ্চিন্তায় আছেন তরমুজ চাষিরা।
আবাসনে বসবাসকারী মোহন গাজী বলেন, ‘কুয়ায় যেডু (যতটুকু) পানি আছে হ্যাতে (তাতে) হাত-আষ্ট দিন যাইতে পারে। হ্যার মধ্যে সব তরমুজ ওঠবে না।’
মোহন গাজীর মতে, একদিকে সাগরের লোনা পানি, আরেকদিকে ঘের সেখানেও লবণ পানি। দুই পাশে লবণাক্ততার কারণে গাছগুলো মরে যাওয়া শুরু করেছে। যে কারণে এ বছর লোকসান গোনার আশঙ্কা করছেন তিনি।
পাঁচ একর জমিতে এবার মোহন তরমুজ চাষ করেছেন। খরচ হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পেরেছেন।
সোমবার দুপুরে জাহাজমারা চরে চাষিদের সঙ্গে পরামর্শ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাঙ্গাবালী উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
তিনি নিউজবাংলাকে জানান, মিঠাপানির সংকট সরেজমিন পরিদর্শনেও পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ওপর মহলের সঙ্গে আলাপ করে যাতে এখানকার চাষিরা পর্যাপ্ত মিঠাপানি পায় সে ব্যবস্থা করবেন।
তিনি আরও জানান, গত বছরের মতো এ বছরও জাহাজমারা চরের ৩০ জন চাষিকে বিনা মূল্যে সার, বীজ, কীটনাশক দেয়া হয়েছে।
গাছের গোঁড়ায় দেয়ার জন্য কুয়া থেকে কলসিতে পানি নিচ্ছিলেন জুলেখা বেগম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই রৌদ্দের মধ্যে এত কষ্ট হইরা (কইরা) যদি দুডা টাহা না পাই হ্যারে মনডায় ক্যামন লাগে কন? আম্মেরা দোয়া হলেন (করেন) মোর ফসলডু য্যান ভালো দামে ব্যাচতে পারি।’
জুলেখার স্বামী ফেরদৌস প্যাদা জানান, ৩ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। সোয়া লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তরমুজ বিক্রির টাকা সমান সমান হয় কি না সন্দেহ।
তরমুজ চাষি দম্পতি জুলেখা বেগম ও ফেরদৌস প্যাদা। ছবি: নিউজবাংলাঅধিকাংশ কৃষকের দাবি, সরকার যদি এই সব এলাকায় সেচের ব্যবস্থার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তাদের অভাব অনটন দূর হবে।
রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, একাধিক চর ও নৌপথে যোগাযোগ সহজলভ্য হওয়ায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এই উপজেলায় তরমুজ চাষ। এ বছর রাঙ্গাবালীতে ৭ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১০০ হেক্টর বেশি।
তিনি আরও জানান, চাষিদের জন্য প্রয়োজনীয় মিঠাপানি সরবরাহের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ হৃদয়েশ্বর দত্ত নিউজবাংলাকে বলেন, গত বছর জেলায় প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছিল। এতে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদন হয়।
এ বছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদন হতে পারে বলে তিনি আশা করেন।