তালেবান রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নেয়ায় আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে ভারতের বিনিয়োগও ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তালেবান শাসনে ‘কূটনীতি’ পাকিস্তানমুখী হবে বলেই ধরে নিচ্ছে ভারত। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা না হলেও ভারতের বিভিন্ন মহলে চলছে নানা জল্পনা।
তালেবানের এক মুখপাত্র এরই মধ্যে বলেছেন, তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক চায়।
তবে গোষ্ঠীটি দেশ শাসন শুরু না করা পর্যন্ত সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে সন্দিহান ভারতসহ অনেকেই।
ভারতের বাণিজ্য ও কূটনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সশস্ত্র সদস্যরা আফগানিস্তান ছাড়লেও ভারত তা করতে পারছে না। গত দুই দশক ধরে কৌশলগত প্রতিবেশী আফগানিস্তানে বিপুল সহযোগিতা ও বিনিয়োগ করেছে ভারত। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ ও কূটনৈতিক অঙ্ক একে অন্যের পরিপূরক। তাই যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো প্রস্থানের ঘটনা আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তা দেখার বিষয়।
গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত। এ বিনিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আমল থেকে। তা চলমান ছিল।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে আফগানিস্তান শাসন করে তালেবান। তাদের শাসনামল শেষ হলে ভারত আফগানিস্তানে সম্পর্ক ফের প্রতিষ্ঠা করে যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ায়। সে সময় সেনা না পাঠিয়ে আফগানিস্তানকে উন্নয়নমূলক কাজে সহায়তা দিয়েছিল ভারত।
আঞ্চলিক পরাশক্তিটির বিষয়ে তালেবান মুখপাত্র শাহীন সুহেল বলেন, ‘ভারত আফগানিস্তানের উন্নয়নে অনেক কাজ করেছে, সে জন্য ওদের অভিনন্দন।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে রোববারের ঘটনা পরিক্রমা পাকিস্তানের পালে হাওয়া দিচ্ছে বলেই মনে করছে ভারত। কারণ গত ২০ বছরের একটা বড় সময় তালেবান নেতৃত্ব পাকিস্তানের গোপন আস্তানায় থেকেছে। তালেবানের জয় মূলত পাকিস্তানের জয়।
ভারত ২০১১ সালের কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তির পর আফগানিস্তানকে পুনর্গঠনে সহায়তা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জেনেভায় আফগানিস্তান সম্পর্কিত সম্মেলনে গত বছর নভেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে এমন একটাও প্রদেশ নেই, যেখানে উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ভারত কাজ করছে না। ছোট-বড় ৪০০টি প্রকল্পে কাজ করছে ভারত।’
২০১৫ সালে কাবুলে আফগানিস্তানের সংসদ ভবন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এটির নির্মাণকাজ করে ভারত। সেখানে ৯০০ মিলিয়ন (৯০ কোটি) ডলার খরচ হয়েছে। এ ছাড়া ভারত আফগানিস্তানে বিভিন্ন অবকাঠামো এবং বাণিজ্যিক প্রকল্পে ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলার বিনিয়োগ করেছে।
আফগানিস্তানকে রাস্তাঘাট, বাঁধ, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন এবং সাবস্টেশনের মতো মূল অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করেছে ভারত। দেশটি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সৌর প্যানেল তৈরি করেছে এবং আফগানিস্তানে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক পুনরুদ্ধার করেছে।
এ ছাড়া ভারত আফগানিস্তানকে প্রযুক্তিগত সহায়তা, অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রকল্পগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে আসছে।
আফগান-ভারত মৈত্রী বাঁধ প্রকল্প (হেরাত প্রদেশে ৪২ মেগাওয়াট সালমা বাঁধ প্রকল্প) দুই জাতির সম্পর্কের প্রতীক। ভারতের সীমান্ত সড়ক সংস্থা নির্মাণ করেছে আফগানিস্তান-ইরান সীমান্তের কাছে জারাঞ্জ-দেলারাম হাইওয়ে প্রকল্প। এর দৈর্ঘ্য ২১৮ কিলোমিটার। সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৫০ মিলিয়ন (১৫ কোটি) ডলার।
এ সড়কটি কৌশলগতভাবে শুধু আফগানিস্তানের জন্য নয়, ভারতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
সীমান্তবর্তী শহর জারাঞ্জকে দেলারাম শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে যে সড়ক তা ইরানের সীমান্ত এবং আফগানিস্তানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিন শতাধিক ভারতীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিক আফগানদের সঙ্গে মিলে রাস্তাটি নির্মাণ করেছেন।
স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তান মূলত পাকিস্তানের মাধ্যমে ট্রানজিটে নির্ভরশীল। ভারতের এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ তাদের বিকল্পকে সহজ করে তোলে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকাশনা অনুযায়ী, নির্মাণের সময় ১১ জন ভারতীয় এবং ১২৯ জন আফগান প্রাণ হারিয়েছেন। সন্ত্রাসী হামলায় ছয়জন ও দুর্ঘটনায় পাঁচজন ভারতীয় নিহত হন। এটি এমন একটি প্রকল্প যাতে কাবুল ও নয়াদিল্লি উভয়েই খুশি।
জারাঞ্জ-দেলারাম সড়ক একটি উন্নত অবকাঠামো শৃঙ্খলার অংশ হয়ে উঠবে বলেই ধারণা, যা ইরানের চাবাহার বন্দর থেকে দেলারাম পর্যন্ত পৌঁছাবে। রাস্তাটি নির্মাণের জন্য ভারতীয় সহযোগিতা ও বিনিয়োগ ছিল তালেবানের অনুপস্থিতিতে। এ কারণে তালেবান সরকার রাস্তাটি ব্যবহারে ভারতকে সুযোগ দেবে কি না তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
জেনেভা সম্মেলনে গত বছর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রমানিয়াম জয়শঙ্কর জানান, কাবুলে শাতুত বাঁধ নির্মাণের জন্য ভারত একটি চুক্তি সম্পন্ন করেছে, যা ২ কোটি বাসিন্দাকে নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ করবে। এ ছাড়া তিনি ৪০০ মিলিয়ন (৪০ কোটি) ডলার মূল্যের ১০০টি কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট শুরুর ঘোষণা দেন।
গত বছর ভারত আরেকটি আগা খান ঐতিহ্য প্রকল্পের জন্য ১০ মিলিয়ন (এক কোটি) ডলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কাবুলের দক্ষিণে বালা হিসার দুর্গ পুনঃস্থাপনের এ প্রকল্প। এর উৎপত্তি ষষ্ঠ শতাব্দীতে।
বালা হিসার একটি গুরুত্বপূর্ণ মোগল দুর্গে পরিণত হয়েছিল। এর কিছু অংশ সম্রাট জাহাঙ্গীর পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। এটি শাহজাহানের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল।
পাকিস্তান একটি স্থলপথ প্রত্যাখ্যান করলেও ২০১৭ সালে একটি বিমান মালবাহী করিডোর স্থাপনের মাধ্যমে ভারত-আফগানিস্তান বাণিজ্য বেড়েছে।
আফগান সরকারের কর্মকর্তারা কিছুদিন আগে মুম্বাইয়ে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বাণিজ্য পরিস্থিতি নিয়ে ধারণা দেন।
তারা জানান, ২০১৯-২০ মেয়াদে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১.৩ বিলিয়ন (১৩০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ভারত থেকে রপ্তানির মূল্য প্রায় ৯০০ মিলিয়ন (৯০ কোটি) ডলার। ভারতে আফগানিস্তানের রপ্তানি প্রায় ৫০০ মিলিয়ন (৫০ লাখ) ডলার।
আফগানিস্তানে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, কম্পিউটার, সিমেন্ট ও চিনির মতো পণ্য রপ্তানি করে ভারত। অন্যদিকে আফগানিস্তান থেকে ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে ভারত। এসব পণ্যের বেশির ভাগ তাজা ও শুকনা ফল।