বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আফগানিস্তানে আফিম নির্মূল কেন অসম্ভব?

  •    
  • ২২ আগস্ট, ২০২১ ১৫:৪৮

যুক্তরাষ্ট্রের ধারণার চেয়েও বেশি আফগানিস্তানকে বুঝতে পেরেছে তালেবান। তালেবান ভালোভাবেই জানে, পপিকে নিষিদ্ধ করলে তা গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর তাই দেশটিতে পপি চাষের ভবিষ্যৎ অজানা।

আফগানিস্তানে পপি চাষ নিয়ে আমেরিকাকে কম মাথা ঘামাতে হয়নি। একটা পর্যায়ে একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেও খুব একটা লাভ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ও আফগানিস্তানের পপি চাষ যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটি উঠে এসেছে সংবাদ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ভিত্তিক ওয়েবসাইট ভাইসের এক প্রতিবেদনে। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য সেটি অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।

২০০১ যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের আগে আফগানিস্তানে ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে পপি চাষ হতো। পপি গাছ থেকেই আফিম তৈরি হয়। আর আফিম থেকে তৈরি হয় হেরোইন ও অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্য। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের অনুমান, আফগানিস্তানে বর্তমানে ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে পপির চাষ হচ্ছে, যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেশি।দেশটি থেকে পপি গাছ উচ্ছেদ করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৮০০ কোটি ডলার খরচ করলেও লাভ হয়নি। উল্টো তাদের চোখের সামনেই এটি আফগানিস্তানের সবচেয়ে অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে বিশ্বের ৮২ শতাংশ পপি সরবরাহ করে আফগানিস্তান।আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য লড়াইগুলোর মতো (দক্ষিণ আমেরিকায় মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতো) পপির বিরুদ্ধে লড়াইও পুরোপুরি ব্যর্থ। পেন্টাগন শুধু মাদক উৎপাদক গাছটিকে নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, তারা এটি বিস্তারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও সৃষ্টি করে দিয়েছে। জাতিসংঘের অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম ও স্পেশাল ইনসপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশনের (সিগার) অসংখ্য প্রতিবেদনে মাদক নিষিদ্ধকরণে ব্যর্থতার কারণগুলো বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।পপি চাষের জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে আফগান যুদ্ধ। দেখতে একেবারে আলাদা একটি গাছ এটি। একে ব্যবহার বা বহন করার সময় বিশেষ এক ধরনের গন্ধ ছড়ায়, যে কারণে গোপন করা মুশকিল।প্রজেক্ট অন গভর্নমেন্ট ওভারসাইটে মিলিটারি ফেলো ও যুক্তরাষ্ট্র মেরিন বাহিনীর সদস্য হিসেবে ইরাক ও আফগানিস্তানে কাজ করা ড্যান গ্রেজিয়ার ভাইস নিউজকে বলেন, ‘বহিঃশত্রুর আক্রমণের পর যে ধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয় তা আফিম চাষের জন্য উপযুক্ত।’‘আর্থিকভাবে লাভযোগ্য পরিমাণের আফিম চাষের জন্য একটি একেবারে অকার্যকর সরকার দরকার পড়ে বা এমন এক দল লোকের প্রয়োজন হয়, যারা টাকার বিনিময়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকবে। আমাদের আক্রমণ দুটো পরিস্থিতিই (আফগানিস্তানে) তৈরি করে দিয়েছে। আমরা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে দেশটিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালছিলাম। লোকজনের চোখ সরানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ টাকা তখন আফিম উৎপাদনকারীদের হাতে ছিল।’সিগারের করা ২০১৮ সালের পপি চাষ সংক্রান্ত এক জরিপে দেখা যায়, গাছটি সম্বন্ধে ও এর চাষীদের কাছে এর গুরুত্ব কতটুকু সেটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিষ্কার ধারণা ছিল না। ফলে আফগানিস্তানের অন্য অনেক সমস্যার মতো গাছটিকে নিয়ে কী করা হবে তারা সেই কৌশল বদলাতে থাকে।সিগারের বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে, কোনো মাদক বিরোধী প্রকল্পই পপি চাষ বা আফিমের উৎপাদনকে কমাতে পারছিল না। নির্মূল প্রচেষ্টা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আর একই ভৌগলিক এলাকায় সহায়তামূলক টানা নির্মূল প্রক্রিয়া চলেনি। অন্যান্য সহায়ক কার্যক্রমগুলো ছিল একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। পপির স্থায়ী বিকল্প তৈরিতে ব্যর্থ হয় সেটি, এমনকি কখনও কখনও পপির উৎপাদন বাড়াতে সেগুলো ভূমিকা রাখে।এই ব্যর্থতার নিদর্শন হিসাবে অনলাইনে ফক্স নিউজের একটি ক্লিপ প্রায় দেখা যায়। যুদ্ধের শুরুর দিকে রেকর্ড করা ক্লিপটিতে দেখা যায়, এক মেরিনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সাংবাদিক জেরাল্ডো রিভেরা। ভিডিওটিতে সেই মেরিন সদস্য রিভেরার কাছে ব্যাখ্যা করেন, কেন স্থানীয় চাষীরা আমেরিকার চাহিদা অনুযায়ী শসা বা তরমুজ চাষের চেয়ে পপি চাষে বেশি আগ্রহী।রিভেরা বলেন, ‘আমরা পপি চাষ মেনে নিচ্ছি কারণ এখন যদি আমরা এগুলোকে ধ্বংস করি তাহলে জনতা মেরিনদের বিপক্ষে চলে যাবে, যা নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে।’ভিডিওতে রিভেরা একটি হাতে বানানো পপির চাঁছুনি দেখান। চাষের কাজে এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রিভেরার জানান, মেরিনরা যতগুলো চাঁছুনি পেয়েছেন তার সবগুলো বাজার থেকে কিনে এনেছেন।এক মেরিন সদস্য রিভেরাকে বলেন, ‘আমি চাচ্ছিলাম এগুলো যেন পাওয়া না যায়। মূল লক্ষ্যটি হলো, আমরা চাই না পপি চাষ করা হোক। আমরা চাই পপির জায়গা গম, তুলা, শসা বা তরমুজ নিক। এই শস্যগুলোও তারা এখানে চাষ করে।’দেশটিতে আমেরিকার হামলার পর পপি চাষ ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এটি আফগানদের জন্য ভালো ব্যবসা ছিল। সিগার জানায়, ২০১৭ সালের মধ্যে শুধু পপি চাষ ৫ লাখ ৯০ হাজার বেতনভুক্ত চাকরির সমান কাজের জায়গা তৈরি করে। যে সংখ্যাটা আফগান ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ফোর্সেসে কাজ করা লোকবলের চেয়ে বেশি।যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পরিস্থিতির কারণে আফিমের চাহিদা অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে যায়। হাইড্রোকোডোন, ফেন্টানাইল, অক্সিকোনটিনের মতো আফিমজাত মাদকের বিক্রি বাড়ায় নতুন আফিমের ক্রেতা তৈরি হয়। লোকে যখন প্রেসক্রিপশন হারিয়ে ফেলে বা আরও কঠিন নেশা করতে চায় তারা হেরোইনের দারস্থ হয়। আর আফগানিস্তানের পপি ক্ষেতগুলো তাদের চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত ছিল।

পপি থেকে আফিম তৈরি করছেন একজন আফগান কৃষক। ছবি: এএফপি

রাশিয়া বা ইউরোপে কেউ হেরোইন কিনলে সেটির জোগান আফগানিস্তান থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সিগারের অনুমান অনুযায়ী, কানাডায় জব্দ হওয়া প্রায় ৯০ শতাংশ হেরোইনের উৎস আফগানিস্তানের পপি ক্ষেত।যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক বছর পর যুক্তরাষ্ট্র মাদকবিরোধী অভিযানের উদ্যোগ নেয়। তারা দেখতে পায়, তাদের অনেক আফগান মিত্র এই ব্যবসায় জড়িত। সবাই এতো বেশি অর্থ উপার্জন করছিল যে আমেরিকানদের সঙ্গে মিলে গাছ ধ্বংস করার ইচ্ছা কারও ছিল না।২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিইএ) ও আফগান পুলিশ মিলে হেলমান্দ প্রদেশের গভর্নরের কার্যালয় থেকে ৯ টন আফিম জব্দ করে।২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পেন্টাগন পপি নির্মূলের দিকে মনোযোগ দেয়। ব্রিটিশরা ফসল ধ্বংস করে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে আগে চেষ্টা করেছে। আকাশ থেকে উদ্ভিদনাশক ছিটিয়ে পপি গাছ ধ্বংসের চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। এই পদক্ষেপ আফগানদের ক্ষেপিয়ে তোলে ও মিত্র বাহিনী ও তাদের আফগান মিত্রদের মধ্যে উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটায়।ওবামার জোরাজুরিতে ২০০৯ সালে মাদকবিরোধী কৌশল পালটে যায়। পপি চাষ কয়েকটি এলাকায় কমতে থাকে। এর মূল কারণ ছিল, গ্রামগুলোতে হাজারো আমেরিকান সেনার টহল। ক্ষেত ধ্বংস করে চাষীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার চেয়ে আমেরিকানরা চেষ্টা করে চাষীদের সয়াবিন ও গমের মতো ফসলের দিকে উৎসাহী করে তুলতে। এতে তারা ভর্তুকিও পেত, কিন্তু এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়।বাস্তবিক ভাবে পপি এমন একটি ফসল যেটির চাহিদা সবসময় বেশি থাকে ও সবসময় এটি বিক্রি করা যায়। জমির মালিক, ফসলের ভাগীদার ও আফগানিস্তানের শ্রম শক্তির বড় অংশ ভ্রাম্যমাণ শ্রমিক এবং তারা পপি চাষ করে প্রচুর অর্থ পেতেন।পপি চাষ করা আফগানিস্তানে অনেকের জন্যই ছিল দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলার উপায়। পপির মতো আর্থিকভাবে লাভজনক একটি ফসল বাদ দিয়ে গম বা অন্য কিছু চাষ করার কোনো কারণ তাদের কাছে ছিল না।এর চেয়েও খারাপ ছিল শীর্ষ পর্যায় থেকে কোনো একীভূত কৌশল না থাকা। সামরিক নেতৃত্ব নিজেদের উদ্যোগেই মাঝেমধ্যে মাদক নির্মূল অভিযান চালাত।সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে সিগার জানায়, ২০১০ এর বসন্তে ইউএস মেরিন ক্ষতিপূরণমূলক নির্মূল কার্যক্রম শুরু করে। এর নাম তারা দেয় মারাজ অ্যাক্সেলারেটেড আগ্রিকালচারাল ট্র্যানসিশন প্রোগ্রাম। তবে যেহেতু আগের ক্ষতিপূরণ নির্ভর নির্মূল অভিযানগুলো ব্যর্থ হয়েছিল, সেহেতু আন্তর্জাতিক মাদক ও আইন প্রণয়ন সংস্থা ও যুক্তরাজ্য সরকারের কাছ থেকে বিরোধিতার মুখে পড়ে এই কার্যক্রম।আপত্তির পরও এবং বৃহত্তর কৌশলগত লক্ষ্য থাকা বা আগের প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হবার পরও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কমান্ডাররা তাদের নিয়ন্ত্রিয়ত এলাকায় এই কার্যক্রম ও অন্যান্য মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেন।আফগানিস্তানে থাকার সময় এই কার্যক্রম নিজের চোখে দেখেন গ্রেজিয়ার। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না আমরা কতটুকু সফল হয়েছিলাম। আমরা যেখানে মাদক শুকানো হতো সেখানে হেলফায়ার মিসাইলগুলো নিক্ষেপ করতাম।’নিখুঁতভাবে ড্রোন হামলায় বিশেষ ভাবে ব্যবহার করা হয় এই সারফেস-টু-এয়ার ধরনের হেলফায়ার মিসাইল। এগুলোর প্রতিটির দাম দেড় লাখ ডলার ও ওজন ১০০ পাউন্ড।তবে যখন দেশ থেকে আমেরিকান সৈন্যরা সরে আসতে শুরু করে তখনই ডিইএ ও তাদের আন্তর্জাতিক সঙ্গীরা ফের মাদক বিরোধী অভিযানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

আফগানিস্তান অত্যন্ত জটিল আর সেখানে আমেরিকান কৌশল সফল হওয়ার মতো একেবারেই ধারাবাহিক বাস্তবতা ছিল না। এক প্রদেশে সহায়তা কর্মীরা জমির মালিকদের সয়াবিন চাষ করার জন্য অর্থ ঘুষ দিতেন, অন্যদিকে আর কোনো প্রদেশে কারখানার ওপর মিসাইল আক্রমণ চালাত মেরিনরা।আফগানিস্তানে আমেরিকার যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত একটি ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়, যেটি আফিম উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।গ্রেজিয়ার বলেন, ‘আফগানিস্তানে আমাদের ব্যর্থ অভিযানের দিকে যখন আমরা ফিরে তাকাই তখন এটা বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, একটা দেশে হামলা করলে এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের প্রভাবও থাকবে। ভবিষ্যতে এই ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে আমাদের সম্ভাব্য সবকিছু করতে হবে।’আফগানিস্তানের পপি চাষের ভবিষ্যৎ অজানা। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক নমনীয় করতে তালেবান ২০০০ সালে তাৎক্ষণিকভাবে পপি গাছ নিষিদ্ধ করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যেমন পপির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বাধার সম্মুখীন হয়েছিল তালেবানও একইভাবে চাষীদের কাছ থেকে বাধা পায়।এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের শাসনামলে তালেবান দ্রুত অর্থ আয়ের উপায় হিসেবে মাদকের গুরুত্ব বুঝতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণার চেয়েও বেশি আফগানিস্তানকে বুঝতে পেরেছে তালেবান। তালেবান ভালোভাবেই জানে, পপিকে নিষিদ্ধ করলে তা গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

এ বিভাগের আরো খবর