তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হওয়া নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছেন অধিকারকর্মীরা। সবচেয়ে বড় শঙ্কা ধর্মভিত্তিক সংগঠনটির হাতে নারীদের অধিকার হরণ নিয়ে।
বিগত মেয়াদে নারীদের এক প্রকার ঘরবন্দি করে রেখেছিল তালেবান। এবারও তেমনটা হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
যদিও তালেবান বারবারে বলছে, তারা আগেরবারের মতো কট্টর অবস্থা থেকে সরে এসেছে। নারীদের অধিকার ও সর্বোপরি মানবাধিকার রক্ষায় তারা আগের চেয়ে সচেতন।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। সংবাদমাধ্যমটি সরেজমিনে দেখেছে, আফগান নারীদের কাজ করার অনুমতি দিচ্ছে না তালেবান।
জুলাইয়ের শুরুতে যখন তালেবান যোদ্ধারা সরকারি বাহিনীর হাত থেকে কান্দাহারের দখল নিয়ে নেয়, তখন তালেবানের কয়েকজন্য সদস্য স্থানীয় আজিজি ব্যাংকে গিয়ে নয়জন নারীকে কাজ করতে মানা করেন। ওই নারীদের অফিস ছেড়ে যেতে বলেন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা।
অস্ত্রধারী তালেবান সদস্যরা ওই নয় নারীকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়; তাদের মানা করে অফিসে যেতে।
আল জাজিরাকে ওই নয় নারীর তিনজন (যাদের একজন ব্যাংক ম্যানেজার) জানান, তালেবান তাদের বলেছে, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা চাইলে তাদের জায়গায় চাকরি করতে পারে।
আজিজি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস বিভাগে কাজ করা ৪৩ বছর বয়সী নুর খাতিরা রয়টার্সকে বলেন, ‘কাজে যাওয়ার অনুমতি না পাওয়াটা অদ্ভুত। কিন্তু এটা মেনে নেয়া ছাড়া কোনো গতি নেই।
‘আমি এই কাজের জন্য ইংরেজি শিখেছি, কম্পিউটার চালানো শিখেছি। কিন্তু এখন এমন একটা কাজ করতে হবে যেখানে আমার চারপাশে শুধু নারীরাই থাকবেন।’তালেবানের সবশেষ শাসনামলে (১৯৯৬ থেকে ২০০১) নারীরা কাজ করতে পারতেন না। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। নারীরা বাড়ির বাইরে বের হলে চেহারা ঢেকে ও পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে বের হতে হতো।
যারা এই আইন অমান্য করতেন ইসলামি শরিয়া আইনের কট্টর ব্যাখ্যার অধীনে তাদের জনসমক্ষে পেটাত তালেবানের ধর্মীয় পুলিশ।
রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যর্থ আলোচনা চালানো তালেবান পশ্চিমাদের কথা দেয়, নারীরাও ‘ইসলামী আইন’ অনুযায়ী কাজ করা ও শিক্ষা গ্রহণের সমান অধিকার পাবেন।
কিন্তু আজিজি ব্যাংকের ঘটনার দুই দিন পর হেরাতের মিল্লি ব্যাংকের একটি শাখায় আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। ব্যাংকের দুই ক্যাশিয়ার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
তিন অস্ত্রধারী তালেবান যোদ্ধা ব্যাংকটিতে প্রবেশ করে নারী সদস্যদের চেহারা বের করে রাখার জন্য গালমন্দ করেন। এতে নারীরা চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের তাদের জায়গায় পাঠান।
এ দুই ঘটনা নিয়ে তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের মন্তব্য করেনি।
তালেবানের দখল নেয়া অঞ্চলের ব্যাংকে নারীদের কাজ করতে দেয়া হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে মুজাহিদ জানান, এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যবস্থা প্রণয়নের পর শরিয়া আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ইনশাল্লাহ কোনো সমস্যা হবে না।’
আমেরিকা ও তাদের মিত্র বাহিনীর আফগানিস্তানে থাকার ফলে পাওয়া নারী স্বাধীনতাকে অন্যতম অর্জন ধরা হয় গত দুই দশকে। যদিও সেগুলোর অধিকাংশই নিশ্চিত করা গেছে শহরে এলাকাগুলোতে।
গত বছর তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকতা, স্বাস্থ্যসেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কাজ করতে থাকা নারীদের অনেকেই তালেবানের হামলায় নিহত হন।সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এর অধিকাংশই ‘টার্গেটেড কিলিং’। তালেবান স্বাভাবিকভাবেই এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
আফগান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ‘তালেবান সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবে। আমরা সেটার বিপক্ষেই যুদ্ধ করছি। নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট করছেন।
‘আমাদের বাহিনী গণতন্ত্র রক্ষার চেষ্টায় রয়েছে। আমাদের পরিস্থিতি বুঝে সাহায্য করা উচিত বিশ্ববাসীর।’
অন্য কোনো উপায় না পেয়ে আফগান নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আকুতি জানিয়ে তাদের হতাশা প্রকাশ করছেন।
তাদেরই একজন রাদা আকবর টুইটবার্তায় লেখেন, ‘প্রতিটি শহরের পতন, মানুষ ও স্বপ্নের মৃত্যু, ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ, শিল্প-সংস্কৃতি, জীবন ও সৌন্দর্য ধ্বংসের সঙ্গে আমাদেরও পতন হচ্ছে। দয়া করে কেউ এটাকে থামান।’