বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আফগান বাহিনীর খড়কুটোর মতো উড়ে যাওয়ার নেপথ্যে

  •    
  • ১৬ আগস্ট, ২০২১ ১৪:৫৬

যুক্তরাষ্ট্রের এত সামরিক ব্যয়ের পরও কেন প্রায় বিনা বাধায় তালেবান আফগানিস্তানের দখল নিল, তা নিয়ে বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম পলিটিকো। সে বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আফগান বাহিনীর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও সেটি আক্ষরিক অর্থে তাদের খুব একটা কাজে আসেনি।

আফগানিস্তানের দখল নেয়ার পর দেশটির সামরিক, আইনশৃঙ্খলা ও বিদেশি সহায়তাকারী বাহিনীর প্রস্তুতি ও অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় বাবদ ৮৮ বিলিয়ন (আট হাজার ৮০০ কোটি) ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত প্রায় দুই দশকে বিপুল এ অর্থ খরচ করার পরও তালেবান বাহিনীর আগ্রাসনের মুখে একরকম বিনা বাধাতেই আত্মসমর্পণ করেছে আফগান সরকারি বাহিনী।কান্দাহার, জালালাবাদের পর রোববার সশস্ত্র গোষ্ঠীটি দখল করে নেয় রাজধানী কাবুল।

যুক্তরাষ্ট্রের এত সামরিক ব্যয়ের পরও কেন প্রায় বিনা বাধায় তালেবান আফগানিস্তানের দখল নিল, তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম পলিটিকো।

সে বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আফগান বাহিনীর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও সেটি আক্ষরিক অর্থে তাদের খুব একটা কাজে আসেনি।এর কারণ হিসেবে তাদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত থাকা বর্তমান ও সাবেক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকান বাহিনীর অতি আশাবাদী মূল্যায়নের কারণে বাহিনীটিতে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতি ও দুর্বল মনোবলের ঘটনাগুলো উঠে আসেনি। এর সঙ্গে বাহিনীটিতে এমন অনেক নামস্বর্বস্ব ‘গোস্ট সোলজার ও পুলিশ’ ছিল যারা আসলে মন্ত্রণালয়ের অধীনে শুধু বেতন নিতেন।আফগান সামরিক বাহিনীর যে দলগুলো সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ করেছে সাহসিকতার সঙ্গে তাদের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক। বিশেষজ্ঞদের মতে, তারা যে যুদ্ধ করেছেন সেটাতে আকাশপথ ও স্থলপথে ‘হাই-টেক’ সমর্থন ছাড়া সফল হওয়া সম্ভব নয়।যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল, বর্তমানে আইওয়া রাজ্যের সিনেটর ও আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের বিরোধী আর্মড সার্ভিসেস কমিটির সদস্য জনি আর্নস্ট বলেন, ‘কীভাবে আমরা আফগানদের তাদের নিজেদের জন্য যুদ্ধ করতে বলব?’আফগানিস্তানে সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ বেশ কয়েকবার পর্যালোচনা করা আর্নস্টের মতে, দায়িত্বপ্রাপ্ত আমেরিকানরা অনেক বেশি ‘আশাবাদী’ ছিল।তিনি বলেন, ‘স্পেশাল অপারেশনগুলো খুব ভালো যাচ্ছিল, কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব হয়েছে যখন আমেরিকানরা তাদের সাহায্য করেছে ও পরামর্শ দিয়েছে।’গজনি ও হেরাতের মতো শহরগুলোর দ্রুত পতনের পর তালেবান কাবুলের দোরগোড়ায় পৌঁছায়। সে সময় পেন্টাগন থেকে বারবার জোর দিয়ে বলা হয়, তিন হাজার আমেরিকান সেনা শহরটিতে পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের নিরাপদে বের করে আনতে।

কাবুলের মিলিটারি ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ শেষে সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছে নতুন সদস্যদের। ছবি: এএফপি

পেন্টাগনের প্রেস সচিব জন কারবি শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের কাছ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেমনটা প্রয়োজন সেই ইচ্ছাশক্তিটা দেখতে চাই।’তিনি আরও বলেন, আফগান বাহিনীর সংখ্যা অনেক বেশি। তালেবানের কাছে বিমান নেই, যেটা আফগান বাহিনীর আছে।অসম্পূর্ণ চিত্র

গত দুই দশকে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০০৩ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৬ হাজার নিরাপত্তা রক্ষী ছিল; ছিল না কোনো পুলিশ।

পেন্টাগনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের এপ্রিলে পুলিশের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৬২৮ জনে। আর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ৭১ জন।বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের দক্ষতার দাবিও।যুক্তরাষ্ট্রের এক সাবেক কমান্ডার বলেছিলেন, আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনী ‘সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে’ লড়তে সক্ষম।

২০১৫ সালে আরেক কমান্ডার বলেন, আফগান বাহিনী ‘নিজেদের বাড়তে থাকা দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে’।গত মাসেই পেন্টাগনের প্রধান মুখপাত্র জানান, আফগান বাহিনী ‘নিজেদের দেশকে কীভাবে রক্ষা করতে হয়, সেটা জানে’।কিন্তু বাস্তবিকভাবে দেখা গেল আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী আসলে কোনো সংঘর্ষ বা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতই ছিল না।২০১৫ সাল থেকে শুরু করে গত ছয় বছর ধরে আফগান সামরিক বাহিনীর সংখ্যা-সামর্থ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেন্টাগন জনসমক্ষে আনেনি।তাদের গোপনীয়তার কারণে তালেবানের চাপে সরকারি বাহিনী ঠিক কী করতে পারবে, সেটা নিয়েও ছিল এক ধরনের ধোঁয়াশা।

মাঠের সত্য

পেন্টাগনের আশাবাদ যে আসলে বাস্তবতাবর্জিত সেটা বোঝা গেছে দ্রুত। যেকোনো সামরিক বাহিনীতে ইনফ্র্যান্ট্রি বা পদাতিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বেশি থাকে। আফগানদের ক্ষেত্রেও তেমনটা ছিল।

যুদ্ধের সময় তাদের পোস্ট ছেড়ে গেছেন অনেক সেনা। অনেকেই ফসল চাষের সময় বা যুদ্ধের কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার জন্য চাকরি ছেড়ে গেছেন। একের পর এক যুদ্ধে হারের কারণেও সংহতির অভাব দেখা গেছে।

আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ ইউনিটের কমান্ডার ও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মাইক জেসন বলেন, ‘যদি আপনি ক্রমাগত নতুন শক্তি ও পেশাদারত্ব বাহিনীতে আনতে না পারেন, তবে এটি টেকসই হবে না। আর আপনি এটি দুই বছর পরে চিনতে পারবেন না।’সম্প্রতি শক্তিশালী হয়ে ওঠা তালেবান বাহিনীও আফগান বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে।

ন্যাটোর প্রশিক্ষণ মূল্যায়নের জন্য একাধিকবার আফগানিস্তানে যাওয়া সামরিক বিশেষজ্ঞ মাইকেল ও’হ্যানলন বলেন, ‘তালেবানের আক্রমণে বিপুলসংখ্যক আফগান সামরিক বাহিনীর সদস্য মারা গেছে, যার কারণে তাদের একেবারে গোড়া থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়েছে। প্রতি বছরই চাকরি ছেড়ে দেয়া বা হতাহতের কারণে ২০ থেকে ২০ শতাংশ ঘাটতি থাকত।’আফগান বিমান বাহিনীও পুরোনো প্রপেলারচালিত বিমান ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার (যেগুলোর যন্ত্রাংশ সীমিত) দিয়ে দেশজুড়ে চলতে থাকা সংঘাত সামাল দিতে পারেনি। বিমান বাহিনীর দুর্দশার কারণে স্থলবিভাগের অনেক যুদ্ধরত বাহিনী বাধ্য হয়েছে পিছু হটতে বা পালিয়ে যেতে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক ইউএস কমান্ডার পলিটিকোকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুই-তিন যুদ্ধ করার পর তারা বুঝতে পারে যে, আফগান বিমানবাহিনী সহায়তা করতে বা সাপ্লাই ও জরুরি চিকিৎসা সেবা নিয়ে আসতে পারবে না।

‘আমি বিষয়টি নিয়ে অনেকদিন আগে যখন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অত্যাধুনিক সিস্টেমগুলো পরিচালনাকারীদের সরিয়ে নিলাম, তখনই তাদের সতর্ক করেছি।’অনেকেই আবার দুষছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রণীত প্রশিক্ষণব্যবস্থাকে। তাদের একজন আফগানিস্তানের ন্যাটোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করা পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা মার্ক জ্যাকবসন।

তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র আফগান বাহিনীকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ দিলেও নিজ ঘরে লুকিয়ে থাকা তালেবানের মতো ভয়াবহ প্রতিপক্ষকে কীভাবে ঠেকাতে হবে, সেটির প্রশিক্ষণ দেননি।

হেলমান্দ প্রদেশে জরুরি খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে আফগান বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার। ছবি: এএফপি

জ্যাকবসন বলেন, ‘নিজেদের মতো করে আফগান সেনাবাহিনী তৈরি করতে গিয়ে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। যেখানে বিদ্রোহ দমনের জন্য বিশেষায়ত আর্মি ও পুলিশ বাহিনী তৈরি করা দরকার ছিল সেখানে আমরা রেজিমেন্ট ও ব্রিগেড তৈরি করেছি। আফগান সীমান্তে সাধারণ আক্রমণ রক্ষার জন্য আমরা বাহিনী প্রস্তুত করেছিলাম।’আফগানিস্তানের ভূ-প্রকৃতিও দেশটির সরকারি বাহিনীর পতনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সাবেক জেনারেল জোসেফ ভোটেল।তিনি বলেন, ‘অনেক সৈন্য রাজধানী থেকে দূরে ছিল। অনেককেই এত প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাখা হয়েছিল যে, তাদের খুব সহজেই ঘিরে ফেলে বাকিদের থেকে আলাদা করা সম্ভব ছিল। তাদের কাছে সহায়তা পৌঁছানোর কোনো উপায় ছিল না।’

অব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের অভাব

আমেরিকা ও তাদের মিত্রদের আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়াকেই তালেবানের শক্তিশালী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন কিম্বারলি কিগান।ইউএস কমান্ডার জেনারেল স্ট্যানলি ম্যাকক্রিস্টালের অধীনে স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেসমেন্ট গ্রুপের সদস্য ও ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ারের প্রেসিডেন্ট কিগান বলেন, ‘তারা আমাদের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছে অনেক বছর ধরে। তাদের হতাহতের হার আমেরিকান সেনাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

‘যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তি আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ায় তালেবানের অভিযান পরিচালনা করার শক্তিতে রাতারাতি পরিবর্তন আসে, যাতে আসলে আফগান বাহিনীর মনোবল ধসে যায়।’ও’হ্যানলনের বিশ্বাস কেউই এভাবে আমেরিকান বাহিনীর হুট করে চলে যাওয়াটা আঁচ করতে পারেনি।তিনি বলেন, ‘যারা অপেক্ষা করছিলেন যে সরকারের রক্ষায় লড়াই করবেন, তারা এরপর আর অপেক্ষা করেনি। অস্ত্র জমা দিয়ে হয় তালেবানের সঙ্গে মিশে গেছে বা নিজের মতো করে সমঝোতা করেছে।’নিরাপত্তা ও গোয়েন্দাবিষয়ক এজেন্সি জেনসের রিসার্চ অ্যানালিস্ট নেহা দ্বিবেদী মনে করেন, আফগান বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকলেও অব্যবস্থাপনা, একতার অভাব ও দুর্নীতিই তাদের ডুবিয়েছে।তিনি বলেন, ‘আফগান বাহিনী শুরু থেকেই দুর্বল নেতৃত্ব, নতুন নিয়োগ, চাকরি ছেড়ে দেয়া ও যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্বলতায় ভুগেছে। অন্যদিকে তালেবানের কাছে এত আধুনিক অস্ত্র না থাকলেও তাদের আর্থিক ও একতায় কোনো সমস্যা ছিল না।’

এ বিভাগের আরো খবর