জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পেছনে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই সব কুশীলবকে খুঁজে বের করতে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করা সময়ের দাবি বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
একই মত দিয়েছেন আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যাওয়া বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীও।
ঘটনার ৪৫ বছর পর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা কঠিন হলেও তা অসম্ভব নয় বলে মনে করছেন এই বিচারপতিরা।
কমিশন গঠনের বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, এ সময়ে কমিশন গঠন করা কঠিন কাজ, তবে তা অসম্ভব নয়। করোনা গেলে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
কমিশন গঠনে আইনগত জটিলতা নেই উল্লেখ করে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, কমিশন গঠনের জন্য জাতীয় সংসদ থেকে একটি আইন পাস করলেই হবে।
কমিশনের পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের কয়েকটি রাষ্ট্রে প্রচুর বইপত্র আছে। যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলা আছে। সেগুলো থেকে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া দেশে জীবিত বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে তথ্য নেয়া যেতে পারে বলেও জানান তিনি।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনের কুশীলবদের খুঁজে বের করার দাবি যারা করেছিল, তার মধ্যে আমি একজন। বিশেষ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ দাবি তুলেছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন, তাদের মধ্যে অন্যান্য সংস্থাও আছে। সবারই দাবি একটি কমিশন গঠন করে পেছনের কুশীলবদের খুঁজে বের করা। এমনকি ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তাদেরও দাবি এটি।
‘সবাই জানে এর পেছনে কারা ছিল। এ ঘটনার মূল কুশীলব খুনি মোশতাক, খুনি জিয়া, কিন্তু এটা দালিলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে এ কমিশন করা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির বিচার করা যায় না। যার কারণে বিচারের আগেই খুনি মোশতাক মরে যাওয়ায় চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়। আমাদের আইনে তাদের তো বিচার করা সম্ভব নয়। কিন্তু আজীবন যারা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে গবেষণা করবেন, তারা যাতে একটি ডকুমেন্ট পান, যেটি হবে সরকারি, একটি প্রতিষ্ঠিত ডকুমেন্ট, যেখানে উল্লেখ থাকবে কুশীলব কারা।’
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। এ আইনের জোরে ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ ছিল।
ইনডেমনিটি আইন প্রসঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘আগের দিনে রাজা-মহারাজারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিতেন। আর আমাদের হয়েছিল উল্টোটা। এটা করা হয়েছিল, যাতে আসামিরা শাস্তি না পায়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় বিচার না হওয়ার কারণ হলো ইনডেমনিটি কায়েম করে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল।
‘সংবিধান সংশোধন করে তারা ভেবেছিল, ইনডেমনিটি সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে। আসলে সংবিধানের অংশ হয় নাই। সাংবিধানিক ভ্যালিডিটি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সংবিধানের অংশ কখনোই হয়নি। পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট রায়েও এমনটি বলেছে।’
বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘১৯৯৬ সালে ইনডেমনিটি বাতিলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের দ্বার উন্মোচিত হয়। ইনডেমনিটি কখনোই বৈধ ছিল না। সব সময়েই অবৈধ। এটি ছিল একটি কালো আইন।’
ইনডেমনিটি আইন নিয়ে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘এ রকম নজির সভ্যতার ইতিহাসে আর কোথাও আমরা দেখিনি। কোনো ব্যক্তির হত্যাকারীকে আইনের আওতা থেকে মুক্ত রাখার নজির আছে বলে আমার জানা নেই। দেশের একজন রাষ্ট্রপতির ঘাতকদের মুক্তির নজির সভ্যতার ইতিহাসে নেই। এটিকে কালাকানুন বললেও কম হয়ে যায়। এটিকে কৃষ্ণতম অধ্যাদেশ বলব আমি।’
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘খুনি মোশতাক এবং খুনি জিয়ার এসব কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে তারা জড়িত ছিলেন। না হলে যারা বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যক্ষভাবে খুন করেছে, তাদের কেন এরা বিচার থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।’
খুনিদের তখন বিচারে আনলে থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে, এ কারণেই বিচার বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল বলে মনে করেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী।
এ হত্যাকাণ্ডের পেছনের কুশীলবদের খুঁজে বের করতে একটি জাতীয় কমিশন গঠনের দাবি উঠছে কয়েক বছর ধরে। সরকারও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সম্প্রতি কৃষক লীগের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারীদের বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।