এলাকায় পরিচিতি মুজিবপাগল হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনার পর থেকে ৪৬ বছর ধরে তিনি জুতা পরেন না, কালো পোশাক পরে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও খুনিদের প্রতি ঘৃণায় এভাবেই জীবন যাপন করে আসছেন ইসহাক আলী শরীফ।
তিনি মনে করেন, যে মাটিতে বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে আছেন, সেই মাটিতে তার পক্ষে জুতা পরা সম্ভব না।
ইসহাক আলী শরীফের বাড়ি বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগী ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামে। নব্বইয়ের কোটায় এখন বয়স।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামে বসে রেডিওর খবরে জানতে পারেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
স্বাক্ষরজ্ঞানহীন ইসহাক আলী শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। স্ত্রী-সন্তানকে রেখে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান।
ততক্ষণে খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে তার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া নিয়ে সমাহিত করে। পরে তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর থেকে তিনি আর চট্টগ্রামে ফিরে যাননি। গ্রামের বাড়িতে দিনমজুরি করে দিনাতিপাত করতে থাকেন।
ওই সময় থেকেই তিনি খালি পায়ে ও কালো কাপড়, কালো জামা পরে জীবনযাপন শুরু করেন। এভাবে চলছে ৪৬ বছর।
বিনিময়ে কিছুই চাননি। তার শেষ জীবনে চাওয়া বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করা।
ইসহাক জানান, ১৯৭০ সালে তিনি জাহাজভাঙা শ্রমিক হিসেবে পরিবার-পরিজন নিয়ে চট্টগ্রামে যান।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমতলীতে আসেন। খবর পেয়ে ৩৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে তিনি সেখানে যান। কিন্তু ততক্ষণে বঙ্গবন্ধু আমতলী ছেড়ে চলে যান।
অল্প সময়ের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয়নি। হাল ছাড়েননি তিনি। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বরগুনায় আসেন। খবর পেয়ে তিনি বরগুনায় ছুটে যান। কাছাকাছি যেতে না পারলেও দূর থেকে দেখে মনের ক্ষুধা মেটান।
চরপাড়া গ্রামের আব্দুল হক মৃধা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবর পেয়েই ইসহাক আলী শরীফ কালো লুঙ্গি, গায়ে কালো জামা এবং খালি পায়ে হাঁটছেন। গত ৪৬ বছরই তিনি এ পোশাক পরে আছেন।’
তিনি বলেন, ‘কখনও তার সামনে শেখ সাহেবকে নিয়ে কেউ খারাপ মন্তব্য করলে তিনি তার প্রতিবাদ করেন। এ রকম প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি ৩-৪ বার হামলারও শিকার হয়েছেন। সারা জীবন শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও জয় বাংলার স্লোগান দেয়ার কারণে এলাকার মানুষ তাকে মুজিবপাগল বলে ডাকেন।’
ইসহাক আলী বলেন, ‘যে মাটিতে নেতা শেখ সাহেব ঘুমিয়ে আছেন, সেই মাটিতে আমি জুতা পায়ে কখনও হাঁটতে পারি না। তাই শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর আর জুতা পায়ে দেইনি। আমি শেখ সাহেবের শোক সইতে না পেরে কালো পোশাক পরে থাকি।’
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভালো লাগে না ইসহাকের। বলেন, ‘শেখ সাহেবকে আমরা রাজনৈতিক দল দিয়ে ভাগ করি। শেখ সাহেব কোনো দলের জন্য এ দেশ মুক্ত করেননি। তিনি বাংলার জনগণের জন্য মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। তাই শেখ সাহেবকে রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে রাখা উচিত।’
বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখতে না পারার আক্ষেপ তার কন্যাকে দেখে মেটাতে চান ইসহাক আলী। বলেন, ‘শেখ হাসিনা ব্যস্ত মানুষ। যদি কখনো সময় দেন তা হলে মৃত্যুর আগে একবার হলেও দেখা করব। তবে তার কাছে আমার চাওয়ার কিছু নেই।’
তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ছোটবগী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তৌফিকউজ্জামান তনু বলেন, ‘ইসহাক শরীফ গত ৪৬ বছর খালি পায়ে হেঁটে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু বিনিময়ে তিনি দলের কাছে কিছুই চাননি। এমন স্বার্থহীন ভালোবাসার মানুষ বর্তমানে বিরল।’
তনু বলেন, ‘ইসহাক আলী শরীফকে আমি সব সময়ই যথাসাধ্য সহায়তা করে আসছি। তিনি যেকোনো প্রয়োজনে আমার কাছে আসলে কখনোই ফিরিয়ে দিইনি।’