বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিন সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। কোনো বিক্ষোভ এড়াতে আগে থেকেই সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। স্থানীয় থানার পুলিশের পাশাপাশি গোপালগঞ্জ থেকেও বাড়তি ফোর্স আনা হয় নিরাপত্তা নিশ্চিতে।
হেলিকপ্টার আসার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ আসতে থাকে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে। কিন্তু সেদিন সেনাবাহিনী কাউকেই কাছে আসতে দেয়নি।
সেই সময় গোপালগঞ্জ মহকুমার দায়িত্বে ছিলেন মহকুমা পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) মো. নুরুল আলম। তিনি ‘সেই অন্ধকার: ১৫ আগস্টের প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রে সেই দিনটির বর্ণনা দিয়েছেন।
নুরুল আলম বলেন, ‘১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পরদিন সকালে আমি অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো, আমি ঢাকার এসপি সালাম বলছি। কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে একটি হেলিকপ্টার টুঙ্গিপাড়া যাবে। আপনি কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করুন এবং সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
‘হেলিকপ্টার আসার পর সেটি শূন্যের ওপর রেখে একজন আর্মি অফিসার মুখ বের করে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি মহকুমা পুলিশ অফিসার। তিনি তখন জানতে চাইলেন, এখানে হেলিকপ্টার নামানোর জন্য নিরাপদ কি না। আমি তাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিলে তিনি হেলিকপ্টার নামালেন।’
সেই সেনা কর্মকর্তা হেলিকপ্টার থেকে নেমেই কবর খনন হয়েছে কি না জানতে চান। নুরুল আলম বলেন, ‘তিনি জানতে চান, এলাকায় লাশ ছিনতাইয়ের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। আমি ওনাকে বললাম, কোনো অসুবিধা নেই। আমরা থানার পুলিশ ও ক্যাম্পের পুলিশ দিয়ে নিরাপদ করেছি। আরও পুলিশ গোপালগঞ্জ থেকে মধুমতী নদী দিয়ে লঞ্চে করে আসছে।
‘মরদেহসহ বরফভর্তি কফিন অত্যন্ত ভারী ছিল। নামাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমরা কফিন নামাই, আর এটি নামাতে আর্মির হাবিলদারসহ দু-একজন আমাদের সহযোগিতা করে। এটা এত ভারী ছিল যে, চার-পাঁচজনের বহন করাও কষ্ট হচ্ছিল।’
এ সময় কর্তব্যরত সেনা কর্মকর্তার কাছে জানাজার বিষয়ে জানতে চাইলে রোষে পড়ার আশঙ্কার কথা জানান নুরুল। তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে আমি আমাদের সাথে থাকা আর্মি অফিসারকে বললাম, জানাজা পড়তে হবে কি না, নাকি ঢাকা থেকে পড়ানো হয়েছে।
‘অবশ্য তিনি আমাদের নিরাপত্তায় সন্তুষ্ট ছিলেন না বলে কয়েকবারই রাগ করেছেন। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি অত্যন্ত রেগে যান এবং আমাকে ধমকে বলেন, জানাজা কি ধর্মীয় রীতিনীতি বিরুদ্ধ? এ সমস্ত প্রশ্ন অবান্তর। তখন আমি কথা না বাড়িয়ে জানাজা পড়াতে একজন মৌলভী সাহেব ডাকতে ওসিকে নির্দেশ দিই।’
বঙ্গবন্ধুর মরদেহ তার গ্রামের বাড়ির আঙিনায় আনা হলে স্থানীয় কয়েকজন যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে তারাই তার জানাজা ও দাফনে অংশ নেন।
এসডিপিও নুরুল আলম তার বর্ণনায় বলেন, ‘কফিনের ডালা খুলে পাশে রাখার পর আমরা ধরাধরি করে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ডালার ওপর রাখি। তারপর কাফনের কাপড় খুলতেই দেখা গেল একটা সাদা কাপড়কে লম্বালম্বি দুই ভাঁজ করে মুড়িয়ে পেঁচানো হয়েছে। সেটি খুলতেই দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর পরনে পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি। উনি যেন শুয়ে ঘুমাচ্ছেন।
‘গোসলের জন্য পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি খোলার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু খোলা যাচ্ছিল না। তখন আমাদের মধ্য থেকেই কেউ একজন দৌড়ে পাশের দোকানে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে থানার ওসি একজন মৌলভী সাহেবসহ একজনকে নিয়ে আসলেন। সাথে সাথে পাশের দোকান থেকে একজন ব্লেড আর কাপড় কাচার একটি ৫৭০ সাবান নিয়ে আসলেন। মৌলভী সাহেবকে তখন গোসলের ব্যবস্থা করতে বলা হলো।’
বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানোর জন্য পানি আনতে কোনো পাত্র পাওয়া না গেলে গোয়ালঘর থেকে সংগ্রহ করা হয় বালতি। নুরুল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গোয়ালঘরে কিছু গরু ছিল, সেগুলোকে খাওয়ানোর জন্য বালতি ছিল। আমাদের এখান থেকে কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে সে বালতি পরিষ্কার করে পাশের টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে আসল।
‘মৌলভী সাহেবকে গোসলের ব্যবস্থা করতে বলাতে তিনি ব্লেড হাতে নিয়ে কাঁপতে থাকলেন। ব্লেড কাগজ থেকে খুলে বঙ্গবন্ধুর শরীর থেকে গেঞ্জি, পাঞ্জাবি খুলতে তিনি পারছিলেন না। আমি হাত থেকে ব্লেড নিলাম। নিজেই বঙ্গবন্ধুর পরনের কাপড় কেটে দুই ফাঁক করে দিই। এ সময় দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর সারা বুক ঝাঁঝরা গুলিতে। ঘাড়ের ওপরে একটা গুলি ছিল, হাতের ওপরে গুলি ছিল, আঙুল একটা অল মোস্ট ছেঁড়া অবস্থায়। আর পাঞ্জাবির পকেটে একটি ভাঙা চশমা ও পাইপের অংশ।’
তিনি বলেন, ‘গোয়ালঘর থেকেই একটি চাটাইয়ের মতো এনে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ আড়াল করে গোছলের কাজ চলছিল। রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে কয়েকটি শাড়ি নিয়ে আসা হয়। আমার মনে হয় চারটি হবে। দুটির পাড় কেটে তখন কাফনের কাপড় তৈরি করা হলো। এরপর আমরা জানাজার অনুমতি নিলাম।
‘জানাজার জন্য যখন আমরা দাঁড়াচ্ছি, তখন নিরাপত্তার জন্য থাকা এক পুলিশ ইনসপেক্টর বললেন, অনেকেই জানাজা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছে, অনুমতি থাকলে তারা আসবেন। আমি যখন অনুমতি নিতে গেলাম, মেজর সাহেব রেগে গেলেন। বললেন, কোনো অনুমতি হবে না। বাহির থেকে কারো এসে জানাজা পড়ার দরকার নেই।’
এসডিপিও নুরুল আলম বলেন, ‘আমরা আর দেরি না করে জানাজার জন্য দাঁড়িয়ে যাই। প্রায় ২৪-২৫ জন অংশ নেন। সবাই ধরাধরি করে কবরে লাশ নিয়ে যাওয়া হলো।’
বঙ্গবন্ধুকে যে চারজন গোসল করিয়েছেন, তার মধ্যে একজন তৎকালীন রেডক্রস হাসপাতালের বাবুর্চি কাজী ইদ্রিস আলী। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা হাতে গোনা কয়েকজন লোক ছিলাম দাফন-কাফনে। লাশের গায়ে খুব গন্ধ ছিল। কোনোমতে ৫৭০ সাবান আর রেডক্রস হাসপাতালের রোগীদের জন্য রাখা সাদা কাপড় দিয়ে দাফন-কাফন করা হয়।
‘আর্মির ভয়ে এলাকার কেউ ভেতরে ঢুকতে পারেনি। আমরা মাত্র কয়েকজন লোক সেদিন দাফন-কাফনে থাকতে পেরেছিলাম। সেনাবাহিনীর ভয়ে শুধু পরিবার নয়, এলাকাবাসীও জানাজায় আসতে পারেনি।’
বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় এবং টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র শেখ আহমেদ হোসেন মির্জা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পরিবার শুধু না, এলাকার কেউই এগোতে পারেনি। অল্প কিছু লোক জানাজায় শরিক হয়। যুবসমাজের কেউই তো ঢুকতে পারেনি। ঢুকলেই তো তাদের সেখানে মেরে ফেলত।
‘বঙ্গবন্ধুকে যখন আনল, এই শেখ পরিবারের সদস্যরা অনেকেই অত্যন্ত বেদনায়, হতাশায় এবং জীবনের ভয়ে অন্যত্র সরে ছিল। বঙ্গবন্ধুর চাচি, উনি একটু বের হয়ে বলেছিলেন, “আমার খোকাকে কারা মারছে?” এটা বলায় তাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়ি দেয়া হয়। তিনি অনেক বয়সী একজন মানুষ ছিলেন। এমন এক ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। আমার বাড়ি কেন, আশপাশের কোনো গ্রামের কেউই জানাজায় অংশ নিতে পারেনি। বৃদ্ধ দেখে কিছু লোক জানাজায় অংশ নেন এবং বঙ্গবন্ধুকে শেষ শয়ানে শায়িত করে।’