বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভয়াল সেই রাত

  •    
  • ১৫ আগস্ট, ২০২১ ০০:০২

কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন সরাসরি আক্রমণের। কর্মকর্তাদের দুটি দলে ভাগ করা হয়। একটি দল সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করবে। আরেকটি বাইরে থেকে রক্ষীবাহিনী বা সেনাবাহিনী থেকে আসা প্রতি-আক্রমণ ঠেকাবে। আক্রমণ ঠেকানোর দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূর ও মেজর হুদাকে।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগের দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সচল হয়ে ওঠে সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের যানবাহনগুলো। একটি ইউনিট থেকে ভারী ট্রাক দিয়ে টেনে কুর্মিটোলায় তৎকালীন নির্মাণাধীন বিমানবন্দরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেদিন রাত ১০টা নাগাদ ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্ত থেকে টি-৫৪ ট্যাংকগুলো নিয়ে বের হয়ে যায় একটি ইউনিট। একত্রিত হয় বিমানবন্দরে থাকা ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক।

রাত প্রায় সাড়ে ১১টা নাগাদ সেখানে জড়ো হন মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার রশিদ, মেজর আজিজ পাশা, মেজর রাশেদ চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তা।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ের বিবরণ ও বিভিন্ন গবেষণার সূত্রে সেদিনের এ চিত্র পাওয়া যায়।

ওই দিন অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান। তিনিই অন্য কর্মকর্তাদের অপারেশনের পরিকল্পনা জানান। তাদের লক্ষ্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি আক্রমণ।

কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন সরাসরি আক্রমণের। কর্মকর্তাদের দুটি দলে ভাগ করা হয়। একটি দল সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করবে। আরেকটি বাইরে থেকে রক্ষীবাহিনী বা সেনাবাহিনী থেকে আসা প্রতি-আক্রমণ ঠেকাবে। আক্রমণ ঠেকানোর দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূর ও মেজর হুদাকে।

বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের পাশাপাশি শেখ ফজলুল হক মণি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসাতেও আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়।

পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর এক প্লাটুন সৈন্যসহ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসার উদ্দেশে রওনা হন মেজর ডালিম। আর শেখ মণির বাসায় আক্রমণের জন্য দুই প্লাটুন সৈন্য নিয়ে রওনা হন রিসালদার মোসলেমউদ্দিন খান।

পিলখানা থেকে বিডিআর আক্রমণ করলে তা প্রতিহতের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর শাহরিয়ারকে। একই সঙ্গে তিনি রেডিও স্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউমার্কেট এলাকা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও নেন। আর রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহতের দায়িত্ব নেন মেজর ফারুক নিজেই। ট্যাংক আর মেশিনগান নিয়ে শেরেবাংলা নগরে অবস্থান নেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের জন্য ১২টি ট্যাংক আর তিন শ সৈনিক নিয়ে রওনা হন মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ। মেজর রশিদের দায়িত্ব ছিল হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়া। তার নেতৃত্বে ১৮টি কামান গোলাভর্তি করে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল যুদ্ধাবস্থার জন্য। এগুলো তাক করা হয়েছিল রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টার ও বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে।

ঘাতকের দল যাত্রা শুরু করে ১৫ আগস্ট ভোর ৪টা নাগাদ। ভোর সোয়া ৫টার দিকে মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের প্লাটুন ধানমন্ডিতে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাসায় আক্রমণ করে।

এ সময় শেখ মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করা হয়। লুকিয়ে প্রাণে বেঁচে যান শেখ মণির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।

অন্যদিকে মেজর ডালিমের নেতৃত্বে হত্যা করা হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বেবী, ১২ বছরের ছেলে আরিফ, চার বছরের নাতি বাবু, ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগনে আবদুল নইম খান রিন্টু, তিন অতিথি এবং চারজন গৃহকর্মীকে।

কী ঘটেছিল ৩২ নম্বরে

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে আক্রমণের আগেই বঙ্গবন্ধু সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণের খবর পান এবং নিচে থাকা তার ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলামকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে খবর দিতে নির্দেশ দেন।

সেই অন্ধকার নামের এক প্রামাণ্যচিত্রে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল রাতের বর্ণনা তুলে ধরেন মুহিতুল ইসলাম। সেই বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘১৪ আগস্ট রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার ভেতরে বঙ্গবন্ধু গণভবন থেকে চলে এলেন। এসে ওপরে উঠে গেলেন। তারপর তোফায়েল সাহেব এসেছিলেন। তার সঙ্গে কিছু কথা বললেন। ওনারাও চলে গেলেন। উনি প্রতিদিন সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বিছানায় শুয়ে পড়তেন। সেদিনও তা-ই করেছিলেন।

‘আমি রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত গেটের এক আর্মি সিপাইয়ের সাথে গল্প করে আমাদের নির্ধারিত জায়গায় শুয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। হঠাৎ আমাদের টেলিফোন মিস্ত্রি এসে আমাকে বলছে, স্যার প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে ডাকছেন। আমি গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা অবস্থায় ছিলাম, সে অবস্থাতেই টেলিফোন ধরলাম। আমি টেলিফোন ধরার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু বললেন, “সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় আক্রমণ করেছে। ইমিডিয়েট পুলিশ কন্ট্রোল রুমকে টেলিফোন করো।”’

মুহিতুল ইসলাম বলেন, ‘আমি টেলিফোন ঘোরাচ্ছিলাম, কিন্তু কন্ট্রোল রুম পাচ্ছিলাম না। না পেয়ে আমি গণভবন এক্সচেঞ্জকে টেলিফোন করলাম। ওখানে অপারেটর সিরিভ করল, কিন্তু কোনো কথা বলছিল না। ঠিক সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি-গেঞ্জি গায়ে নিচে নেমে এলেন। নেমে এসে আমাকে বললেন, “কিরে, তোরে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগাতে বললাম, লাগালি না।” আমি বললাম, “স্যার আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পাচ্ছি না। আমি গণভবনকে পেয়েছি, কিন্তু কথা বলছে না।”

‘তখন উনি রিসিভারটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিজেই বললেন, “হ্যালো, আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।” সেই মুহূর্তে পেছনের জানালা দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে লাগল। এরই মধ্যে জানালার একটি গ্লাস ভেঙে আমার হাতে ফুটল। কেটে প্রচুর রক্ত ঝরতে লাগল। এটা দেখে বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে টেনে বললেন শুয়ে পড়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হয়ে গেল। সেই সময় কাজের ছেলে আব্দুল ওনার পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে এলো। উনি আমার সামনেই পাঞ্জাবিটা পরলেন, চশমা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বললেন, “পুলিশ সেন্ট্রি, আর্মি সেন্ট্রি, এত গুলি চলছে, তোমরা কী করছ?” এই বলে উনি চলে গেলেন।’

আদালতে মুহিতুল ইসলামসহ কয়েকজনের ভাষ্য থেকে জানা যায়, বাড়ি আক্রমণ হলে বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর বাসার গৃহকর্মী আব্দুর রহমান রমা তিনতলায় গিয়ে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে তোলেন। ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল আসেন দোতলা পর্যন্ত। রমা দোতলায় শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে তোলেন। জামা-কাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রী রোজীকে নিয়ে দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে যান।

ঠিক তখনই মেজর নূর, মহিউদ্দিন আহমেদ এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকেন। কোনো কথা না বলে শেখ কামালের পায়ে গুলি করেন বজলুল হুদা।

মুহিতুল ইসলাম বলেন, ‘কামাল ভাই নেমে এসে বললেন, পুলিশ সেন্ট্রি আর্মি সেন্ট্রি কে কে আছেন, আসেন আমার সাথে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি এবং ডিএসপি সাহেব (নুরুল ইসলাম খান) ওনার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ দেখি তিন-চারজন কালো পোশাক পরা লোক ওনার সামনে এসে হাজির হলেআ। এসেই বলল, “এই শুয়রের বাচ্চা, সোজা হয়ে দাঁড়া।”

‘এই দেখে ডিএসপি সাহেব আমাকে পেছন থেকে টান দিলেন, ঘরে ঢুকতে ইঙ্গিত করলেন। প্রায় জোর করেই তিনি আমাকে নিয়ে এলেন ঘরের ভেতরে। আর সেই মুহূর্তে ওরা কামাল ভাইয়ের পায়ের ওপর গুলি করল। কামাল ভাই ওখান থেকে জান নিয়ে এখানে এসে পড়লেন। এমনভাবে পড়লেন যে ওনার ধাক্কায় আমিও পড়ে গেলাম। সেই মুহূর্তে কালো পোশাকধারীরা কামাল ভাইকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করল। কামাল ভাইয়ের বুক ঝাঁঝরা হয়ে একটা গুলি লাগল ডিএসপি সাহেবের পায়ে, আর একটা লাগল আমাকে। কামাল ভাই ওখানেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন।’

গুলি লাগা অবস্থাতেই মহিতুলকে টেনে ডিএসপি নুরুল ইসলাম তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তারা দেখেন, পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্য দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছেন। অস্ত্র পড়ে আছে পায়ের কাছে। এ সময় ঘরে ঢোকেন বজলুল হুদা। সবাইকে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে বলেন।

মুহিতুল সে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘গিয়ে দেখলাম সেখানে পুলিশের কিছু লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও দাঁড়িয়ে রইলাম। তিন-চারজন সেন্ট্রিকে সেখানে পাহারায় রেখে তারা ভেতরে চলে এলো। আমরা যখন লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে বেশ হই-হল্লার শব্দ শুনলাম।

‘একসময় বঙ্গবন্ধুর একটা কণ্ঠ শুনলাম, “আমাকে কোথায় যেতে হবে?” এর কিছুক্ষণ পরেই প্রচণ্ড ব্রাশফায়ার শুনলাম। তখন ওপরে বেশ নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কিছু পরে মহিলাদের কান্নার রোল পড়ে গেল। এ সময়ও প্রচণ্ড ফায়ার হচ্ছিল। একসময় কান্নাগুলো থেমে গেল।’

নিচে যখন শেখ কামালকে হত্যা করা হয়েছে, ঠিক সে সময় দোতলায় নিজের ঘরে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করছিলেন বঙ্গবন্ধু। একপর্যায়ে ফোনে কথা বলেন তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনের সাথে।

তিনি কর্নেল জামিলকে বলেন, ‘তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’

এ সময় তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, ‘তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’

জবাবে সফিউল্লাহ বলেন, ‘আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অফ দ্য হাউস?’

বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়েই কর্নেল জামিল তার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে রওনা হন। পথে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এদিকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণকারীরা গুলি করতে করতে দোতলায় উঠে যায়। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা মুজিব, ছেলে শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী পারভীন জামাল রোজী।

আক্রমণকারীরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি কিছুটা থামলে বঙ্গবন্ধু ঘর থেকে বের হয়ে এলে তাকে ঘিরে ধরে তারা। এ সময় মেজর মহিউদ্দিন অন্য সৈন্যদের সাথে বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধু তাদের বলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’

তিনি আরও বলেন, ‘তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি-বেয়াদবি করছিস কেন?’

এ সময় দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়ান বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় তাকে লক্ষ্য করে গুলি করেন বজলুল হুদা ও নূর। সেখানেই স্তব্ধ হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। তার বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে। রক্তে ভেসে যায় সিঁড়ি।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর বেগম মুজিবকে জানান আব্দুর রহমান রমা। এ সময় ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেন তিনি, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, শেখ নাসের ও রমা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন তাদের সৈন্যদল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করেন। আজিজ পাশা সোজা চলে যান দোতলায়। ধাক্কা দিতে থাকেন বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজায়। একপর্যায়ে গুলি করলে বেগম মুজিব দরজা খুলে দেন এবং ভেতরে থাকাদের হত্যা না করার অনুরোধ জানান।

ঘাতকরা বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে আসতে থাকেন। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা দেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন বেগম মুজিব। চিৎকার করে বলেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’

এ সময় শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিয়ে নিচে নেমে যায় ঘাতকদের একটি দল। আর বেগম মুজিবকে নিয়ে যাওয়া হয় তার ঘরে। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। বেগম মুজিবসহ বাকিদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেন আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন।

নিচে নামিয়ে আনার পর প্রথমে শেখ আবু নাসেরকে হত্যা করে ঘাতকরা। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর নাসের কাকাকে ওপর থেকে নামিয়ে নিয়ে এলো। উনি যখন নেমে এলেন, দেখলাম একটা শাড়ির আঁচল দিয়ে ওনার আঙুলগুলো বাঁধা। মনে হচ্ছিল, হয়তো আঙুলগুলো নেই। উনিও আমাদের লাইনে এসে দাঁড়ালেন।

‘কয়েকজন আর্মি তখন বলল, চলেন আপনি ওই রুমে বসেন। বলে তাকে নিয়ে গেলেন আমাদের অফিস রুমের এটাচড বাথরুমে। সেখানে নিয়ে এসে গুলি করল। যে গুলি করল, সে আমাদের লাইনের কাছাকাছি এসে আবার দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর নাসের কাকা পানি পানি বলে চিৎকার করে উঠলেন। তখন আরেকজন বলল, পানি দিয়ে আয়। তখন যে গুলি করেছিল সে গিয়ে ফায়ার করল, এরপরই নাসের কাকা স্তব্ধ হয়ে গেলেন।’

শেখ রাসেলকে হত্যার বর্ণনা দিয়ে মহিতুল ইসলাম বলেন, ‘এরপর দেখি রাসেলকে নিয়ে নিচে নেমে এসেছে। রাসেল আমাকে দেখে, সে যে গান পয়েন্টে ছিল এটা ভুলে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?” আমি বললাম, “না, ভাইয়া তোমাকে মারবে না।”

‘ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছে দেখে একজন আর্মি ওকে ধরে নিয়ে ডান পাশে থাকা পুলিশ বাংকারের কাছে নিয়ে গেল। নিয়ে আটকে রাখল। তখন সে কান্নাকাটি করছিল, “আমি মায়ের কাছে যাব।” তখন ওকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে ওপরে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শুনলাম। সব স্তব্ধ হয়ে গেল।’

এই হত্যাযজ্ঞে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের রক্তে ভেসে যায় ৩২ নম্বরের বাসার মেঝে।

বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছেন যে নেতা, তার কণ্ঠ এভাবেই ঘাতকের বুলেটে স্তব্ধ হয়ে যায়।

এ বিভাগের আরো খবর