× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বিশেষ
রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই বিচারপতির মেয়ে আসলে কে
google_news print-icon

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে

রাস্তায়-ভিক্ষা-করা-সেই-বিচারপতির-মেয়ে-আসলে-কে
ফেসবুকে ভাইরাল তুহিন সুলতানার এই ভিডিওটি দেখা হয়েছে ৮৪ লাখ বার। ছবি: সংগৃহিত।
‘মজার টিভি’ নামের ফেসবুক পেজে তুহিন ও তার কিশোরী মেয়ের আহাজারির ভিডিও আপলোড হয় গত ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। বুধবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভিডিওটি দেখা হয়েছে ৮৪ লাখ বার, শেয়ার হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার। তুহিন ও তার পরিবারের প্রকৃত অবস্থা খুঁজে বের করেছে নিউজবাংলা।

রাস্তার পাশে বুকে পোস্টার ঝুলিয়ে আহাজারি করছেন বয়স্কা এক নারী। পাশে এক কিশোরী। পোস্টারে লেখা- ‘সাহায্যের আবেদন, আমরা বাঁচতে চাই’।

‘মজার টিভি’ নামের ফেসবুক পেজে এই নারী ও তার কিশোরী মেয়ের আহাজারির ভিডিও আপলোড হয় গত ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার দিকে। মাহসান স্বপ্ন নামের একজন অনলাইন ভিডিও ক্রিয়েটর এই পেজটি পরিচালনা করেন।

বুধবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভিডিওটি দেখা হয়েছে ৮৪ লাখ বার, শেয়ার হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার। এতে মন্তব্য করেছেন ১০ হাজারের বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী।

ভিডিওতে তুহিন সুলতানা তপু নামের ওই নারীকে বলতে শোনা যায়, তিনি অভিজাত পরিবারের সন্তান, বাবা উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। তার এক মেয়ে নায়িকা, ছেলেরাও বেশ ভালো অবস্থানে আছেন। অথচ তাদের কেউ দেখাশোনা করেন না বলে কিশোরী মেয়েটিকে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করছেন তিনি।

এই নারীর আহাজারি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভিডিওর বিবরণে ০১৯৫৬৮৪১৭৮১ নম্বরটি দিয়ে সেখানে বিকাশে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে।

একটি শীর্ষ স্থানীয় অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ওই ভিডিওর ভিত্তিতে প্রতিবেদনও প্রকাশ করে রোববার। সেখানেও উল্লেখ করা হয়েছে বিকাশে টাকা পাঠানোর মোবাইল ফোন নম্বর। ওই প্রতিবেদনটিও অসংখ্য শেয়ার হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে

তবে সোমবার সকালে নিউজবাংলা কার্যালয়ে ফোন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক জানান, গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেকটি পোস্টে তার নজর আকৃষ্ট হয়। সেখানে এই একই নারীর আলাদা ছবি দিয়ে মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লেখেন, পিতৃহারা চতুর্থ শ্রেণির ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তুহিন সুলতানা তপু নামের ওই নারী এখন কপর্দকশূন্য। অসুস্থ অবস্থায় তিনি চিকিৎসা নিতেও পারছেন না।

সেই পোস্টটিও ফেসবুকে বেশ ভাইরাল হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক জানান, তখন অন্য অনেকের পাশাপাশি তারা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে এক লাখ টাকার বেশি অর্থ সংগ্রহ করে ওই নারীকে দিয়েছেন। এমনকি এখনও কয়েকজন তাকে বিকাশে প্রতি মাসে টাকা পাঠাচ্ছেন।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
গত বছরে তুহিনকে সাহায্যের আবেদন জানানো আরেকটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়

এমন তথ্য পাওয়ার পর সোমবার সকালেই অনুসন্ধানে নামে নিউজবাংলা। শুরুতেই বিকাশের জন্য দেয়া ফোন নম্বরে তুহিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কোথায় আছেন- জানতে চাইলে কোনো তথ্যই দিতে রাজি হননি তিনি।

তুহিন বলেন, ‘আমি কারো সাথে দেখা করব না। কেউ আমার ভালো চায় না, সবাই আমার ক্ষতি করতে চায়।’

একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, ‘তোরা সবাই গোয়েন্দা। সবাই আমার ক্ষতি করতে চাস। আমার বিচারপতি বাবা তোদেরকে আমার পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে।’

‘বিচারপতি বাবা’র পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওর পরিচয় সবাই জানে, ওর পরিচয় আমি আলাদা করে বলতে চাই না। দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ওকে চেনেন, আপনি কেমনে চেনেন না! ওর নাম আমি মুখে আনতে চাই না।’

নিউজবাংলার প্রতিবেদক এরপর পরিচয় গোপন করে আরেকটি নম্বর থেকে ফোন করে তুহিনকে সরাসরি অর্থ সহায়তার প্রস্তাব দেন।

তবে এবারেও ঠিকানা বলতে রাজি হননি তিনি। তুহিন বলেন, ‘বিকাশে টাকা পাঠান। বিকাশে পাঠাতে সমস্যা হলে আমি উত্তরা ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর দিচ্ছি সেখানে টাকা পাঠিয়ে দিন। তাও আমি কোনোভাবে দেখা করব না।’

এর কিছু সময় পরেই বন্ধ হয়ে যায় তুহিনের ফোন নম্বর। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাই নতুন কৌশল নেয় নিউজবাংলা।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
‘মজার টিভি’ নামের ফেসবুক পেজে ১৪ জানুয়ারি তুহিনকে নিয়ে এই ভিডিও আপলোড হয়

ফেসবুকে আপলোড করা ভিডিওতে মাহসান স্বপ্নকে বলতে শোনা যায়, তুহিনের বড় মেয়ের নাম অবনী, তিনি অভিনয়শিল্পী। সেই সূত্র ধরে টিভি নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন- অভিনয়শিল্পী সংঘে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা।

তবে সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব নাসিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অবনী নামের কোনো অভিনয়শিল্পী আমাদের সংগঠনে নেই। ব্যক্তিগতভাবেও এই নামের কোনো অভিনেত্রীকে আমি চিনি না।’

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিতে খোঁজ নিয়ে সেখানেও অবনী নামের কোনো অভিনেত্রীর খোঁজ পাওয়া যায়নি। শিল্পী সমিতির অফিস সেক্রেটারি মো. জাকির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ভোটার লিস্টে অবনী নামের কোনো অভিনয় শিল্পী নেই। নতুন কয়েকজন শিল্পী সমিতির সদস্য হয়েছেন, সেখানেও অবনী নামের কোনো অভিনেত্রী নেই।’

অবনীকে না পেয়ে অন্যপথে অনুসন্ধান শুরু করে নিউজবাংলা টিম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক তুহিনকে সহায়তার উদ্যোগ নেয়ার সময় তাকে নিয়ে পোস্টদাতা মোহাম্মদ বদরুদ্দোজার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। বদরুদ্দোজা সে সময় মেসেঞ্জারে তাকে নিশ্চিত করেন, তিনি নিজে তুহিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হন।

বদরুদ্দোজা প্রমাণ হিসেবে সে সময় উত্তরা ব্যাংকে তুহিনের নামে স্থগিত থাকা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সচল করার আবেদনপত্রের কপিও পাঠান। ওই কপিতে দেখা যায়, বদরুদ্দোজা যেদিন তুহিনকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন, ঠিক সেদিনই (২২ সেপ্টেম্বর) তুহিনের নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সচল করার আবেদন করা হয়েছিল।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সচল করতে ২২ সেপ্টেম্বর তুহিন একটি আবেদন করেন

নিউজবাংলা ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে মোহাম্মদ বদরুদ্দোজার সঙ্গে। ফেসবুক প্রোফাইলে এনবি ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন বদরুদ্দোজা। মেসেঞ্জারে তুহিনকে নিয়ে জানতে চাইলে শুরুতে তিনি দাবি করেন, বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। এরপর তুহিনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সচল করার আবেদনপত্রের নমুনাটি পাঠানো মাত্র তিনি নিউজবাংলা প্রতিবেদককে ব্লক করে দেন।

বদরুদ্দোজার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে ২২ সেপ্টেম্বরের পোস্টটি সরিয়ে ফেলার প্রমাণও পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে লিংকড-ইনে মোহাম্মদ বদরুদ্দোজার একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেখানে দেখা যায়, তিনি এনবি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পাশাপাশি রোবা এসএনএস এলএলসি নামের একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (ম্যানেজিং পার্টনার)। রাজধানীর কলাবাগানের সুলতানা টাওয়ারে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
মোহাম্মদ বদরুদ্দোজার সন্ধান পেতে সাহায্য করেছে তার লিংকড-ইন অ্যাকাউন্ট

তবে মঙ্গলবার বিকেলে সুলতানা টাওয়ারে গিয়ে জানা যায়, রোবা এসএনএস এলএলসি নামের প্রতিষ্ঠানটি ভবনের তৃতীয় তলায় ছিল আরও দুই বছর আগে। এরপর সেটি অন্য ঠিকানায় চলে যায়। এই ভবনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ার আবু বক্করের কাছ থেকে মোহাম্মদ বদরুদ্দোজার একটি ফোন নম্বর পায় নিউজবাংলা।

বদরুদ্দোজাকে ফোন করা হলে এবার তিনি কথা বলতে রাজি হন। তিনি জানান, সেপ্টেম্বরে ধানমন্ডি এলাকায় রাস্তার পাশে তুহিনকে দেখতে পান তিনি। এরপর তার দেয়া বিবরণ শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

বদরুদ্দোজা বলেন, ‘সে সময় আমি ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়ার পর অনেকেই সাহায্য করার আগ্রহ জানিয়ে যোগাযোগ করেন। আমি নিজের গাড়ির ড্রাইভার পাঠিয়ে তুহিনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সচল করি। তাকে অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়।’

বদরুদ্দোজা দাবি করেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে তুহিনের কথায় অসঙ্গতি ধরা পড়তে শুরু করে। এরপর তিনি নিজের ফেসবুক পোস্টটি ডিলিট করে দেন এবং বনশ্রী থানায় একটি জিডি করেন। পরে তিনি আর তুহিনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। কেউ সাহায্য পাঠাতে যোগাযোগ করলে খোঁজখবর নিয়ে নিজ দায়িত্বে টাকা পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

প্রথম দিকে এ বিষয়ে নিউজবাংলার জিজ্ঞাসা এড়ানোর কারণ জানতে চাইলে বদরুদ্দোজা সুস্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
মাহসান স্বপ্নর ‘মজার টিভি’ পেজ

তুহিনের অবস্থান জানতে ভিডিও ক্রিয়েটর মাহসান স্বপ্নের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করে নিউজবাংলা। তবে ফেসবুক পেজে তিনি যে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দিয়েছেন সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। বিভিন্নভাবে পাওয়া তার আরও দুটি ফোন নম্বরও বন্ধ রয়েছে।

এমন অবস্থায় স্বপ্নর ফেসবুকে নিউজবাংলার পক্ষ থেকে বার্তা পাঠানো হয়, এরপর তিনি মঙ্গলবার সকালে একটি ল্যান্ডফোন থেকে নিউজবাংলা কার্যালয়ে ফোন করেন।

তুহিনের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহসান স্বপ্ন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই আন্টির সাথে আমার রাস্তায় হঠাৎ করে দেখা। তিনি তার সমস্যার কথা আমাকে বলেন। সব কাগজ-পত্র আমাকে দেখান। তারপর আমি উনাকে সাহায্য করার জন্য ভিডিওটি করি। কারণ, আমি এ ধরনের অসহায় মানুষের পাশে সব সময় দাঁড়ানোর চেষ্টা করি।’

ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরে তুহিনের বিকাশ নম্বরে অনেকে টাকা পাঠাচ্ছেন বলেও জানান স্বপ্ন।

তবে তুহিনের বাবার পরিচয় তিনিও জানাতে রাজি হননি। এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি সবই জানি, কিন্তু কিছু বলব না। বেশ কিছুদিন যাবত আমার সকল মোবাইল নম্বর বন্ধ রাখতে হয়েছে। সেই বিচারপতির ভয়েই এটি করতে হয়েছে।’

এমন অবস্থায় নিউজবাংলার হাতে আসে একটি নথি, যাতে দেখা যায়- তুহিন একটি জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে নিজের নাম-ঠিকানা দিয়েছেন। সেই নথিতে তিনি রাজধানীর বনশ্রীর একটি বাসার ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। তুহিনের বাবার নাম মো. শামসুল হুদা, স্বামী ফখরুজ্জামান তালুকদার।

বনশ্রীর বাসার ঠিকানায় মঙ্গলবার দুপুরের দিকে গিয়ে জানা যায় তুহিন বনশ্রী এলাকায় আসেন ২০১৫ সালে। তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বনশ্রীর জি ব্লকের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সে বাসার নিরাপত্তাকর্মী নিউজবাংলাকে জানান, তুহিনের স্বামী ফখরুজ্জামান বিদেশ থাকেন।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
বনশ্রী এলাকার এই বাসায় ছিলেন তুহিন সুলতানা

বনশ্রী এলাকায় অনুসন্ধানে জানা গেছে, তুহিন সুলতানা ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করতেন। গেল এক বছরে তিনি তিন বার বাসা বদল করেছেন। তিনটি বাসার ভাড়া যথাক্রমে ১৬ হাজার, ১৪ হাজার ও ১২ হাজার টাকা। কখনও কোনো বাসার ভাড়া বকেয়া পড়েনি।

তুহিন বনশ্রীর যে বাসায় শেষ ভাড়া ছিলেন সে বাসার মালিক জহিরুল ইসলাম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখে আমার বাসার সাততলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেন তিনি। তবে হঠাৎ করেই নভেম্বর মাসের শুরুতে জানান, বাসা ছেড়ে দেবেন। এরপর সে মাসের ২৫ তারিখ বাসা ছাড়েন, কিন্তু ডিসেম্বর মাসের ভাড়াও পরিশোধ করে দেন।’

বাসা ছাড়ার আগে তুহিন বাড়ির মালিককে জানিয়েছিলেন, তার বাবা অসুস্থ, তিনি তার সঙ্গেই থাকবেন।

বনশ্রী এলাকায় যেসব বাড়িতে তুহিন ভাড়া ছিলেন, তার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তুহিন বেশ স্বচ্ছল ছিলেন। অন্য ভাড়াটিয়াদের মধ্যে তিনিই নিয়মিত সবার আগে ভাড়া পরিশোধ করতেন। করোনার সময়েও ব্যতিক্রম হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তুহিনের তিন সন্তান। বড় ছেলের নাম অনিন্দ্য, এরপর মেয়ে অবনী, যাকে অভিনেত্রী বলে পরিচয় দিয়েছেন তুহিন। এর পর ছোট মেয়ে বর্ণা (ছদ্ম নাম), সে বনশ্রীর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
বনশ্রীর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের নথিতে তুহিন সুলতানার মেয়ের নাম

স্কুলে গিয়ে জানা যায়, করোনায় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে অনলাইনে। তাই স্কুলে দায়িত্বশীল কারো উপস্থিতি নেই। তবে স্কুলের নিবন্ধন বইয়ে বর্ণার (ছদ্ম নাম) বাবার তাইওয়ানের একটি ফোন নম্বর দেয়া আছে। তবে কয়েকবার চেষ্টা করেও সেই নম্বরে সংযোগ স্থাপন করা যায়নি।

স্কুলের অফিস সহকারী নাফিজ নিউজবাংলাকে জানান, বর্ণা (ছদ্ম নাম) ও তার মা স্কুলে খুবই পরিচিত মুখ। করোনা পরিস্থিতির আগে তুহিন মেয়েকে নিয়ে নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করতেন। সবার কাছে নিজেকে সাবেক বিচারপতির মেয়ে পরিচয় দিতেন। নাফিজ জানান, সবশেষ নভেম্বর মাসে তুহিন স্কুলে এসেছিলেন। তখন তিনি মেয়ের স্কুলের ফি আগামী জুন পর্যন্ত পরিশোধ করেন। বর্ণার (ছদ্ম নাম) স্কুলে মাসিক বেতন ১৪০০ টাকা।

স্কুলের নিরাপত্তাকর্মী শাহ নেওয়াজ নিউজবাংলাকে জানান, তুহিন সুলতানার বাসায়ও যাতায়াত ছিল তার। তিনি বলেন, ‘আমি তার ভাইয়ের মতো ছিলাম। তিনি তো খারাপ মানুষ ছিলেন না। তার ঘরে দামি-দামি জিনিস আছে, সে তো এত গরিব না। আমার সাথে নভেম্বরের পর থেকে আর যোগাযোগ নাই। ফোন দিলে ফোনও ধরেন না। কী সমস্যা কে জানে।’

ভিক্ষা করার ভিডিও শাহ নেওয়াজও দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘তার অবস্থা এত খারাপ হওয়ার কথা না। আমার ছেলেকে সে সব সময় টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করত। আর আজকে এমন খারাপ অবস্থা বিশ্বাস হয় না।’

শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘তার (তুহিন) বাসায় দামি-দামি জিনিসপত্র, টিভি, ফ্রিজ, এসি সবই ছিল। ঘরে ভালো খাবার থাকত সবসময়। তবে এই এলাকা ছেড়ে যাবার পর নভেম্বর মাসে একবার আমাকে ফোনে জানায়, তার মেয়েটা না খেয়ে আছে। আমি রান্না করে নিয়ে যেতে চাইলাম। তারপর আর ফোন ধরল না। এরপর আর যোগাযোগ নাই।’

সেপ্টেম্বরের ফেসবুক পোস্টে সাহায্য পাঠাতে বিকাশ এজেন্ট নম্বর ০১৮৮৩৭৬৬৪৪৪ এবং মেয়ে বর্ণা-এর ০১৬১১৪৪৫৪৫০ নম্বর দিয়েছিলেন তুহিন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে বিকাশ এজেন্টের শাহদাত টেলিকম এর অবস্থান। প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী নিউজবাংলাকে জানান, কিছু দিন পরপরই তুহিন তার মেয়েকে নিয়ে দোকানে এসে টাকা তুলে নিয়ে যেতেন। তবে গত কিছুদিন তারা আসেননি।

ফেসবুকে এবার আপলোড করা ভিডিওতে বিকাশে টাকা পাঠাতে নিজের ব্যক্তিগত ০১৯৫৬৮৪১৭৮১ নম্বরটি দিয়েছেন তুহিন সুলতানা।

নিউজবাংলা এই ফোন নম্বর পুলিশকে সরবরাহ করে বাহিনীর সহায়তা চায়। এর পরপরই শনাক্ত হয় টাঙ্গাইল সদরের বটতলা বাজার এলাকায় আছেন তুহিন।

তুহিনের বিষয়ে মঙ্গলবার সকালে নিউজবাংলার হাতে আসা নথিতে বাবার নাম মো. শামসুল হুদা পাওয়া যায়। এই নাম যাচাই করতে গিয়ে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টে গত দুই দশকে এই নামে একজনই বিচারক ছিলেন।

হাইকোর্ট বিভাগে ২০০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি মো. শামসুল হুদা। ২০১২ সালের ২ নভেম্বর আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে তিনি অবসরে যান। তবে বিচারপতি মো. শামসুল হুদাকে ২০১৩ সালে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। বিচারপতি মো. শামসুল হুদার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে হলেও তিনি দীর্ঘদিন ঢাকায় সপরিবারে আছেন।

গোপালগঞ্জ শহরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিচারপতি মো. শামসুল হুদার তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে, যাদের একজনের নাম তুহিন সুলতানা তপু। বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে ঢাকায় বিচারপতি মো. শামসুল হুদার বাসায় যোগাযোগ করে নিউজবাংলা।

অন্যদিকে, বুধবার আরেকটি সূত্রে ফখরুজ্জামান তালুকদারের ফেসবুক আইডির সন্ধান পায় নিউজবাংলা। তুহিনের বড় মেয়ে অবনীর ফোন নম্বরও পাওয়া যায়। এর পরেই পরিষ্কার হতে থাকে তুহিনকে ঘিরে নানান রহস্য।

তিন দিনের অনুসন্ধানে খুলল জট

ফখরুজ্জামানের সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করা হলে সাড়া দেন তিনি। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, এক যুগ আগে আগে তুহিনের সঙ্গে তার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। অবনী ও অনিন্দ্য তাদের দুই সন্তান। বিয়েবিচ্ছেদের কিছুদিন আগেই দেশ ছেড়ে তাইওয়ানে চলে যান ফখরুজ্জামান। আর সেখান থেকে পরে পাড়ি জমান নিউজিল্যান্ডে। দেশে দুই সন্তানের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে তার।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
নিউজিল্যান্ড থেকে নিউজবাংলার জিজ্ঞাসার জবাব দেন ফখরুজ্জামান

তাহলে বর্ণা (ছদ্ম নাম) কার সন্তান- সেই প্রশ্নের জবাব মিলেছে তুহিনের বড় মেয়ে অবনীর কাছ থেকে। অবনী মডেলিং পেশার সঙ্গে জড়িত। ভাই অনিন্দ্য বিয়ে করার পর যে বাসায় আছেন সেখানেই থাকছেন অবনী।

মোবাইল ফোনে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাবার জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসার পার্টনার ছিলেন আবদুস সালাম লিটন নামের একজন। তার সঙ্গে মা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি জানতে পেরে আমার বাবা দেশ ছেড়ে চলে যান। এরপরেই বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে মা লিটনের সাথে থাকতে শুরু করেন।’

বর্ণা (ছদ্ম নাম) এই লিটনেরই সন্তান। বিদেশে যাওয়ার পর ফখরুজ্জামান তার দুই সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য টাকা পাঠাতেন। তবে সেই টাকার পুরোটাই নিজের বিলাসি জীবনের জন্য তুহিন খরচ করতেন বলে অভিযোগ করেন অবনী। এ নিয়ে বিরোধের জেরে প্রায় সাত বছর আগে মায়ের ঘর ছেড়ে যান অবনী-অনিন্দ্য।

অবনী জানান, জনশক্তি রপ্তানিতে জড়িত লিটনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তিনিও নিরুদ্দেশ হন। এরপরই অর্থ সংকটে পড়েন তুহিন। বিচারপতি বাবার বাড়ি থেকে প্রায়ই আর্থিক সাহায্য আনতেন। মায়ের গয়না এনে বিক্রি করার ঘটনাও ঘটেছে। এসব নিয়ে বিরোধ তৈরি হয় ভাই-বোনের সঙ্গে, ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় বাবার বাড়ির দরজা।

ও আমাদের শেষ করে দিয়েছে: বিচারপতি মো. শামসুল হুদা

বিচারপতি মো. শামসুল হুদা শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছেড়ে দেন ২০১৪ সালে। এরপর থেকে রাজধানীর সেগুনবাগিচার নিজ ফ্ল্যাটে আছেন। শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও তিনি বুধবার বিকেলে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেন বিচারপতি মো. শামসুল হুদা, ছবিটি তার অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে

মেজ মেয়ে তুহিনকে নিয়ে বিব্রত বিচারপতি মো. শামসুল হুদা বলেন, ‘ও (তুহিন) ছোট বেলা থেকেই লোভী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করার কথা বললেও আসলে সে এসএসসিও পাস করতে পারেনি। আমি ওর বাবা হয়েও বলছি, ওরে তিন বার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়াইছি, তিনবারই ফেল করেছে।

‘একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু তার সঙ্গে সংসার টেকেনি। ও আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ওর সঙ্গে এখন যে মেয়েটি আছে তার বাবার নাম আব্দুস সামাদ লিটন। আর আমরা বিয়ে দিয়েছিলাম যার সঙ্গে সে এখন নিউজিল্যান্ডে থাকে। বিদেশে থাকলেও ওর সাথে আমাদের এখনও যোগাযোগ আছে।’

তুহিন সুলতানার অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা জানিয়ে বিচারপতি শামসুল হুদা বলেন, ‘এর আগেও কয়েকবার এভাবে পোস্ট করেছে। তার এসব আচরণের কারণেই আমার স্ট্রোক করেছে। আমার এই অসুস্থতার জন্য সে-ই দায়ী। এখনও বাসায় বেডে শুয়ে আমার দিন কাটে।

‘তার (তুহিনের) অনেক সম্পত্তির লোভ। সে কী চায় সেটাই আমি জানি না। প্রতি মাসে তাকে হাত খরচের জন্য ১৫ হাজার টাকা করে এখনও আমরা দিয়ে যাচ্ছি।’

বিচারপতি শামসুল হুদা বলেন, ‘প্রত্যেক শীতে আমি গ্রামে কিছু কম্বল বিতরণ করি। সেই কম্বলও চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে সে (তুহিন)। বাসায় এসে ১০টা মোবাইল চুরি করে নিয়ে গেছে। বাড়িতে আসলেই স্বর্ণ চুরি করে নিয়ে যায়। সে কারণে ও বাসায় আসলেই আমরা ভয় পাই।

‘তার সঙ্গে একজন ইয়াবা ডিলারের সম্পর্ক রয়েছে। আমাদেরকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসায় দিতে পারে- এমন আশঙ্কায় আমরা ওকে বাসায় আনতে ভয় পাই। তাকে গ্রামে যেতে বললে সে যায় না।’

বিচারপতি শামসুল হুদা কথা বলার সময় তার সঙ্গে ছিলেন ছোট মেয়ে তানিয়া সুলতানা সুমি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওর (তুহিন) কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। আজ এখানে, তো কালকে আরেক জায়গায়, এসব করেই চলে। তার থাকার জন্য আমাদের গোপালগঞ্জের একটি বাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছি, কিন্তু সে সেখানে থাকবে না। গত মাসেও গোপালগঞ্জ থেকে ২৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়া উঠিয়ে নিয়ে এসেছে।’

সুমি বলেন, ‘এখন রাস্তায় রাস্তায় এভাবে মানুষের কাছে সাহায্য চেয়ে আমাদের মান-মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। তার এই আচরণের জন্য আমরা এখন সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না। আমাদের বাসা থেকে সে দুইশ ভরি স্বর্ণ নিয়ে গেছে। প্রতিটি ভাই-বোনকে বঞ্চিত করছে।’

তুহিনের বেপরোয়া জীবনের তথ্য জানিয়ে সুমি বলেন, ‘সে তার প্রথম স্বামীকে পিটিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। দ্বিতীয় স্বামীর সাথে যদিও তার বিয়ে হয়নি, তাকেও পিটিয়ে বের করে দিয়েছে। এখন তার সঙ্গে যে মেয়েটি আছে তাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে।’

বাবার সম্পত্তির লোভে তুহিন এখন নতুন করে প্রতারণায় নেমেছেন বলেও অভিযোগ করেন সুমি। তিনি বলেন, ‘আমরা ওকে মানসিক ডাক্তারও দেখিয়েছি। ডাক্তার মোহিত কামাল, ডাক্তার হেদায়েত উল্লাহকে দেখিয়েছি। তবে ওর কোনো মানসিক রোগ নেই। সবই ওর ভনিতা। সে টাকার জন্য সব করতে পারে।

‘ওর এই আচরণে আমরা লজ্জিত, মর্মাহত। আমরা সমাজে বের হতে পারছি না। আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলতে পারছি না। সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেতে পারছে না।’

তুহিনের বক্তব্য যাচাই না করে একপাক্ষিক ভিডিও প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান বিচারপতি শামসুল হুদা ও তার মেয়ে তানিয়া সুলতানা সুমি।

তুহিন এখন কোথায়

নিউজবাংলা মঙ্গলবার বিকেলে নিশ্চিত হয়, তুহিন ও তার মেয়ে বর্ণা (ছদ্ম নাম) টাঙ্গাইল সদরে অবস্থান করছেন৷ এরপর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি শামীম আল মামুনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা থেকে যাওয়া টিম টাঙ্গাইলের সাবালিয়া পাঞ্জাপাড়া এলাকায় বুধবার দিনভর অনুসন্ধান চালায়।

রাস্তায় ভিক্ষা করা সেই ‘বিচারপতির মেয়ে’ আসলে কে
টাঙ্গাইলের এই এলাকায় আছেন তুহিন সুলতানা

এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই তুহিনের ছবি শনাক্ত করেছেন। তারা জানান, ডিসেম্বরের শুরুর দিকে তুহিন এ এলাকার একটি বাড়ির পাঁচতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। তবে ১৫ দিন পরই সে বাসা ছেড়ে দেন।

পাশের বাড়ির বাসিন্দা রীতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৫ দিনে কয়েকবার তার সাথে আমার কথা হয়েছে। সে জানিয়েছিল, স্বামী বিদেশ থাকে, তার সাথের মেয়েটি পালিত এবং তার আর কোনো সন্তান নেই। আমি দুইবার তার বাসায়ও গেছি, সেখানে দামি-দামি সব জিনিসপত্র ছিল।’

রীতা বলেন, ‘তুহিন খুব উগ্র মেজাজের, আশপাশের সবার সঙ্গে ঝগড়া করতেন। একদিন দেখি বাসার সামনে ট্রাক, সেই ট্রাকে মালামাল তুলে চলে গেলেন। আমাকে বললেন, পাশের এলাকায় বাসা নিছে, কিন্তু ঠিকানা বলে যায় নাই।’

তুহিন টাঙ্গাইল সদরের বটতলা বাজার এলাকায় নতুন বাসা ভাড়া নিয়ে আছেন বলে অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে নিউজবাংলা।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন টাঙ্গাইল প্রতিনিধি শামীম আল মামুন ও গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি হুসাইন ইমাম সবুজ

আরও পড়ুন:

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বিশেষ
The administration is silent on the expulsion of 2 women by arbitration

সালিশ বসিয়ে ২ নারীকে সমাজচ্যুত, প্রশাসন নীরব

সালিশ বসিয়ে ২ নারীকে সমাজচ্যুত, প্রশাসন নীরব প্রতীকী ছবি।
সরেজমিনে জানা গেছে, গ্রাম্য মোড়লের ভাইয়ের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনায় এবং এক ইউপি সদস্যের মূর্তির ব্যবসা করার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সালিশ বসিয়ে ওই দুই নারীকে পরিবারের সদস্যসহ একঘরে করে রাখা হয়েছে। হতদরিদ্র পরিবার দুটি দিনের পর দিন মানবেতর জীবনযাপন করলেও প্রশাসনের উদ্যোগ দায়সারা।

গৃহবধূ বেলী খাতুনের স্বামী অন্যের বাড়িতে দিনহাজিরা চুক্তিতে কৃষাণের কাজ করেন। কর্মস্থলের মালিক তার পরিবারের সঙ্গে কৃষাণের পরিবারকেও গত কুরবানির ঈদের ছুটিতে কুয়াকাটায় বেড়াতে নিয়ে যান। আর গরিবের এই বেড়াতে যাওয়াটাই কাল হয়েছে।

চল্লিশোর্ধ্ব বেলী খাতুন কুয়াকাটায় গিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন- এমন অপবাদ দিয়ে গ্রামে রীতিমতো সালিশ বসিয়ে এই ‘অপরাধের’ জন্য জরিমানা করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা।

জরিমানার টাকা দিতে না পারায় দরিদ্র পরিবারটিকে এক সপ্তাহ ধরে সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে। গ্রামের পক্ষ থেকে পালা করে পাহারা বসিয়ে পরিবারটির ওপর নজরদারিও করা হচ্ছে। এ অবস্থায় অসহায় দরিদ্র পরিবারটি মানবেতর জীবনযাপন করছে।

অপর গৃহবধূ বিউটি খাতুনের ক্ষেত্রেই প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে। তাকেও ওই সালিশ ডেকে ‘চরিত্রহীন’ ও ‘মূর্তি ব্যবসায়ী’ আখ্যা দিয়ে করা হয়েছে একঘরে। তাকেও একই অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অবশ্য তিন দিন পর ১০ হাজার টাকা সমাজপতিদের হাতে তুলে দেয়ায় তার ‘শাস্তি’ শিথিল করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার তালম ইউনিয়নের গাবরগাড়ি গ্রামে ঘটেছে এমন বর্বর ঘটনা। তবে ঘটনার এক সপ্তাহ পার হলেও প্রশাসন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি।

সমাজচ্যুত হওয়ার পর থেকে আমি ও পরিবারের সদস্যরা বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনো কাজে যেতে পারছি না। এমনকি স্বজনের বাড়িতেও যেতে দেয়া হচ্ছে না। মাতব্বরদের ভয়ে গ্রামবাসী কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। এমনকি আমার নিজের মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে পারছি না। এই কষ্ট কইবার মতো কোনো মানুষও নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, চরিত্রের ত্রুটি আছে- এমন অভিযোগ এনে গাবরগাড়ি গ্রামে দুই নারীকে এক সপ্তাহ ধরে সমাজচ্যুত করে রেখেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্যের নেতৃত্বে কতিপয় গ্রাম্য মাতব্বর। আর ওই নারীরা সমাজচ্যুত হওয়ার পর থেকে গ্রামের কারও কথা বলতে পারছেন না। পারছেন না কএনা বাড়িতে বা বাজারে যেতে। লোকলজ্জায় ঘরের কোণে বসে চোখের জল ফেলছেন শুধু।

ভুক্তভোগী পরিবার ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানা যায়।

‘গাবরগাড়ি গ্রামে পরস্পর স্বজন দুই নারী রাত করে বাড়ি ফেরেন। আবার মাঝেমধ্যেই বেড়াতে যান এখানে-সেখানে। এটা চারিত্রিক ক্রটির অংশ।’- মাস দুয়েক আগে গাবরগাড়ি গ্রামের মোড়লদের কাছে এমন অভিযোগ করেন ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা।

তৎপর হয়ে ওঠেন গ্রাম্য মোড়লরাও। তারপর এ নিয়ে ওই গ্রামের মো. জয়নাল মণ্ডলের বাড়ির উঠোনে সালিশ বৈঠক বসে। সেখানে ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা, গ্রামপ্রধান আলতাব হোসেন, মোজাম্মেল হক মন্টু, জুয়েল রানা, শফিকুল, বুলু ও আজিজুল হকসহ শতাধিক গ্রামবাসী উপস্থিত ছিলেন। সেই সালিশে নানামুখী আলোচনা শেষে দুই নারীর চরিত্রের ত্রুটি আছে এমন অভিযোগ এনে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পাশাপাশি তাদের দু’জনকে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানার ঘোষণা দেয়া হয়।

গ্রাম্য মোড়লদের এমন সালিশি সিদ্ধান্তে দিশেহারা হয়ে পড়েন দরিদ্র ওই নারীরা। তারা এই জরিমানার টাকা দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন।

জরিমানা না দিয়ে গ্রামপ্রধানদের অপমান করা হয়েছে- এমন অভিযোগ এনে ১৬ সেপ্টেম্বর পুনরায় একই স্থানে গ্রাম্য সালিশ বৈঠক বসে। সেখানে জরিমানার টাকা পরিশোধ না করায় অভিযুক্ত দুই নারীর পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়া হয়।

একইসঙ্গে গ্রামবাসী কারও সঙ্গে তাদের কথা বলা, মেলামেশা এবং কারও বাড়ি দিয়ে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি সমাজচ্যুত দুই নারীর একজন যাতে নিজের মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে না পারেন সে জন্য সালিশের দিন থেকেই পাহারাদার নিয়োগ করেছেন গ্রাম্যপ্রধানরা। এরপর থেকে ওই দুই নারী পরিবারসহ সমাজচ্যুত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

অভিযুক্তদের একজন ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, গ্রামের কিছু নিয়মকানুন থাকে। সেটা না মানায় তাদেরকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তাদের একজন ক্ষমা চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশ শিথিল করা হয়েছে। অপর নারী গ্রামপ্রধানদের কাছে এসে ক্ষমা চাইলে তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশও শিথিল করা হবে।

এদিকে দ্বিতীয় দফা সালিশের পর অভিযুক্ত নারীদের একজন জরিমানার ২০ হাজার টাকার মধ্যে ১০ হাজার টাকা গ্রামপ্রধানদের হাতে তুলে দিয়ে তাকে মাফ করে দিতে বলেন। এতে ‘সন্তুষ্ট’ হয়ে গ্রামপ্রধানরা ওই নারীর বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির ‘আদেশ’ কিছুটা শিথিল করেছেন।

আর অপর নারী জরিমানার টাকা দিতে না পারায় তার ওপর সমাজচ্যুতি নির্দেশ বহাল রাখা হয়েছে।

বেলী খাতুন বলেন, ‘সমাজচ্যুত হওয়ার পর থেকে আমি ও পরিবারের সদস্যরা বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনো কাজে যেতে পারছি না। এমনকি স্বজনের বাড়িতেও যেতে দেয়া হচ্ছে না। মাতব্বরদের ভয়ে গ্রামবাসী কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। এমনকি আমার নিজের মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে পারছি না। এই কষ্ট কইবার মতো কোনো মানুষও নেই।’

এ বিষয়ে গ্রামপ্রধান ও ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘গ্রামের কিছু নিয়মকানুন থাকে। সেটা না মানায় তাদেরকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তাদের একজন ক্ষমা চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশ শিথিল করা হয়েছে। অপর নারী গ্রামপ্রধানদের কাছে এসে ক্ষমা চাইলে তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশও শিথিল করা হবে।’

তাড়াশের ইউএনও মো. সোহেল রানা বলেন, ঘটনাটি জানার পর ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যকে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করতে বলে দিয়েছি।

তবে ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা ও গ্রামপ্রধান বুলুর সঙ্গে পূর্বশত্রুতার জের ধরে এ‌ই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ওই দুই নারী। তাদের একজন দুই বছর আগে গ্রামপ্রধান বুলুর ভাইয়ের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। আর অপরজন ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফার কথামতো মূর্তির ব্যবসায় রাজি না হওয়ায় ষড়যন্ত্র করে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে তালম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল খালেক বলেন, ‘ঘটনাটি নিন্দ্যনীয়। বিষয়টি মিমাংসার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

তাড়াশ থানার ওসি মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর ঘটনাস্থলে থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) নূরে আলমকে পাঠানো হয়েছে। আর সমাজচ্যুতির বিষয়টি মিমাংসার জন্য গ্রামপ্রধানদের বলা হয়েছে। তারা সতর্ক না হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোহেল রানা বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পর ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যকে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করতে বলে দিয়েছি।’

আরও পড়ুন:
সালিশেই কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা
সালিশে মারধরের পর যুবকের মৃত্যুতে পরিবারের মামলা

মন্তব্য

বিশেষ
The sword of rumors has been cut on the necks of small ethnic groups
রাউজানে শিবলি সাদিক হত্যা

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঘাড়ে ‘মানুষখেকো’ গুজবের খড়্‌গ

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঘাড়ে ‘মানুষখেকো’ গুজবের খড়্‌গ শিবলি সাদিক। ফাইল ছবি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্টে দাবি করা হচ্ছে- কলেজছাত্র শিবলিকে হত্যার পর অভিযুক্তরা তার ‘মাংস রান্না করে খেয়েছে’। একইসঙ্গে ‘মানুষখেকো’ আখ্যা দিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে। এতে করে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

চট্টগ্রামের রাউজানে এক কলেজছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানামুখী গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলোতে ভর করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে বানায়োট গল্প, ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্ট ফেসবুক-টিকটকের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্টে দাবি করা হচ্ছে- ওই কলেজছাত্রকে হত্যার পর অভিযুক্তরা তার ‘মাংস রান্না করে খেয়েছে’। একইসঙ্গে পাহাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে ‘মানুষখেকো’ আখ্যা দিয়ে এই জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষমূলক নানা বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া এসব গুজব ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা বিব্রতকর পরিস্থিতি ও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

শুধু তাই নয়, এ ধরনের গুজব ও পাহাড়ে বসবাসকারী গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর ফলে এই অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে- এটা কি নিতান্তই গুজব? নাকি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে এটা সৃষ্টি করেছে এবং বিরামহীন ‘জ্বালানি’ সরবরাহ করে চলেছে?

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের হেনস্তার অভিযোগ

দৈবভাবে পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৭ জন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাদের মধ্যে ৫ জন অবাধ চলাচল করতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিদ্বেষমূলক এই গুজবের ফলে কোনো না কোনো সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

তাদের একজন চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করা নীলা চাকমা। তিনি জানান, কাজের সুবাদে তাকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে থাকতে হয়। রাউজানের ওই কলেজছাত্র খুনের পর শহরে বসবাস করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে বলে দাবি তার।

নীলা চাকমা বলেন, ‘নিজ এলাকার বাইরে ভাষাসহ নানা কারণে আমরা বুলিংয়ের শিকার হই। এখন মানুষের মাংস খাওয়ার আরেকটা ট্যাগ যুক্ত হলো। এই যে রিকশাওয়ালা মামা, সবজিওয়ালা, দোকানদাররা বলতেছে, আমি খুবই অনিরাপত্তায় ভুগছি।

‘কয়েকদিন আগে আমি এক বান্ধবীর সঙ্গে নগরীর অক্সিজেন এলাকায় অনন্যা আবাসিকে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে একজন আমাকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করেছে। প্রতিবাদ করায় ওই ব্যক্তি আমার সঙ্গে বাদানুবাদে মানুষের মাংস খাওয়ার বিষয় টেনে আনেন।’

তিনি আরও বলেন, “সামসাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো থাকতেই পারছি না। নিউজফিডে ২০টি নিউজ থাকলে তার মধ্যে ১০টিই আমাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক। মেসেঞ্জারে বন্ধুরা বলতেছে- ‘তোরা তো এই খাস; তোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবে না।’ এমনকি গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট মানুষও আছে এই তালিকায়।”

আরেক ভুক্তভোগী অভি চাকমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রাউজানের ওই ঘটনার পর যখন ফেসবুকে আমরা মানুষের মাংস খাই বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, এর কয়েকদিন পর ক্লাস থেকে ফেরার পথে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের দিকে দুই তরুণীর সঙ্গে দেখা। তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই মনে হয়েছে। ওরা আমাদের দেখে এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে যেন আমরা বোধহয় জ্যান্ত মানুষ খেয়ে ফেলি।

‘আবার নিজেদের মধ্যেও বলাবলি করছিল- রাউজানের ওই ঘটনার পর পাহাড়ি দেখলেই ভয় লাগে। কথাটা আমি শুনে ফেলায় ওদেরকে বলেছি, কয়েকজন অপরাধ করলেই সেই দায় পুরো জনগোষ্ঠীর হতে পারে না। তাছাড়া মানুষের মাংস খাওয়ার বিষয়টিও গুজব।’

চট্টগ্রাম শহরে কর্মক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার স্বপন চাকমা নামের আরও একজনের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। শহরের বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার কনডেন্সড মিল্ক উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি৷

নিউজবাংলাকে স্বপন বলেন, “ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার সময় রাস্তাঘাটে মানুষজন আমাদের দেখলে বলে, ‘তোমাদের চাকমারা নাকি মানুষের মাংস খায়?’ এমনকি ফ্যাক্টরির ভেতর আমাদের সুপারভাইজারও প্রশ্নের সুরে বলেন- তোমরা চাকমারা নাকি মানুষের মাংস খাও। তখন স্বাভাবিকভাবেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”

গুজবটা যেভাবে ছড়ালো

ঘটনার শুরু ১১ সেপ্টেম্বর। ওইদিন রাঙামাটি জেলার কাউখালী ইউনিয়নের দুর্গম বালু পাহাড় এলাকা থেকে এক কলেজ শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত শিবলি সাদিক রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়ার মুহাম্মদ শফির ছেলে। কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্থানীয় একটি মুরগির খামারে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। মরদেহ উদ্ধারের ১৪ দিন আগে ওই খামার থেকে অপহরণ করা হয়েছিল তাকে।

পুলিশ জানায়, শিবলির সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে আরো ৬ জন কাজ করত। তারা সবাই পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য। ঘটনার মাসখানেক আগে তাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় শিবলির। খামার মালিক সে সময় ঘটনাটি মিমাংসা করে দিলেও ক্ষুব্ধ ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শ্রমিকরা। সেই ক্ষোভ থেকে ২৭ আগস্ট রাতে শিবলিকে অপহরণ করে আট কিলোমিটার দূরের গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায় তারা।

পরবর্তীতে স্বজনদের ফোন করে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। এক পর্যায়ে ১ সেপ্টেম্বর শিবলির বাবা শফি গিয়ে বান্দরবানে অপহরণকারীদের কথামতো দুই ব্যক্তিকে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আসেন। এর আগে ৩১ আগস্ট সবশেষ তাদের সঙ্গে শিবলির কথা বলিয়ে দেয় অপহরণকারীরা।

‘ছেড়ে দেয়া হয়েছে, বাসায় চলে যাবে’- মুক্তিপণ পাওয়ার পর অপহরণকারীরা স্বজনদের আশ্বাস দিলেও বাসায় ফেরেননি শিবলি। এ ঘটনায় ৭ সেপ্টেম্বর রাউজান থানায় মামলা করেন স্বজনরা। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুইচিংমং মারমা ও অংথুইমং মারমা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে উমংচিং মারমা নামে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১১ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির কাউখালী ইউনিয়নের দুর্গম বালু পাহাড় এলাকা থেকে শিবলি সাদিকের দেহাবশেষ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহ নিয়ে ফেরার পথে উমংচিং মারমাকে পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে উত্তেজিত জনতা।

গুজবের শুরু

মরদেহ উদ্ধার ও একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনার পরপরই নিহত শিবলির দেহাবশেষের ছবি এবং অভিযুক্তদের যৌথ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ছবির ক্যাপশনে দাবি করা হয়- ‘হত্যাকারীরা শিবলিকে হত্যার পর তার মাংস রান্না করে খেয়ে হাড়গোড় পাহাড়ে ফেলে দিয়েছে।’

কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অনেকেই এই গুজবের ওপর ভিত্তি করে ভিডিও তৈরি করে ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শেয়ার করতে থাকে। কেউ কেউ ফটোকার্ড তৈরি করেও তা শেয়ার করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে শুধু ফেসবুক ও ইউটিউবে অধিকতর অনুসন্ধান পদ্ধতিতে (অ্যাডভান্স সার্স সিস্টেম) যাচাই করে এই গুজব ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো সংক্রান্ত সহস্রাধিক পোস্টের সন্ধান পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। এসব পোস্টের মধ্যে অধিকাংশের বক্তব্য আপত্তিকর হওয়ায় এই প্রতিবেদনে যুক্ত করা যায়নি।

আওয়ামী লীগ নেতার দাবি, ঘটনা সত্য

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। গুজবটি এত দ্রুত ছড়িয়েছে যে দায়িত্বশীল অনেকেই বিশ্বাস করে তা নিয়ে কথা বলেছেন।

বাস্তবেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলেছে দাবি করেছেন রাঙামাটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুসা মাতব্বর। তার বক্তব্যের একটি ভিডিও ইতোমধ্যে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ১ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের ওই বক্তব্যের প্রথম অংশে তিনি রাউজানে খুনের শিকার এক কিশোরের মাংস রান্না করে খাওয়ার অভিযোগ করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে প্রথম ৪৩ সেকেণ্ডে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘গত দুই-তিনদিন আগে রাউজানের একটি ছেলেকে অপহরণ করে রাঙ্গামাটির কাউখালিতে এনে তার মাংস পর্যন্ত তারা কেটেকুটে রান্না করে খেয়েছে। এটা দুঃখজনক রাঙ্গামাটিবাসীর জন্য। এ ধরনের ঘটনা যেন পরবর্তীতে আর না ঘটে, আমরা আবেদন জানাব সরকারের কাছে। এগুলো, এই হত্যাকাণ্ডগুলো আসলে মানুষ কোনো অবস্থাতে, যে কোনো মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। সবাইকে বলব, এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ- মানুষের মাংস রান্না করে খাওয়া, এটা কত বড় অপরাধ! আমি বলার, মুখের ভাষাই পাচ্ছি না, কী বলব আমি!’

পরের ১ মিনিটে পাহাড়ে অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন তিনি।

অবশ্য বক্তব্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি। ব্যস্ততার অজুহাত তুলে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতেও রাজি হননি তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটি প্রথম প্রকাশ করে ‘সম্প্রীতির রাঙ্গামাটি’ নামের এক ফেসবুক পেজ। এই ফেসবুক পেজের মালিক ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি অবজারভারের রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি শেখ ইমতিয়াজ কামাল ইমন।

১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে ইমনের সঙ্গে কথা বলে নিউজবাংলা। তিনি বলেন, ‘৪ থেকে ৫ দিন আগে নির্বাচন নিয়ে আমরা চার থেকে পাঁচটা গণমাধ্যম ওনার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আমাদের মধ্যে একজন ওনাকে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করলে ওনি এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমার কাছে র-ভিডিও (মূল ভিডিও) আছে।’

মরদেহ উদ্ধারকারী পুলিশ যা বলছে

শিবলি সাদিক হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। তাদের মধ্যে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে তিন জন। তবে তাদের কেউই শিবলির মাংস রান্না করে খাওয়ার বিষয়ে কিছু বলেনি বলে দাবি পুলিশের।

মরদেহ উদ্ধার ও আসামিদের গ্রেপ্তারের অভিযানিক দলে ছিলেন রাউজান থানার উপ-পরিদর্শক আজিজুল হক। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও তিনি।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রান্না করে তার মাংস খাওয়ার খবরটি ভুয়া। এসবের ভিত্তি নেই। এ বিষয়ে আমরা নিজেরাই তো কিছু পাইনি। ব্লগাররা ভাইরাল হওয়ার জন্য এটা ছড়াচ্ছে। এটা নিয়ে আমাদের সাইবার টিম মাঠে নামছে।

আমাদের স্যারও (ওসি) এটা নিয়ে কথা বলেছেন। যারা এসব ভুয়া নিউজ ছড়িয়ে দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এই মামলায় সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরই এক মেয়ে। তিনি আমাদের একজন কনস্টেবল। যেহেতু ভাষার একটা সমস্যা আছে, আমরা ওর সহযোগিতায় কাজগুলো করছি।’

প্রায় একই কথা বলেন রাউজান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘হত্যায় জড়িতরা নিহতের মাংস রান্না করে খেয়েছে- এরকম কোনো তথ্য আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। যারা এগুলো ছড়াচ্ছে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে যে তারা এসব তথ্য কোথায় পেলেন!’

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অপহরণের ১৪ দিন পর আমরা দেহাবশেষ পেয়েছি। যে এলাকা থেকে দেহাবশেষ উদ্ধার করেছি, এর আশপাশের ৮ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাড়িঘর নেই।

‘জায়গাটি পাহাড়ি গভীর জঙ্গল এলাকা। জনবসতিশূন্য এই জঙ্গলে বিভিন্ন প্রাণী থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সেসব প্রাণী মরদেহের অংশবিশেষ খেয়ে থাকতে পারে।’

‘আমরা তো জানি যে, মানুষের মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে মরদেহের পচন শুরু হয়। মরদেহটি পাওয়া গেছে হত্যার ৮ থেকে ১০ তিন পর। তাই আমাদের ধারণা, শেয়াল বা অন্য কোনো প্রাণী মরদেহ খেয়ে ফেলেছে, নয়তো পচে গেছে।’ যোগ করেন তিনি।

তবে জবানবন্দি দেয়া তিনজনের একজন ওই এলাকায় একদিন রাতে মুরগির মাংস ও ভাত রান্না করে খাওয়ার কথা জানিয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, ‘যেহেতু তারা সেখানে ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই মুরগি-ভাত রান্না করে তারা এক রাতে খেয়েছে।’

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যা বললেন

পুলিশ ও নিহতের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সবশেষ ৩১ আগস্ট পরিবারের সঙ্গে শিবলি সাদিকের কথা বলিয়ে দিয়েছে অপহরণকারীরা। এর পরপরই তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এরপর মরদেহ উদ্ধার করা হয় ১১ সেপ্টেম্বর। মাঝে ১১ থেকে ১২ দিন মরদেহটি গভীর পাহাড়ি জঙ্গলেই ছিল।

সাধারণত মরদেহে পচন শুরু হয় পরিবেশ, তাপমাত্রা, ঋতু, মরদেহের ধরনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে।

রাঙ্গামাটির ওই পাহাড়ি গভীর জঙ্গলে ১০ থেকে ১২ দিনে একটা মরদেহের কী অবস্থা হতে পারে তা জানতে চাওয়া হয় ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. কাশেমের কাছে। তিনি বলেন, ‘মরদেহের মাংস পচে যাবে। কিছু মাংসসহ হাড় অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিছু মাংস শরীরে সংযুক্ত থাকতে পারে।’

তবে গভীর জঙ্গলে একটা মরদেহ পড়ে থাকলে বিভিন্ন প্রাণী তা খেয়ে ফেলতে পারে বলে ধারণা তার।

ডা. কাশেম আরও বলেন, ‘বিভিন্ন প্রাণী মরদেহের বিভিন্ন অংশ খেয়ে ফেলতে পারে। তবে তা কোনো প্রাণী খেয়েছে নাকি কোনো অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে তা জানতে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে মরদেহ পরীক্ষা করতে হবে। মোটামুটি পচে গেলেও তিনি এ বিষয়ে বলতে পারবেন।’

রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বলছেন মানবাধিকার কর্মীরা

বর্তমানে দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। তাদের অধিকাংশেরই বাস পার্বত্য চট্টগ্রামে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ‘মানুষের মাংস খাওয়া’ গুজবকে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।

মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘এটা একটা সাম্প্রদায়িক উষ্কানি ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র। এটা যারা করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এই অপতৎপরতায় নিরীহ লোকজন হয়রানির শিকার হচ্ছে। একটা সম্প্রদায়কে টার্গেট করে এভাবে গুজব ছড়ানো একটা গভীর চক্রান্ত বলে মনে হচ্ছে। যে যা-ই করুক, অতীতেও এই অঞ্চলে শান্তি নষ্টের চেষ্টা করেছে, পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না ইনশাআল্লাহ।’

মাঠে নামছে সাইবার পুলিশ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের গুজব যারা ছড়িয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনার কথা জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার পুলিশ সেন্টার) খন্দকার তৌহিদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা হলে আমরা সাধারণত বিটিআরসির মাধ্যমে এ ধরনের গুজবের লিংকগুলো বন্ধ করে দেই। তাছাড়া এ ধরনের গুজব ছড়ানোর পেছনে যারা জড়িত তাদেরও শনাক্ত করা হবে। শনাক্তের পর সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

মন্তব্য

বিশেষ
Canal filled roads waterlogging illegal connections torn wires electrified water
মিরপুরে ৪ প্রাণহানি

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের তার বেড়িয়েছে এসেছে, দুর্ঘটনার সময় পানি জমেছে সড়কে এবং বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুতের লাইন (বাঁ থেকে) । ছবি: নিউজবাংলা
সড়কটির পাশে খাল ভরাট করায় বৃষ্টি হলেই ওই এলাকায় পানি আটকে থাকে। জলাবদ্ধ হয়ে থাকে পুরো এলাকা। আর যে বিদ্যুতের লাইনের লিকেজ তার এই পানিতে পড়ে পানি বিদ্যুতায়িত হয়েছে, সেই বিদ্যুতের সংযোগই অবৈধ।

রাজধানীর মিরপুর কমার্স কলেজসংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে হাজী রোডে বি ব্লকের মুক্তা ফার্মেসির সামনে বৃষ্টির পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। অবৈধভাবে নেয়া বিদ্যুৎ সংযোগের লিকেজ থেকে এ সড়কে জমে থাকা পানি বিদ্যুতায়িত হওয়ার খবর হয়তো জানতেন না এদের কেউই। তবে যারা সেখানকার স্থানীয়, তারা অনেক দিন ধরেই ধারণা করতেন এমন বড় বিপদের।

সড়কটির পাশে খাল ভরাট করায় বৃষ্টি হলেই ওই এলাকায় পানি আটকে থাকে। জলাবদ্ধ হয়ে থাকে পুরো এলাকা। আর যে বিদ্যুতের লাইনের লিকেজ তার এই পানিতে পড়ে পানি বিদ্যুতায়িত হয়েছে, সেই বিদ্যুতের সংযোগই অবৈধ।

বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীতে মুষলধারে বৃষ্টিতে পানি জমে যায় অনেক সড়কে। এর মধ্যে একটি হলো মিরপুরের ওই এলাকা। রাত ১০টার দিকে ওই সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান ৩০ বছরের মো. মিজান, তার স্ত্রী ২৫ বছরের মুক্তা বেগম, মেয়ে ৭ বছরের লিমা। তাদের বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছ ২০ বছর বয়সী মো. অনিকের। তবে পানি থেকে উদ্ধার করা মিজানের ৭ মাস বয়সী ছেলে হোসাইন প্রাণে বেঁচে গেছে।

নিউজবাংলার অনুসন্ধানে এই চারজনের মৃত্যুর জন্য দুটি কারণ পাওয়া যায়। একটি বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ও অন্যটি খাল ভরাট।

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি
অবৈধভাবে নেয়া সংযোগের তার লিকেজ বেরিয়ে এসেছে ড্রেন দিয়ে । ছবি: নিউজবাংলা

অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঝিলপাড় বস্তির সামনে ও হাজী রোডের পেছনে মিরপর-২ ডুইপ আবাসিক এলাকার বি ব্লকের দুই নম্বর রোডে থাকা বিদ্যুতের পিলার থেকে ওই বস্তির অবৈধ বিদ্যুতের লাইন নেয়া হয়েছে। যে দুটি পিলার থেকে এই অবৈধ সংযোগ নেয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে সংযোগের তার কাটা অবস্থায় দেখা যায়। এই দুই পিলারের একটির অবস্থান মুক্ত ফার্মেসি ভবনের পেছনে।

মুক্তা ফার্মেসির ভবনের লাগোয়া সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার ছাদ দিয়ে লাইন টানা হয়েছে। এই লাইন ভবনের দেয়াল দিয়ে নামানো হয়েছে ভবনের সামনের ড্রেনে। কেউ যাতে না বুঝতে পারে এই কারণে মাদরাসার ছাদে ও ভবনের যে দেয়াল দিয়ে তার টানা হয়েছে; এই অংশ সিমেন্ট-বালু দিয়ে প্লাস্টার করে ঢাকা হয়েছে। এই প্লাস্টারের ভেতর দিয়ে এখনো তার দেখা যাচ্ছে।

প্লাস্টার পার হয়ে সামনের ড্রেনের ভেতর দিয়ে বস্তিতে তার টানা হয়েছে। ড্রেনের ভেতরের তার কসটেপ দিয়ে পেঁচানো হয়েছে। আর এই তারের লিকেজেই বিদ্যুতায়িত হয় সড়কের পানি, যাতে হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

মুক্তা ফার্মেসি ও ভবনটির মালিক জসিম উদ্দিন পাটোয়ারী। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীও তিনি।

চোরাই লাইনের বিষয়ে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের চোরাই লাইনগুলো আমার বাসার পেছনে ডুইপ আবাসিক এলাকার বি ব্লকের দুই নম্বর রোডের পিলার থেকে নেয়া হয়েছে। অধিক লোডের কারণে এই পিলারে মাঝে মাঝেই আগুন জলে ওঠে। পিলার থেকে লাইন টেনে আমার ভবনের লাগোয়া সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার ছাদ দিয়ে লাইন টানা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের অবৈধ লাইন টানার স্থান দিয়ে প্লাস্টার করে বিদ্যুতের লাইন ঢাকা হয়েছে। বস্তিবাসী মাঝে মাঝে গভীর রাতে প্লাস্টার ভেঙে লাইন ঠিক করে। আমার ছোট মেয়ে অসুস্থ। প্লাস্টার ভাঙার শব্দ ও পিলারে আগুন জলার কারণে আমার অসুস্থ ছোট মেয়ে ভয় পায়। তাই তাকে তার বড় বোনের বাসায় রেখেছি।’

জসিম উদ্দিন বলেন, ‘অবৈধ বিদ্যুতের লাইনের জন্য আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। কখন যে আগুন লেগে আমার বাসা পুড়ে যায়।’

ঝিলপাড় বস্তিতে যেসব বাসা ভাড়া দেয়া হয়, তার সঙ্গে বিদ্যুৎ বিলও যুক্ত করা হয়। এ কারণে যারা বাসা ভাড়া দেন তাদের বেশিরভাগই বিদ্যুতের চোরাই লাইন ব্যবহার করেন। অবশ্য এই বস্তিতে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) কিছু প্রিপেইড মিটার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এক মিটার থেকে একাধিক বাসায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া আছে।

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি
খাল দখল করে স্থাপনা। ছবি: নিউজবাংলা

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির একাধিক ব্যক্তি নিউজবাংলাকে বলেন, যারা বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন তারা ডেসকোর সঙ্গে যোগসাজসে বিদ্যুতের চোরাই লাইন বস্তিতে সংযোগ করেছেন। প্রতিমাসে ডেসকোর লোকজন চোরাই লাইন বাবদ টাকা নিয়ে থাকেন।

নিহত অনিকের মামা মোক্তার হোসেন বলেন, ‘ডেস্কোর লোকজন চাইলেই চোরাই লাইন বন্ধ করতে পারে। তারা করবে না। কেন করবে না সেটা আপনারা জানেন। ডেসকোর কাছে একটাই চাওয়া এরকম দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে।’

বস্তিতে বেশ কয়েকজন ঘর ভাড়া দিয়ে থাকেন। তারাই এই চোরাই লাইন ডেসকোর সহযোগিতায় চালিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর সঙ্গে লাইলি, মমিন, জাহাঙ্গীর, আলমগীর মোল্লার স্ত্রী ও শ্যালিকাসহ আরও অনেকে জড়িত বলে দাবি করে স্থানীয়রা।

যা বলছে ডেসকো

চোরাই লাইন ও বস্তির নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে ডেসকোর কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগের বিষয়ে জানার পর ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি অবশ্যই এই বিষয়ে তথ্য নেব। আমাদের কর্মকর্তাদের বিষয়ে যে অভিযোগ এ রকম তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে চোরাই লাইন থাকতে পারে। আমরা প্রতিনিয়ত এই সব জায়গায় দিনে ও রাতে অভিযান চালাই। ’

ঝিলপাড় বস্তি এলাকায় সুষ্ঠুভাবে বিদ্যুতের লাইন দেয়া যায় না এবং ভেতরে লাইন টানা যায় না- এ কারণেই এই ধরনের ঘটনা বলে জানান এই প্রকৌশলী। এ ছাড়া চোরাই লাইন এখানে চলে বলেও স্বীকার করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কারো জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া বস্তি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কষ্টকর সেটা আপনারা জানেন। তবে প্রতিনিয়ত ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে ও টিম পাঠিয়ে আমরা তদারকি করছি।’

মিরপর-২ ডুইপ আবাসিক এলাকার বি ব্লকের দুই নম্বর রোডের পিলার থেকে যে বিদ্যুতের অবৈধ লাইন টানা হয়েছে, এটা কি এতদিন জানতেন- এমন প্রশ্নে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমি নিজে তো আর দেখি নাই। আমরা প্রতিনিয়ত টিম পাঠিয়ে তার কেটে নিয়ে আসি। প্রতি দিন তো আর যাওয়া হয় না।

‘সপ্তাহে একবার গিয়ে তার কেটে নিয়ে আসে। যখন কেটে নিয়ে আসি, তার পর আবার একই অবস্থা। এই ধরনের কাজে আমরা যাদের নাম পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছি।’

যারা অবৈধ লাইন টানেন তাদের কাউকে কি আপনারা এখনো আইনের আওতায় আনতে পেরেছেন- এমন প্রশ্নে এই প্রকৌশলী কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

তিনি বলেন, ‘আমরা চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় একটা তদন্ত কমিটি করবো। আমাদের পক্ষ থেকে যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার আমরা সেটা করবো।’

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি
কান্নায় ভেঙে পড়েন মুক্তার মা। ছবি: নিউজবাংলা

খাল ভরাট

ঝিলপাড় বস্তি ও সামনের হাজী রোড ঢালু এলাকা। বৃষ্টিতে মিরপুর-২ এলাকার পানি গড়িয়ে এই হাজী রোডে নামে। ৩/৪ বছর আগে এই পানি ঝিলপাড় বস্তির পূর্ব পাশে থাকা ৪০ ফিট প্রশস্ত খাল দিয়ে চলে যেত। এতে এই এলাকা ও বস্তিতে জলাবদ্ধতা হতো না।

তবে দুই থেকে তিন বছর ধরে এই খাল ভরাট করা হয়েছে। ৮-৯ মাস আগে বস্তির পেছনে থাকা দারুল আমান গৃহ নির্মাণ সমিতি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ খালটি ভরাট করে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। মসজিদের সামনের অংশের কাজ এখনো চলমান।

অভিযোগ আছে, এই মসজিদে দারুল আমান গৃহ নির্মাণ সমিতি লিমিটেডের আওতায় থাকা ভবনের মানুষ ছাড়া বস্তিবাসীদের নামাজ আদায় করতে দেয়া হয় না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির একাধিক বাসিন্দা নিউজবাংলাকে বলেন, খালটা যখন চালু ছিল তখন মিরপুর-২ নম্বর এলাকা থেকে যে পানি আসতো এই পানি খাল দিয়ে চলে যেত। বস্তির পেছনে একটি ঝিল এখনো আছে। খাল দিয়ে এই ঝিল হয়ে পানি চলে যেত। কিন্তু ২-৩ বছর ধরে এই খাল ভরাট করেছে দারুল আমান গৃহ নির্মাণ সমিতি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। আর ৮ মাস আগে মসজিদ নির্মাণ করেছে তারা।

স্থানীয়রা বলেন, ৪০ ফিট প্রস্থের এই খালের ওপরে মসজিদ বানিয়ে খাল দখল করা হয়েছে। আমরা বস্তির লোকজন মিলে খাল দখল করার সময় অনেক বাধা দিয়েছিলাম।

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি
খাল দিয়ে পানি মেশার কথা এই স্থানে, অথচ তা আটেকে যায় সড়কে। ছবি: নিউজবাংলা

বস্তিবাসীরা অভিযোগ করে বলেন, খালটা বন্ধ না করলে রাস্তায় পানি জমতো না। আর পানি না জমলে চারটা মানুষকে মরতে হতো না।

এই হাউজিং ঘুরে এবং কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এখানকার হাউজিং কর্তৃপক্ষের কারও ফোন নম্বর পাওয়া যায়নি।

দারুল আমান গৃহ নির্মাণ সমিতির সিকিউটিদের প্রধান মো. সামসুলের কাছে এই হাউজিংয়ের কর্তৃপক্ষের নম্বর চাইলে তিনি বলেন, ‘এই হাউজিংয়ে নতুন কমিটি হয়েছে। কারও নম্বর আমার কাছে নাই।’

খাল ভরাটের বিষয় ‘জানত না’ সিটি করপোরেশন

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা জানান, খাল ভরাটের বিষয়টি সিটি করপোরেশন জানত না।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা কয়েকটা ঘটনার সমাহার। ডেসকোর অবৈধ বিদ্যুতের লাইন মাদরাসার ভেতর দিয়ে নিয়েছে। এই তার সেখানে পড়ে ছিল। তা ছাড়া এখানে পানি প্রবাহ ডায়ভার্ট করা হয়েছে। খাল দখল করে মসজিদ তৈরি করেছে। মসজিদ রাতারাতি ভেঙে দেয়া যায় না।

‘আমাদের কাছে খাল দখল করে মসজিদ বানানোর বিষয়ে কেউ অভিযোগ দেয়নি। আমাদের অবগত করলে আমরা এলাউ করতাম না। লোকালি কারা কারা জড়িত এই খাল দখলে সেটা খতিয়ে দেখা হবে।’

খাল দখলের সময় বস্তিবাসী বিক্ষোভ করেছে- এমন প্রশ্নে সেলিম রেজা বলেন, ‘খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে অভিযোগের বিষয়তা কতটুকু ঠিক।’

২/৩ বছর ধরে খাল দখল করা হয়েছে। এটা তো রাতারাতি হয় নাই। এটা তো দেখভালের দায়িত্ব আপনাদের। উত্তরে তিনি বলেন, ঢাকা শহরের অনেক খাল ভরাট হয়ে গেছে। এই খাল কারা ভরাট করেছে, কিভাবে ভরাট করেছে, কেন উদ্ধার হয় নাই এটার জন্য যারা দাতিত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাদেরকে এর জবাব দিতে হবে।

এই এলাকার সিটি কর্পোরেশনের জনপ্রতিনিধি তার এলাকার খাল ভরাটের খবর রাখেন না, নাকি তিনিই জড়িত- এমন প্রশ্নের উত্তরে সেলিম রেজা বলে, এটা আমার নলেজে নাই। যাদের এই খাল ভরাটের বিষয়টি আমাদের নলেজে আনার কথা তারা নলেজে না আনলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

যাদের দায়িত্ব তারা আপনাকে জানালে অবশ্যই আপনি এই খাল ভরাটের বিষয়টি জানতে পারতেন, কিন্তু তারা আপনাকে তা জানায়নি- এমন প্রশ্নে সেলিম রেজা বলেন, ‘এটা তদন্ত করে দেখবো। কেউ এটার দায় এড়াতে পারবে না। মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ করে আমরা তদন্ত কমিটি করবো।’

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি
অবৈধভাবে নেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। ছবি: নিউজবাংলা

কেমন আছে হোসাইন

শুক্রবার দুপুরে বস্তির ভেতরে একটি টিনশেড ও আধাপাকা বাসার দোতলায় গিয়ে এক নারীর কোলে দেখা যায় বাবা-মা-বোন হারানো হোসাইনকে। ওই নারীকে হোসাইনকে চামচে করে পানি খাওয়াচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার প্রচুর পানি খাওয়াতে বলেছে।’

এ সময় হোসাইন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠতে থাকে। শিশুটিকে দেখে মনে হচ্ছিল সে তার মায়ের কোল চাচ্ছে। কিন্তু তার মা, বাবা ও বোন তখন মর্গের ফ্রিজে। হোসাইনকে ঘিরে ছিল অনেকেই। সবাই তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সে থামছেই না। হোসাইনের কান্না শুনতে শুনতেই এই প্রতিবেদক ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি
শিশু হোসাইন শুধু কাঁদছে। ছবি: নিউজবাংলা

মুক্তার মায়ের বাসায় বেড়াতে এসে মৃত্যু

বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাওয়া মুক্তার মা কুলসুম বেগম কাঁদতে কাঁদতে চুপ হয়ে গেছেন। কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। তিনি নিজেও অসুস্থ। কিছুক্ষণ পর পর কেঁদে উঠছেন। তাকে বস্তির অন্য নারীরা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কুলসুম বেগম তার স্বামী ও দুই বাচ্চাসহ বস্তিতে থাকেন।

পরে কথা হয় কুলসুম বেগমের প্রতিবেশী এবং ঘটনাস্থলের বিপরীত পাশে বস্তির সামনে গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানি ও তার স্ত্রী লাবনীর সঙ্গে। তাদের সঙ্গেই শেষ কথা হয় মুক্তা ও তার স্বামীর।

লাবনী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তা তার স্বামী ও দুই সন্তানসহ বুধবার গ্রাম থেকে ঢাকায় আসে। মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্সের পাশে তাদের বাসা। মুক্তার মা বাবা থাকে ঝিলপাড় বস্তিতে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় মুক্তা তার পরিবার নিয়ে বস্তিতে তার মায়ের বাসায় আসে। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে বৃষ্টির মধ্যেই তারা বের হয়। আমার স্বামীকে যাওয়ার সময় সালাম দেয় মুক্তা ও তার স্বামী মিজান। পরে খোঁজ খবর নিয়ে মিজান বলে, কাকা যাই গা। পরে রাস্তায় ওই পারে চলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘মুক্তার মা ৫০ টাকা দিয়ে বলেছিল রিকশা দিয়ে যেও। এর কিছুক্ষণ পরই এই ঘটনা। পরে বাচ্চাটাকে একজন পানি থেকে টেনে তুলে একজনের হাতে দেয়। পরে ছোট বাচ্চাটা বাঁচছে। মিজান ফুচকা ও ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন। মিজানের বাড়ি বরিশাল। মুক্তার বাড়ি ভোলা।’


মৃত্যুর এক দিন আগেই বিবাহবিচ্ছেদ হয় অনিকের

অনিক অটোরিকশাচালক ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টি শুরু হলে কমার্স কলেজসংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে একটি দোকানের সামনে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। বৃষ্টির কারণে সেখানকার রাস্তা তলিয়ে যায়। মৃত্যুর ফাঁদ ওয়ে ওঠা সড়কটিতে মিজান-মুক্তা দম্পতি ও সন্তানেরা বিদ্যুতায়িত হলে তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে মারা যান অনিক।

অনিকের মামা মোক্তার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনিকের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণার খালিয়াজুড়ি উপজেলার সাতগাঁও গ্রামে। এক বছর আগে অনিক বিয়ে করেছিল। বুধবার বিকেলেই অনিকের স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। আর বৃহস্পতিবার রাতে সে মারা গেল। ঢাকাতে সে একাই থাকত। ’

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি

মামলা ও পুলিশের ভাষ্য

অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিহত অনিকের বাবা বাবুল মিয়া মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে ঘটনাস্থলে গিয়ে সব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। রাত থেকেই বিষয়টা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। বিকেলে মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে তাদের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ঘটনায় যার-ই দায় পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

আরও পড়ুন:
শিশু হোসাইনকে বাঁচানোর গল্প শোনালেন আমেনা বেগম
বৃষ্টির পানিতে বাবা-মা-বোন হারানো শিশু হোসাইন হাসপাতাল ছেড়েছে
ঢাকায় জলমগ্ন সড়কে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৪ জনের মৃত্যু

মন্তব্য

বিশেষ
Bribery corruption BRTA officials

ঘুষ-দুর্নীতি চালাতে দালাল পোষেন বিআরটিএ কর্মকর্তা!

ঘুষ-দুর্নীতি চালাতে দালাল পোষেন বিআরটিএ কর্মকর্তা! বিআরটিএ অফিসকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়েছেন কিশোরগঞ্জের বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা
সরেজমিনে বিআরটিএ কর্মকর্তা মামুনুর রশীদের অফিসে অনুপস্থিতির সত্যতা পাওয়া যায়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে তিন দিন অফিসে গিয়েও দেখা মেলেনি এই কর্মকর্তার। এ সময় তার চেয়ারে বসে কম্পিউটারে কাজ করতে দেখা যায় দালাল আরিফকে। কর্মচারীদের চেয়েও অফিসে তার দাপট বেশি বলে জানান এক কর্মী।

দালালদের সরকারি আশ্রয়-প্রশয় দিয়ে অফিসের চেয়ার-টেবিলে বসিয়ে ঘুষসহ নানামুখী দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগ উঠেছে বিআরটিএ’র এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সরকারি এই কর্মকর্তা নিয়মিত অফিস করেন না। শুধু তাই নয়, অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে সেবাপ্রত্যাশীদের মামলায় জড়ানোর হুমকি দিয়ে থাকেন এই সরকারি কর্মকর্তা।

অভিযুক্ত এ কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জের বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ।

ফাইল ছাড়াতে গেলেই এ কর্মকর্তা ঘুষ দাবি করেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তাছাড়া সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসে তিনি অফিস করেন মাত্র দুই দিন। শুধু তাই নয়, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ির রেজিস্ট্রেশন না দেয়ার বিধান থাকলেও উৎকোচের বিনিময়ে লার্নার (শিক্ষানবিশ) কার্ডধারীদের নিয়মিতই রেজিস্ট্রেশন দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আর এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করলে সেবাপ্রত্যাশীদের চাঁদাবাজি মামলায় জড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন তিনি।

বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগও করেছিলেন স্থানীয় কয়েকজন মোটরসাইকেল ও সিএনজি অটোরিকশা শো-রুমের মালিক। কিন্তু কোনো প্রতিকার মেলেনি। উল্টো তাদেরকে বিপাকে পড়তে হয়েছে। ব্লক করে দেয়া হয়েছে তাদের বিআরটিএ সার্ভিস পোর্টাল (বিএসপি) নম্বর। এ অবস্থায় বিক্রি করা মোটরসাইকেল নিজেদের আইডি থেকে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করতে পারছেন না তারা।

বিএসপি ডাটা না পাওয়ার অজুহাতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনের ফাইল ফেরত দেয়া হয়েছে। অথচ যারা কর্মকর্তার চাহিদামতো উৎকোচ দিতে পেরেছেন, আগের আইএস ডাটা থেকে তাদের গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া হয়েছে।

ঘুষ-দুর্নীতি চালাতে দালাল পোষেন বিআরটিএ কর্মকর্তা!
কেউ অভিযোগ নিয়ে তার অফিসে গেলেই আগে ভিডিও শুরু করেন বিআরটিএ-এর এই কর্মকর্তা। ছবি: নিউজবাংলা

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মুকসেদপুর গ্রামের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিআরটিএ থেকে ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য লার্নার কার্ড পাই। কার্ড পাওয়ার তিন মাস পর স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলেও আমাকে তা দেয়া হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘বিআরটিএ অফিসের এক টেবিলে গেলে বলে ওই টেবিলে যান। এভাবে দুই বছর ধরে ঘুরছি। আকারে-ইঙ্গিতে আমার কাছে টাকাও দাবি করা হচ্ছে। ঘুষ দিয়ে স্মার্ট কার্ড নিতে চাই না বলে বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে আমাকে।’

‘নিউ দিয়া টিভিএস’ নামে এক মোটরসাইকেল ও সিএনজি অটোরিকশা শো-রুমের পরিচালক রাকিবুল ইসলাম লিখন বলেন, ‘গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে বিআরটিএ-এর সহকারী পরিচালকের কাছে গেলে তিনি প্রথমেই নিজের মোবাইল ফোন থেকে ভিডিও করা শুরু করেন। ভিডিও করার কারণ জানতে চাইলে তেড়ে আসেন এবং আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শো-রুমের মালিক বলেন, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে এবং নবায়ন করতে গেলে ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। ঘুষ দিলে নির্ধারিত সেমিনারে উপস্থিত না থেকেও অনেকের লাইসেন্স নবায়ন হয়ে যাচ্ছে।

‘২৬ জুন ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের জন্য ৮৪ জনকে সেমিনারে ডাকা হলেও সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন ৩৫ জনের মতো। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদেরও লাইসেন্স নবায়ন করে দেয়া হয়েছে বলে জেনেছি। ওই সেমিনারে উপস্থিত প্রত্যেকের জন্য ৩০০ টাকা সম্মানী ও দুপুরের খাবারের টাকা বরাদ্দ থাকলেও তাদের তা দেয়া হয়নি।’

অফিসে আসা ভুক্তভোগীরা জানান, সহকারী পরিচালক সপ্তাহে মাত্র দুদিন অফিস করেন। ঘুষ লেনদেনের কাজটি হয়ে থাকে অফিসের কতিপয় কর্মচারী আর দালালের মাধ্যমে। আরিফ নামে এক দালাল প্রায় প্রতিদিনই সহকারী পরিচালকের কক্ষে অবস্থান করেন। তার বাড়ি সদর উপজেলার বিন্নাটি এলাকায়।

সরেজমিনে মামুনুর রশীদের অফিসে অনুপস্থিতির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে তিন দিন অফিসে গিয়েও দেখা মেলেনি তার। এ সময় দেখা যায়, সহকারী পরিচালকের কম্পিউটারের চেয়ারে বসে কাজ করছেন দালাল আরিফ। পরে সাংবাদিকদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে সটকে পড়েন তিনি। কর্মচারীদের চেয়েও অফিসে তার দাপট বেশি বলে জানান এক কর্মী।

সবশেষ রোববার অফিসে গেলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ প্রথমেই মোবাইল ফোনে ভিডিও চালু করেন। তারপর তার অফিসে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয় না বলে দাবি করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আগের কর্মকর্তাদের চেয়ে ভালো সেবা দিচ্ছি আমি।’

ঘুষ-দুর্নীতি চালাতে দালাল পোষেন বিআরটিএ কর্মকর্তা!
কিশোরগঞ্জ বিআরটিএ অফিসের সহকারী পরিচালকের কম্পিউটার ব্যবহার করছেন দালাল আরিফ। ছবি: নিউজবাংলা

দালাল আরিফের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সে প্রতিদিন আমার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে আসে।’ নিজের কক্ষের কম্পিউটারে সামনে চেয়ারে বসিয়ে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভুল করে কম্পিউটারের চেয়ারে বসে থাকতে পারে।’

অনুপস্থিত থেকেও ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ‘বিষয়টি জানা নেই’ বলে এড়িয়ে যান তিনি।

তিন কর্মদিবস ঘুরে তার দেখা না পেলেও ‘নিয়মিত অফিস করেন’ বলেই দাবি করেন তিনি।

আরও পড়ুন:
শিক্ষাবোর্ড সচিবের নগদে ‘লোভ’
উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি: উপজেলা চেয়ারম্যান-পৌর মেয়র মুখোমুখি
বিদ্যালয়ের দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করায় ক্ষেপেছেন প্রধান শিক্ষক
নিউজবাংলায় সংবাদ প্রকাশের পর সেই প্রকৌশলীকে বদলি
ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় পেটালেন সেই প্রকৌশলী

মন্তব্য

বিশেষ
Hundred millionaire broker Nasirs Aladdins lamp
পদ্মা সেতু প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে জালিয়াতি

শত কোটিপতি দালাল না‌সিরের ‘আলাদিনের চেরাগ’

শত কোটিপতি দালাল না‌সিরের ‘আলাদিনের চেরাগ’ মাদারীপুরের শিবচরে নাসির কাজীর গ্রামের বাড়িতে উঠেছে আলিশান পাকা ভবন। ইনসেটে নাসির কাজী। ছবি: নিউজবাংলা
নাসির কাজীর আলাদিনের চেরাগ আর কিছু না, দালালি। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে অন্যের জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক দেখিয়ে টাকার কুমির হয়েছেন এই দালাল। এই জালিয়াতিতে যোগসাজশ রয়েছেন মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

ছিলেন গ্রাম্য পশু চিকিৎসক। অর্থাভাবে এক বেলা হাঁড়ি চড়ে তো আরেক বেলা উপোস। সেই মানুষটিই চার থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে শত কোটি টাকার মালিক। গ্রামের বাড়িতে উঠেছে পাকা ভবন। ঢাকার গুলশান-বনানীতে একাধিক ফ্ল্যাট, কক্সবাজারে হোটেল ভবন, দামী গাড়ি- সে এক এলাহী কাণ্ড!

মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা নাসির কাজী নামের সম্পদহীন মানুষটি কোন আলাদিনের চেরাগের সন্ধান পেয়ে এভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলেন- এমন প্রশ্ন আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিতমণ্ডলের সর্বত্র।

সরেজমিনে ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে নেপথ্য কারণটা অবশেষে জানা গেছে। নাসিরের এই আলাদিনের চেরাগ আর কিছু না, দালালি। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে অন্যের জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক দেখিয়ে টাকার কুমির হয়েছেন এই দালাল।

নাসিরের এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষ। মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে দালাল নাসির চক্র মানুষকে ঠকিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল টাকা।

পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন কাজে অনিয়মের অভিযোগে নাসির কাজীর নাম শীর্ষে রেখে ২০ দালালের তালিকা করেছে জেলা প্রশাসন। তালিকাটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর পর তা তদন্তাধীন।

ইতোমধ্যে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দুই কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত চলছে তহশিলদার ও আরও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবে চক্রের হোতা নাসির কাজীসহ দালালরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

শত কোটিপতি দালাল না‌সিরের ‘আলাদিনের চেরাগ’
পদ্মা সেতু রেললাইন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে জালিয়াতিতে জড়িত দালালদের তালিকা, যা জেলা প্রশাসন তৈরি করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হলে নাসির কাজীসহ জড়িত দালাল ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর তাহলে সরকারেরও শত শত কোটি টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবে।

যেভাবে নাসিরের দুর্নীতি

নাসির কাজীর নেতৃত্বে একটি চক্র পদ্মা সেতুর রেললাইন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে ভিপি ও খাস সম্পত্তি থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

তার এক সময়ের সহযোগীদের বক্তব্য থেকে এমন তথ্য জানা যায়। তারা জানান, অধিগ্রহণের জন্য নির্বাচিত জমির ভুয়া নথি ও নকল মালিক সাজিয়ে বিল তুলে নেয় চক্রটি। যে নারী বা পুরুষকে নকল মালিক সাজানো হয় তাকে পরে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়া হয়।

নাসিরের লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ২ লাখ টাকা ভাগ পেয়ে জেল খাটেন দত্তপাড়ার ইউপি সদস্য শুধাংশু মণ্ডল। জেলে রয়েছেন নাসিরের আরেক সহযোগী শাহীন বেপারি।

নাসির কাজীর টোপে পড়ে জমির ভুয়া মালিক সেজে স্বাক্ষর দেন আলো পত্তনদার। বিনিময়ে তাকে দুই লাখ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয় ৪৫ হাজার টাকা। তার মতো আরও অনেকেই নাসির চক্রের পাতা ফাঁদে লোভের বশে পা দিয়ে এখন প্রশাসনিক তদন্তের মুখে পড়েছেন।

মুকুলী রানী নামে এক নারীকে নাসির চক্র দুই দফায় দুটি বিলে ৪ লাখ টাকা দিয়েছে। দুর্নীতির তদন্ত শুরু হওয়ার পর ওই টাকা ফেরত দেয়ার নোটিশ আসার পর থেকে তিনি বাড়িছাড়া।

ভুয়া বিল ছাড়া অন্যের টাকাও তুলে নেন নাসির কাজীসহ দালাল চক্র এবং জেলা প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

শিবচরের মাদবরচরের ডাইয়ার চর মৌজায় পদ্মা সেতুর রেল লাইন প্রকল্পের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে হারুন বেপারি, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার বেগম ও ছেলে মেহেরাব হোসেন পার্শ্ববর্তী দোকানঘর ও জমির জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৪ ধারা, ৭ ধারা ও ৮ ধারায় নোটিশ পান। তবে ওই নোটিশ পাওয়াই সার। ডিসি অফিসে বার বার ঘুরেও বিল পাচ্ছেন না তারা।

দীর্ঘ চেষ্টার পর ক্ষতিগ্রস্তরা জানতে পারেন যে ওই দাগগুলোর বিপরীতে অধিগ্রহণ বাবদ এক কোটি ৮৮ লাখ টাকা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে তুলে নিয়ে গেছেন নাসির কাজীর নেতৃত্বে দালালরা। আসামিদের কেউ ওই এলাকার বাসিন্দা না হওয়া সত্ত্বেও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহায়তায় এই দফায় প্রায় ২ কোটি টাকা লোপাট হয়।

জালিয়াতির এই ঘটনায় শাহীন বেপারি নামে এক দালালকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি মামলায় আসামি হয় জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত শীর্ষ দালাল নাসির কাজী, তার দুই মামা ও আরেক নিকট আত্মীয়।

গ্রেপ্তার হওয়া শাহীনের পরিবার আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। শাহীনের নামে প্রায় ২ কোটি টাকার বিল ছাড় হলেও লোপাট করা টাকা থেকে মাত্র ২০ লাখ টাকা ভাগ পায় তারা। বাকি টাকা নেয় নাসিরসহ দালাল চক্রের অন্যান্য সদস্য ও ডিসি অফিসের লোকজন।

ভুক্তভোগী হারুন বেপারি বলেন, ‘আমাদের সব কাগজপত্র আছে। কিন্তু শাহিন বেপারি ও নাসির কাজীসহ চারজন ভুয়া কাগজপত্র অফিসে দাখিল করে আমাদের ক্ষতিপূরণের এক কোটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার তিনশ’ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পরে জানতে পেরেছি জাল কাগজপত্র তৈরি করে ওরা টাকা উত্তোলন করেছে। আর এর সঙ্গে ডিসি অফিসের কর্মকর্তারাও জড়িত ছিল।’

দালাল শাহীন বেপারির ছেলে দাদন বেপারি বলেন, ‘নাসির কাজী, তার দুই মামা আলিউজ্জামান ও আখতারুজ্জামান এবং ডিসি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে আমার আব্বাকে জিম্মি করে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়েছে। উত্তোলনকৃত এক কোটি ৮৮ লাখ টাকার মধ্যে ওরা আমার আব্বাকে ২০ লাখ টাকা দিয়েছিল। বাকি টাকা ওরা নিয়ে গেছে।

‘এই জালিয়াতি তদন্তকালে পুলিশ আব্বাকে ডিসি অফিসে যেতে বলে। আব্বা সেখানে গেলে তাকে কারাগারে নেয়া হয়। অথচ যারা টাকা নিয়ে গেল তাদের আজও ধরতে পারেনি পুলিশ। আব্বা বলেছেন, নাসির কাজী তাদের সামনেই কয়েক দিনে প্রায় ৮৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়াও আরও কত টাকা নিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই।’

বিপুল সম্পদ

একাধিক সূত্রে জানা যায়, শিবচরের দত্তপাড়া ইউনিয়নের বাচামারা গ্রামের মোজাজ্জেল হকের ছেলে কেএম নাসির (নাসির কাজী) এক সময়ে ছিলেন গ্রাম্য পশু চিকিৎসক। অভাব-অনটন সংসারে লেগেই থাকতো। পাশের উপজেলায় শ্বশুর বাড়িতেও বেড়াতে যেতেন না টাকার অভাবে।

সেই নাসির মাত্র চার/পাঁচ বছরে ব্যাপক বিত্তের মালিক হয়েছেন। গ্রামের বাড়িতে আলিশান ভবন, ঢাকার গুলশান ও উত্তরায় ফ্ল্যাট। কক্সবাজারে নির্মাণ করছেন বহুতলবিশিষ্ট হোটেল ভবন।

নাসিরের সাবেক স্ত্রীর স্বজন এবং দালাল সহযোগীদের কাছ থেকে এমন আরও অনেক তথ্য মিলেছে।

তারা বলেন, নাসির কাজীর বাসার দেয়াল ঘড়ির দামও দেড় লাখ টাকা। বাসার ফার্নিচার দুবাই থেকে আমদানি করা। রয়েছে একাধিক গাড়ি। নতুন সংসারে সন্তান হওয়ার পর দেন স্বর্ণের বাটি ও স্বর্ণের চামচ। তার ও স্ত্রীর মোবাইল ফোন সেটের ব্যাক কাভারও স্বর্ণের। সবমিলিয়ে এলাহী কাণ্ড কারখানা।

গ্রেপ্তারকৃত ইউপি সদস্য সুধাংশ মণ্ডল বলেন, ‘রেল লাইনের ভূমি অধিগ্রহণের সময় ডিসি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে নাসির শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে।

‘এক্ষেত্রে ডিসি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা নাসিরের বড় সহযোগী। তারাই ফাঁক-ফোকর বুঝিয়ে দিয়েছে। আমার মতো অনেকের সরলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে নাসির কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ আমরা আজ ফেঁসে গেছি। নাসিরকে ধরতে পারলে আমরাও রেহাই পাব।’

আরেক সহযোগী মুকুলী রানী বলেন, ‘নাসির আমাকে বলে- আপনাকে বাড়ি গাড়ি সব ব্যবস্থা করে দেব। প্রথমবার সে আমাকে দিয়ে ৬৩ লাখ টাকা উঠায়। তা থেকে আমাকে দেয় ৩ লাখ টাকা। পুনরায় কয়েক লাখ টাকা উঠিয়ে দেয় এক লাখ টাকা। এভাবে নাসির ও ডিসি অফিসের লোক মিলে শত শত মানুষের বিল উঠিয়ে আমাদের মতো গরিব মানুষগুলারে বিপদে ফেলেছে। ওকে ধরলে সব বের হয়ে আসবে।’

নাসির কাজীর প্রাক্তন স্ত্রীর বড় বোন বলেন, ‘শুনছি ও জিরো থেকে হিরো হয়ে গেছে। ওর এই অপকর্মে ডিসি অফিসের লোক ছাড়াও ওর মামা ও ভাইয়েরা জড়িত। জালিয়াতির কাজে ব্যবহারের জন্য নাসির আমাদের আইডি কার্ডও চেয়েছিল। আমরা দেইনি।’

নাসির কাজীর বাড়িতে গিয়ে তার মোবাইল নম্বর চাইলেও কেউ দিতে পারেনি। তার ভাই মতিউর কাজী মোবাইল ফোনে বলেন, ‘তার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নাই। আমার জানামতে সে ঢাকা বা ভারতে আছে।’

নাসিরের মামা মো আলীউজ্জামান প্রতারণার এক মামলার আসাামি। তিনি বলেন, ‘মামলাটি আমাদের সঙ্গে শত্রুতাবশত দেয়া হয়েছে।’

নাসিরে এতো সম্পদের মালিক কিভাবে হলেন বা কী ব্যবসা করেন- এমন প্রশ্নে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

প্রশাসনিক কর্মকর্তার যা বলছেন

মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ঝোটন চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় ২ জন স্টাফকে ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তা ও তহশিলদারের বিরুদ্ধেও তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আর দালালদের তালিকা দূদকে দেয়া হয়েছে।’

মাদারীপুর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক বলেন, ‘দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় সোচ্চার। ইতোমধ্যে কিছু দালালের তালিকা করা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘নাসির কাজীসহ সংশ্লিষ্টরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের অধিকার হরণ করেছে। আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত করছি। জড়িতরা যত ক্ষমতাশালীই হোক ছাড় দেয়া হবে না। আইন প্রয়োগকারী সব সংস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের মূল উৎপাটন করা হবে। আইনের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও তাদেরকে বয়কট করা হবে।’

মন্তব্য

বিশেষ
Question leak Information of 11 students of Khulna Medical in CID

প্রশ্নফাঁস: সিআইডিতে খুলনা মেডিক্যালের ১১ শিক্ষার্থীর তথ্য

প্রশ্নফাঁস: সিআইডিতে খুলনা মেডিক্যালের ১১ শিক্ষার্থীর তথ্য খুলনা মেডিক্যাল কলেজ। ছবি: নিউজবাংলা
ঘটনার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে থ্রি ডক্টরস কোচিংয়ের সম্পৃক্ততা।

খুলনা মেডিক্যাল কলেজে (খুমেক) লেখাপড়া করেছে এমন ১১ জন শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক তথ্য নিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তথ্য নেয়ার পর ওই ১১ জনের মধ্য থেকে ইতোমধ্যে ৩ জনকে আটকও করেছে সিআইডি।

খুলনা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয় জানায়, প্রায় দেড় মাস আগে সিআইডি থেকে অধ্যক্ষকে চিঠি দেয়া হয়। তাতে ২০১৫ সালে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খুমেকে ভর্তি হয়েছে, এমন ১১ শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক তথ্য চাওয়া হয়। গত ১৬ জুলাই অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে ওই ১১ শিক্ষার্থীর তথ্য সিআইডিকে দেয়া হয়।

১১ জনের মধ্যে শুক্রবার দুপুরে ৩ জনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন- শার্মিষ্ঠা মণ্ডল, নাজিয়া মেহজাবিন তিশা ও মুস্তাহিন হাসান লামিয়া। এরা তিনজনই এমবিবিএস উত্তীর্ণ হয়েছেন। নাজিয়া মেহজাবিন তিশা ইতোমধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উচ্চতর ডিগ্রি এফসিপিএস-এর প্রথম ধাপ উত্তীর্ণ হয়েছেন।

এছাড়া বাকি ৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩ জন এখনো এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ৩ জনের মধ্যে ২ জন শেষ বর্ষের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে, তবে ফলাফল এখনও প্রকাশ হয়নি। বাকি একজন এখনও শেষ বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিতে পরেননি।

শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কোনো শিক্ষাকই তাদের লেখাপড়ার দক্ষতা সম্পর্কে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে চাননি। তবে নাম না প্রকাশ করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক জানান, ২০১৫ সালে যেসব শিক্ষার্থীরা খুমেকে ভর্তি হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকের মেডিক্যালে পড়ার নূন্যতম যোগ্যতাও ছিল না। ওই ব্যাচে খুলনা মেডিক্যালে এমন ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন, যারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পাশ করেছেন।

খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. দীন-উল-ইসলাম বলেন, ‘সিআইডির চাহিদার প্রেক্ষিতে আমরা তাদের তথ্য প্রদান করেছি। ওইসব শিক্ষার্থীরা যদি ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে এখানে ভর্তি হন, তাহলে রাষ্ট্রীয় আইন মোতাবেক তাদের শাস্তি হোক।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই শিক্ষার্থীরা খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং থেকে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিল। ওই কোচিং সেন্টারটির উপদেষ্টা ডা. ইউনুস খান তারিমকেও শুক্রবার দুপুরে খুলনা থেকে আটক করেছে সিআইডি।

ডা. তারিমও খুলনা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় খুমেক শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে খুমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) খুলনা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) খুলনা জেলা শাখার সদস্য।

খুলনার সিমেট্রি রোডে একটি বহুতল ভবনে তার থ্রি ডক্টর’স কোচিং সেন্টারটি অবস্থিত। কেবল খুলনা ও আশপাশের জেলা নয়, দূরের বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীও এখানে এসে মেডিক্যাল ভর্তি প্রস্তুতির কোচিং করেন।

এই কোচিং সেন্টার ঘিরে তিনি খুলনার রয়েল মোড়ে ফাতিমা হাসপাতালের ভবনে একটি ছাত্রাবাসও গড়ে তুলেছেন। চলতি বছরে তিনি নিজেকে ৫ হাজার চিকিৎসক তৈরির কারিগর হিসেবে পোস্টার লাগিয়ে ওই কোচিংয়ের প্রচার চালান।

গত কয়েক বছরের বিভিন্ন প্রচারণামূলক পোস্টার থেকে দেখা যায়, ২০১২ সালে কোচিংটিতে ভর্তি হন প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী। ওই বছর জাতীয় মেধা তালিকায় হাদিউর নামে এক শিক্ষার্থী চতুর্থ স্থান অধিকারসহ ঢাকা মেডিক্যালে ১৭ জন এবং দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ১৮৭ জন শিক্ষার্থী চান্স পান। তখন থেকে মেডিক্যাল ভর্তি প্রস্তুতির কোচিং জগতে ডা. তারিমের নাম ছড়িয়ে পড়ে।

পরের বছর প্রায় ৮০০ জন শিক্ষার্থী সেখানে ভর্তি হন। ওই বছর খুলনা সিটি কলেজের প্রদীপ্ত নামের এক শিক্ষার্থী জাতীয় মেধায় তৃতীয়সহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ১৯ জন ও সারা দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ২৩৫ জন চান্স পান।

২০১৪ সালে থেকে তার কোচিংয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। সে বছর খুলনা পাবলিক কলেজের এস এম তানভীর রহমান নামক এক ছাত্র জাতীয় মেধায় দ্বিতীয় স্থানসহ বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী চান্স পান।

২০১৫ সালে তার কোচিং সেন্টার থেকে জাতীয় মেধায় ষষ্ঠ, অষ্টম, দশম ও একাদশ-সহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ১৭ জন ও দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ১৯৪ জন শিক্ষার্থী চান্স পান। ২০১৬ সালে জাতীয় মেধায় খুলনা নেভি কলেজের ছাত্রী ফাহরিয়া তাবাচ্ছুম অর্পি পঞ্চম স্থানসহ ২৪৭ জন শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে চান্স পান। ২০১৭ সালে জাতীয় মেধায় রাব্বি নামক এক ছাত্র তৃতীয় স্থানসহ সারা দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ২৬৪ জন চান্স পান।

২০১৮ সালে ওই কোচিং থেকে মোট ২৭৩ জন শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৮ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এবং ৮৬ জন ঢাকার অন্য চারটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ২০১৯ সালে জাতীয় মেধায় জাতীয় মেধা তালিকায় দ্বিতীয়, ১৯তম, ২০তম ও ৩২তম-সহ সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে মোট ২৮০ শিক্ষার্থী চান্স পান।

২০১৯ সালে মেডিকলে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে দেশজুড়ে কড়াকড়ি আরোপ করে প্রশাসন। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ওই বছরের ১০ অক্টোবর খুলনা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমরান হোসেন খান খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারে অভিযান পরিচালনা করে তাকে আটক করেন। এরপর তাকে র‌্যাবও হেফাজতে নিয়ে একদিন পর ছেড়ে দেয়। তার পরের বছর থেকে এ পর্যন্ত প্রতি বছর হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পেলেও ওই কোচিং সেন্টার তেমন কোনো সফলতার মুখ দেখেনি।

ডা. ইউনুস খান তারিম সিআইডির হাতে আটক হওয়ার একদিন আগে গত বৃহস্পতিবার তার কাছ থেকে কোচিং সেন্টারের নানা অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য নেন এ প্রতিবেদক।

২০১৯ সালের পর থেকে তার কোচিংয়ের তেমন কোনো সফলতা না আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওই বছর প্রশাসন আমাকে আটক করে। তারপর থেকে অন্যান্য কোচিং সেন্টারগুলো আমার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাই আমি মেধাবী শিক্ষার্থী কম পেয়েছিলাম। যে কারণে গত কয়েক বছর জাতীয় মেধা তালিকায় কেউ তেমন ভালো অবস্থান করতে পারছে না।’

আরও পড়ুন:
খুলনার ‘থ্রি ডক্টরস’ কোচিংয়ের উপদেষ্টা আটক

মন্তব্য

বিশেষ
Old militants try to organize themselves with new tactics

নতুন কৌশলে পুরোনো জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা

নতুন কৌশলে পুরোনো জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা জঙ্গি সংগঠনের বেশ কয়েকজনের সদস্যকে। ফাইল ছবি
সিটিটিসির উপ-কমিশনার এস এম নাজমুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রিমান্ডে থাকা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কথিত ইমাম মাহদীর কাফেলার সঙ্গে অন্যান্য পুরোনো জঙ্গিগোষ্ঠী ও নেতাদের সম্পৃক্ততা আছে কি না অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

নতুন নতুন কৌশলে পুরোনো জঙ্গিরা তৎপরতা বাড়িয়েছে। বিদেশে পলাতক ও আত্মগোপনে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের নেতারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে কথিত ইমাম মাহদীর কাফেলা কিংবা জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র নামে নতুন নতুন সংগঠনের তথ্য বের হয়ে আসছে।

এসব সংগঠনের তৎপরতার নেপথ্যে পুরোনো জঙ্গিগোষ্ঠী জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হিযবুত তাহরীরের সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা তদন্ত শুরু করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।

ইতোমধ্যে নতুন ও পুরোনো বেশিরভাগ জঙ্গিগোষ্ঠীর অর্থদাতা শনাক্ত হয়েছে, যারা মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশসহ যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া থেকে অবৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠিয়ে থাকে দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ানোর জন্য।

সম্প্রতি সিটিটিসির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কথিত ইমাম মাহদীর কাফেলার ২৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদকালীন ও অন্যান্য পুরোনো জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-প্রমাণের প্রাথমকি যাচাইয়ের পর এমন মত দিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা।

সিটিটিসি জানায়, আগে একটি পরিবার থেকে একজন সদস্য নিখোঁজ হওয়ার পরপরই অভিভাবকরা খোঁজাখুঁজি করতেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে তার অবস্থান ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারতেন। কিন্তু ইদানিং জঙ্গিদের সপরিবারে হিজরতের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রকৃত তথ্য নেই।কৌশল বদলে সপরিবারে হিজরতের নামে আত্মগোপন করার কারণে তাদের বিষয়ে খোঁজ পাওয়া যায় না। নতুন জঙ্গি সংগঠনটি আবিষ্কারের পর থেকেই নতুন নতুন নিখোঁজ পরিবারের তথ্য তথ্য পাচ্ছে সিটিটিসি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সিটিটিসির উপ-কমিশনার এস এম নাজমুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রিমান্ডে থাকা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কথিত ইমাম মাহদীর কাফেলার সঙ্গে অন্যান্য পুরোনো জঙ্গিগোষ্ঠী ও নেতাদের সম্পৃক্ততা আছে কি না অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

‘আরও কোনো পরিবার নিখোঁজ আছে কিনা তথ্য বের করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি জঙ্গি তৎপরতায় আর্থিক সহায়তাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

সিটিটিসি জানায়, বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার নির্জন পাহাড়ি এলাকায় স্থায়ী জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিল কথিত নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র শীর্ষ নেতারা। সেই উদ্দেশে তারা দুবাইপ্রবাসী একজনের কাছ থেকে সাত লাখ টাকায় ৫০ একর জমি কিনেছিল। আস্তানাটিতে অস্ত্র ও গোলা বারুদ মজুত করা হচ্ছিল। সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে ৫ শতাধিক টুথপেস্ট, আড়াই শতাধিক ব্রাশ, বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও শুকনা খবার সামগ্রী।

সিটিটিসির ভাষ্য, কথিত ইমাম মাহমুদের আহ্বানে সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণ ও প্রশিক্ষণ শেষে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাতেই তারা সেখানে সংগঠিত হয়। এই প্রস্তুতির জন্য কথিত হিজরতের মাধ্যমে নিজ নিজ গৃহ ত্যাগ করে সপরিবারে পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে তারা।

সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, নতুন ব্যানারে থাকা এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে পুরোনো জঙ্গি সংগঠনগুলোর একাধিক নেতার সর্ম্পকের তথ্য পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদভাবে কাজ করছেন।

জামিনে থাকা জুয়েলই দলনেতা

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে নাটোরের ৩০ বছর বয়সী জুয়েল মাহমুদই নিজেকে কথিত ইমাম মাহমুদ কাফেলার দলনেতা বলে দাবি করেছে। সাত মাস আগে গ্রেপ্তার হয়েছিল সে। সে জেলে থেকে পাহাড়ে এই জঙ্গি ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করে। এরপর জামিনে থেকে সে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেশ বিদেশের বিভিন্ন উগ্রপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ায়।

এরই মধ্যে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় চিকিৎসক সোহেল তানজীমের। সোহেলও এর আগে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। পরে জামিন পেয়ে তারা এক সঙ্গে হয়ে অন্যদের সংগঠনের ভেড়াতে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে। এরপর তারা চীনের ইয়াংজু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা রাহাত মন্ডল ও মেহেদী হাসানকে তাদের সঙ্গে নেয়। তাদের ডাকে সারা দিয়ে মেহেদী চীন থেকে এক মাস আগে দেশে ফেরে। আর রাহাত ফেরে গত ১০ দিন আগে।

এরপর বিমানবন্দর থেকে বাড়ি না গিয়ে সোজা জঙ্গি আস্তানায় চলে যায় তারা। এই পরিকল্পনায় তারা যশোর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া আরেক মেধাবী শিক্ষার্থীকেও সঙ্গে নেয়।

যেভাবে নতুন জঙ্গি সংগঠনের তথ্য মেলে

সিটিটিসি বলছে, সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের চিকিৎসক সোহেল তানজীম রানা, যশোর থেকে ঢাকার নটরডেম কলেজ শিক্ষার্থী ফাহিম, জামালপুর থেকে এরশাদুজ্জামান শাহিনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী লোকদের পরিবার ও একাকী নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পেয়ে বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু করে সিটিটিসি।

এক পর্যায়ে গত ৭ আগস্ট ঢাকার গাবতলী এলাকা থেকে ঝিনাইদহ ও মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কথিত ইমাম মাহমুদের আহ্বানে সপরিবারে হিজরত করতে আসা ছয়জন নারী ও চারজন পুরুষসহ ১০ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা আট শিশুকে হেফাজতে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে মেহেরপুর জেলা থেকে হিজরতকারী পাঁচটি পরিবার ও ঝিনাইদহ জেলা থেকে হিজরতকারী একটি পরিবার ছিল।

পুলিশের এক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, ‘এক বছর আগে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংগঠনটিকে সম্প্রতি নিষিদ্ধও করেছে সরকার। এরই মধ্যে আরেকটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান মিলেছে। যার নাম ইমাম মাহমুদের কাফেলা। নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জিহাদের প্রস্তুতির প্রথম ধাপ হিসেবে ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আস্তানা গড়ে তোলার প্রস্ততি নেয়।’

অপরাধ বিশ্লেষকদের ভাষ্য, কথিত এই ইমাম মাহমুদের কাফেলার সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিয়ে পরিপূর্ণ জঙ্গি সদস্য হয়ে দেশে নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল। এদের নেপথ্যে দেশি-বিদেশি যেসব কুশীলব রয়েছে, বিশেষ করে অর্থের যোগানদাতাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। না হলে অতীতের মত জঙ্গিবাদ ফের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠবে।

পুরোনো জঙ্গিদের নিয়ে কাজ করা সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইমাম মাহদী দাবিকারী একাধিক ব্যক্তি দেশের বাইরে থেকে জঙ্গিভাবধারা মতাদর্শ ব্যবহার করে দেশের তরুণদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। ভার্চুয়ালি এদের তৎপরতা বেশি। এদের সঙ্গ আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর নেটওয়ার্ক রয়েছে।

তারা আরও জানান, পুরোনো ও নতুন করে গজিয়ে ওঠা সব নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীরই সাধারণ চরিত্র হচ্ছে- রক্তপাতের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করে ‘ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা’র প্রচারণা। যেটি তারা করে থাকে ধর্মশাস্ত্রের কোনো কোনো অংশের বিকৃত উপস্থাপনের মাধ্যমে। স্বশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জিহাদি মনোভাব উসকে দেয়ার কাজ করে থাকেন এই সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। এই মতাদর্শ প্রচারকারী প্রকৃতপক্ষে কারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন সেবিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, ‘জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের মতাদর্শগত তৎপরতা থেমে নেই। এ কারণেই তারা নতুন নামে ও কৌশল পরিবর্তন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গি বিষয়ক সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তারা চিহ্নিত হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘এইসব জঙ্গির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক আছে। আমার মনে হয়, নির্বাচনের আগে তারা সক্রিয় হয়েছে। নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সামনে নির্বাচন আছে। যদি নির্বাচনের আগে সহিংসতা করা যায়, তাহলে নির্বাচনের গুণ ও মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।’

আবদুর রশিদ আরও বলেন, ‘যারা সহিংসতার দর্শনে বিশ্বাসী, প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে তারা জঙ্গিদের উসকে দেয়। নতুন জঙ্গি সংগঠনের সহিংসতার দর্শন একই। তবে তারা নাম, চেহারা বা কৌশল বদলেছে। নির্জন পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা গড়েছে। কারণ পুরনো পদ্ধতিতে এগোলো শুরুতেই তারা ধরা পড়ে যাবে।’

‘ইমাম মাহদী’ দাবীকারী কারা?

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘ইমাম মাহদী কখনোই নিজে থেকে দাবি করবেন না। তার তাক্বওয়া; খোদাভীতি, আখলাক, চরিত্র, সব কিছু দেখেই স্থানীয় জনতা ইমাম মাহদী হিসাবে নির্বাচিত করবেন। ইমাম মাহদী হবেন শেষ নবীর বংশ থেকে। কাজেই বর্তমানে যারা বাংলাদেশ কিংবা অন্য কোনো দেশ থেকে ইমাম মাহদী দাবি করছেন, তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ধর্মের ক্ষতি করছেন।’

আরও পড়ুন:
৬৩ জেলায় বোমা হামলা: দেড় যুগেও শেষ হয়নি বিচার
চীন থেকে ফিরে বাড়ি না গিয়ে জঙ্গি আস্তানায় দুই প্রকৌশলী
কালাপাহাড়ে নতুন জঙ্গি আস্তানায় অভিযান, আটক ১৭

মন্তব্য

p
উপরে