সভ্যতার ইতিহাসে বেশ কয়েকটি মহামারি হয়েছে, কিন্তু করোনা মহামারির যে প্রভাব, তা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, ১৯৩০ সালের পর এমন কঠিন সময় আর কখনও দেখেনি বিশ্ববাসী।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি পাল্টে যায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশও।
একদিকে জীবন রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা, অন্যদিকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লড়াই– এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ।
যদি বলা হয় ২০২০ সালে করোনাকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ও আলোচিত ঘটনা কী, সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন ‘প্রণোদনা প্যাকেজ’।
আরও পড়ুন: দ্বিতীয় প্রণোদনার পরিকল্পনা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
করোনার প্রভাবে দেশের অর্থনীতি যে ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা কাটাতেই বিশাল এ প্যাকেজ বাস্তবায়নের উদ্যাগ নেয়া হয়।
বিভিন্ন ধাপে এ পর্যন্ত মোট ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
এই প্যাকেজের বড় একটি অংশ আর্থিক খাতের প্রণোদনা। এতে জড়িত আটটি খাতে বাস্তবায়নাধীন অর্থের পরিমাণ প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
করোনার কারণে কয়েক মাস থমকে গেলেও আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ছবি: নিউজবাংলা
অবশিষ্ট অর্থ দুস্থদের জন্য এককালীন নগদ সহায়তা, ত্রাণ বিতরণ, খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি ও কভিড-১৯ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটা ও চিকিৎসা সেবায় ব্যয়ের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ এসব প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। তবে আর্থিক খাতের সব প্যাকেজই বাস্তবায়ন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থনীতিবদেরা বলেছেন, এ প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের টিকা বা ভ্যাকসিন হিসেবে কাজ করেছে, যে কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তবে প্যাকেজটি বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা আছে বলেও মনে করেন তারা।
তাদের মতে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় এগোচ্ছিল। কিন্তু করোনায় এ অর্জনে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। সময়মতো প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করায় সামলে উঠছে পরিস্থিতি এবং সঠিক পথেই এগুচ্ছে বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন: দক্ষিণ এশিয়ায় মাথাপিছু জিডিপির শীর্ষে বাংলাদেশ
করোনার ভেতরে গত ১১ জুন যে বাজেট ঘোষণা করে সরকার, তাতেও অর্থনীতি গতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয় ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, করোনাকালীন এবারের বাজেটের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘অথনৈতিক উত্তরণ এবং ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’।
সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়- সেদিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বাজেটে।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ,আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীরা করোনার মধ্যে বাংলাদেশর অর্থনীতির অগ্রগতির প্রশংসা করেন।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় নতুন করে বাড়তি প্রণোদনা দেয়ার দাবি উঠেছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর পক্ষ থেকে।
সম্প্রতি রাজধানীতে বিজিএমইএ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে বলেন, বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনা করছে সরকার।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। পুরোপুরি সুফল পেতে হলে আরও সময় অপেক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুন: প্রণোদনা প্যাকেজ: কোন খাতে কত ছাড়
বিভিন্ন দেশের সরকারও নিজস্ব অর্থনীতি বাঁচাতে প্রণোদনা দিয়েছে।
২০ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ভারতের মোদি সরকার। এটি সে দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ। প্যাকেজের অঙ্কের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে এটি হচ্ছে তৃতীয়, যদিও ভারতের অর্থনীতি এখনো ঝুঁকির মধ্যে।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সবচেয় বড় প্যাকেজ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র; এর পরিমাণ ৯০ হাজার ৮০০ কোটি (৯০৮ বিলিয়ন) ডলার। যুক্তরাজ্য সরকার প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে।
করোনা-পরবর্তী গত জুন পর্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে ছিল দেশের রপ্তানি খাত। এরপর থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিশেষ করে রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ অবদান রাখা এই খাত। সবশেষ চলতি অর্থবছরে নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি বা আয় বেড়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে চার শতাংশ।
করোনা-পরবর্তী অর্থনীতির দুটি সূচকে অভাবনীয় সাফল্য লক্ষ্যণীয়। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে ( ৪২ বিলিয়ন) পৌঁছেছে।
আরও পড়ুন: রিজার্ভ ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়াল
প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে, নভেম্বরও রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছে।
সরকারের প্রধান আয়ের উৎস রাজস্ব আহরণ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় থাকলেও অক্টোবর এবং নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হয়েছে।
করোনার টিকা ক্রয়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফের প্রতিশ্রুত সহায়তা আসতে শুরু করায় বিদেশি সাহায্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে জানান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তরা। ফলে সামগ্রিকভাবে করোনার ধাক্কা সামলে এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নিবার্হী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের ইতিবাচক প্রভাব অবশ্যই আছে। এর ফলে প্রাণ ফিরেছে অর্থনীতির। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সামাজিক সুরক্ষায় আরও বেশি নজর দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের ফলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্যাকেজের পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে আরো গতি বাড়বে অর্থনীতির।
ঋণনির্ভর এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কিছু সমস্যার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদেরা। অবশ্য ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট মহলের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্যাকেজের আকার স্ফীত এবং ঋণ বিতরণের শর্ত শিথিল করেছে সরকার।
তারপরেও ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত কৃষিঋণ, নিম্ন আয় ও প্রান্তিক চাষি, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট স্কিমসহ অন্যান্য খাতে ঋণ বিতরণের চিত্র সন্তোষজনক নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪৯ শতাংশ ছাড় হয়েছে।
অথচ, বড় ব্যবসায়ীদের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের পুরোটাই এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
কৃষিখাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় নভেম্বর পর্যন্ত মোট ঋণের ৫১ শতাংশ বিতরণ হয়েছে। এর পরিমাণ দুই হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ।
আরও পড়ুন:শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে গত ০২ জুন, সোমবার আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতি।
জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুহঃ ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মজিবর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম মরতুজা, মোঃ ফয়েজ আলম ও মোঃ আশরাফুল আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সংগঠনের সভাপতি সাইফুল আবেদিন তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভা সঞ্চালনায় ছিলেন কার্যকরী সভাপতি শাহ জাহান ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইকবাল হোসেন। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি এস. এফ. এম. মুনির হোসেন, সহসভাপতি মজিবুর রাহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ছানোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। আবার ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। ট্রেড লাইসেন্স নিতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের বাধ্যবাধকতায় এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত দিন ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল।
এখন ১১ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র দাখিল করলেই হবে। ওই ১১টি সেবা হলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় নতুন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণে; সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রাপ্তিতে; সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারের নতুন লাইসেন্স গ্রহণে; ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ ও নবায়নে; চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি, আইনজীবী ও কর আইনজীবী, অ্যাকচুয়ারি, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণে; পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খোলায়; এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মচারীর কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং বা ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে এবং মোবাইল ফোনের হিসাব রিচার্জের মাধ্যমে কমিশন, ফি বা অন্য কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তিতে; ত্রি-চক্র মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আজ সোমবার (২ জুন) বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ইতিহাসে ৫৪তম বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ২০১৫ সালের পর এখন পর্যন্ত বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।
ঘরে বসে যেসব ক্রেতারা কেনাকাটা করতে চান, তাদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা আগামী অর্থবছর থেকে খানিকটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ই-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় থেকে কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্যের দাম বেশি হতে পারে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ভ্যাটের হার ছিল ৫ শতাংশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে ভিন্ন আঙ্গিকে পেশ হলো বাজেট। এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর ৩০ জুন তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পুরো জুন মাসজুড়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলেন। তার এ বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।’
মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক অস্থিরতা সামাল দিতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এর মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মুদ্রানীতি সমন্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। বহু দেশ সংকটে পড়ে এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে- কেউ সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে, কেউ আবার দীর্ঘমেয়াদি ঋণনির্ভরতার ফাঁদে পড়ে গেছে।
আজ, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্রমশ পশ্চিমকেন্দ্রীকতা থেকে সরে পূর্ব ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আইএমএফ তার প্রাসঙ্গিকতা ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে এক নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন।
ঋণ সহায়তা, নাকি ঋণের ফাঁদ?
আইএমএফ সাধারণত এমন শর্তে ঋণ দেয়, যার মধ্যে থাকে কঠোর ব্যয়সংযম, ভর্তুকি হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারমুখী সংস্কার; কিন্তু এই শর্তগুলো অনেক সময় জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। স্থানীয় শিল্প ধসে পড়ে, বৈষম্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা এর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০১৮ সালে আইএমএফ ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ প্যাকেজ ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমোদন করে। ফল ছিল বিপরীত- মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, দারিদ্র্য আরও বেড়ে যায় এবং দেশটি আবার মন্দার মুখে পড়ে।
এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে শুধু অর্থনৈতিক সমীকরণ দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণ চলে না।
আইএমএফের নীতিনির্ধারণ কাঠামো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শক্তির ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। উন্নত দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সংগঠনের ভোটের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এই গণতান্ত্রিক ঘাটতি আজ দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে।
বিকল্প প্রতিষ্ঠানের উত্থান
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) এবং ল্যাটিন আমেরিকান রিজার্ভ ফান্ড (FLAR) নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। (NDB) এর সহায়তা তুলনামূলকভাবে শর্তমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক। এখানে প্রতিটি দেশের ভোটের ও প্রতিনিধিত্বের সমান সুযোগ আছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও আগ্রহী করে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু আর্থিক বিকল্প নয়- এরা এক নতুন উন্নয়ন দর্শনের বাহক। সেই দর্শনে উন্নয়ন নির্ধারিত হয় স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে, বাইরের চাপ বা রূঢ় শর্ত নয়।
বিশ্ব আজ বহুমেরু। অর্থনৈতিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে নানা অঞ্চলে। এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে আইএমএফকে নিজস্ব কাঠামো ও দর্শনে রূপান্তর আনতে হবে। প্রয়োজন গভর্ন্যান্সের সংস্কার, নীতিনির্ধারণে সমান অংশগ্রহণ, এবং সর্বোপরি সহানুভূতিশীল ঋণ নীতিমালা।
আইএমএফ যদি সত্যিই বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার অভিভাবক হতে চায়, তাহলে তাকে হতে হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক, এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাসম্মত এটি শুধু আইএমএফের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্ন।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ জব্দ কর তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরমর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময়ে এবারের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর এফডিসিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচারকৃত অর্থ জব্দের মাধ্যমে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস।’
‘গত সরকারের রেখে যাওয়া বিদেশি ঋণের চাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এই সরকারের এই সময়ে অন্যতম সাফল্য ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করে বিদেশি ঋণের চাপ কমিয়ে আনা,’ যোগ করেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঋণ বিলিয়ন ডলার করে বছর বছর বাড়ছিল। সামগ্রিকভাবে এই সরকারের সাফল্যের জায়গাটা হলো বহির্খাত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, দায়-দেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ বাড়ানো ও টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা।’
তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কোনো কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে কোনো চমক থাকছে না।’
‘যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে, তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো, সেগুলো অব্যাহত আছে,’ বলেন তিনি।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও ব্যক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।’
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বিতর্ক সংগঠন এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হন।
মন্তব্য