করোনার কারণে গত বছর পোলট্রি ব্যবসায়ীরা যে লোকসান গুনেছেন, এখন তারা তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন দাম বাড়িয়ে। শীতে মুরগির উৎপাদন কমে গিয়ে বাজারে সরবরাহ কিছুটা কমেছে।
করোনায় ক্ষতিতে পড়া ছোট খামারিরা বাজার থেকে ছিটকে পড়ার কারণেও বাজারে সরবরাহ কমে গেছে।
এর বিপরীতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে করোনার সংক্রমণ কমে যাওয়ায় সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বেড়েছে পোলট্রি ফিডের দাম।
এ পাঁচ কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে সব ধরনের মুরগির দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে।
সাধারণত বাজারে সব ধরনের মুরগির দাম একসঙ্গে বাড়ে না। ব্রয়লার মুরগির দাম কিছু ওঠানামা করলেও সোনালি ও লেয়ার মুরগির দামে অস্থিরতা থাকে না। দেশি মুরগির বাজারও অনেকটা স্থির থাকে। তবে এবার সব ধরনের মুরিগর দাম একই সঙ্গে বেড়েছে।
দাম বাড়া শুরু হয় শীতের শুরু থেকে। তবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে দামের ঊর্ধ্বমুখী গতি বেড়েছে।
দাম কতটা বেড়েছে
সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায়। এর দ্বিগুণ দামে প্রতি কেজি ৩৩০ থেকে ৩৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে সোনালি মুরগি। আর ডিম পাড়া লাল ও সাদা লেয়ার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়। দেশি মুরগির প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকায়।
দেড় মাস আগে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছিল ২৪৫ থেকে ২৫০ টাকায়। দেশি মুরগি ৪০০ থেকে ৪২০ টাকায় এবং লেয়ার মুরগি ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
এ হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৩৪ শতাংশ দাম বেড়েছে সোনালি মুরগিতে। এর পরেই দেশি মুরগিতে বেড়েছে ২০ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সোনালি মুরগির দামও ৪৫ শতাংশ দাম বেড়েছে।
রাজধানীর বিজয় সরণির কলমিলতা বাজারের ক্রেতা রায়হান পারভেজ জানালেন, মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি আগের চেয়ে কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এক কেজির কাছাকাছি প্রতি হালি (সোনালি) মুরগির দাম পড়ত ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। বাজারে ঝামেলা এড়াতে একসঙ্গে এক হালি করেই কেনা হতো। কিন্তু এখন একই আকারের প্রতি হালি মুরগির দাম কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ টাকা। তাই হালির পরিবর্তে একটি বা দুটি কিনতে হচ্ছে।’
মুরগির দাম গরুর মাংসের চেয়েও বেড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক কেজি মুরগি জবাইয়ের পর ৩৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম বাদ যায়। তাই এক কেজি মাংস পেতে দেড় কেজির বেশি মুরগি কিনতে হয়, যার দাম প্রায় ৫৫০ টাকা। অথচ এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৫৮০ টাকা।’
শীতে উৎপাদন কমে
প্রতিবছর শীতের পর সাধারণত মুরগির দাম কিছুটা বাড়ে। শীতে ফ্লুর কারণে মুরগির উৎপাদন কম হয়। পাশাপাশি অনেক মুরগির বাচ্চা মারা যায়। এ সময় মুরগির বাচ্চার বৃদ্ধি কম হয়। তাই খামারিরা খামারে কম বাচ্চা তোলেন।
খামারে মুরগি বাচ্চা থেকে বাজারজাত করতে ব্রয়লার মুরগিতে ৩৫ দিন থেকে দেড় মাস, সোনালিতে দুই থেকে আড়াই মাস সময় লাগে। তাই শীতের পর উৎপাদন কমে যাওয়ায় কারণে বাজারে মুরগির দাম বেড়েছে।
করোনার ধাক্কা
করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর এপ্রিলে মুরগি বিক্রি করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ফলে একদিকে বেশি সময় মুরগি পালন করার কারণে ব্যয় বেশি হয়েছে। আবার চাহিদা কম থাকায় খামারের মালিকরা কখনও অর্ধেক দামে মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হন। বাজার না থাকায় খামারিরা বাচ্চা না তুলে খামার বন্ধ রাখেন। এতে হ্যাচারির মালিকেরাও পড়েন বিপাকে। অনেক হ্যাচারি এক দিনের বাচ্চা বিক্রি করতে না পারায় সেগুলো মারা যায়। ফলে খামারি ও হ্যাচারির মালিকেরা অনেকে মূলধন হারিয়েছেন।
গত জুনে সাধারণ ছুটি অবসানের পরও খামারির বাচ্চা ও মুরগি উৎপাদন আগের পর্যায়ে যায়নি।
পোলট্রি খাতের সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে মুরগির বাজারে ব্রয়লারের অংশ ৬০ শতাংশ। সোনালি ৩০ শতাংশ এবং লেয়ার, দেশিসহ অন্য জাতের মুরগি বিক্রি হয় ১০ শতাংশ। প্রতি সপ্তাহে দেশে মুরগির বাচ্চার চাহিদা ২ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে দেড় কোটি ব্রয়লার, ৮০ লাখ ফাওমি সোনালি ও ৫ লাখ হাইব্রিড সোনালি।
লোকসান পুষিয়ে নিচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা
করোনাকাল ও সাধারণ ছুটি চলাকালে মুরগির দাম উৎপাদন মূল্যের চেয়ে কম ছিল। তখন বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লারের দাম ৮০ টাকাতেও নেমে এসেছিল।
খামারিদের দাবি, এক কেজি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন খরচ ১১০ টাকার কাছাকাছি। ফলে তখন কেজিতে লোকসান গুণতে হয়েছে প্রায় ৩০ টাকার মতো।
এখন বাড়তি দাম নিয়ে তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছেন। বর্তমানে খামারে ব্রয়লার মুরগি ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকার মতো লাভ করছেন খামারিরা। আগে মুনাফা ছিল কেজিতে গড়ে ৫ টাকার মতো।
করোনার কারণে যেসব খামার লোকসানে পড়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তি পর্যায়ের ছোট খামারিরা। তারা অনেকটাই পথে বসার অবস্থায়। এ ধরনের ৩০ শতাংশ ছোট খামার এখনও চালু হয়নি বলে জানায় খামারিদের বিভিন্ন সংগঠন।
করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে এই ভয়ে অনেকে খামারে মুরগির বাচ্চা তুলছেন না। অথচ মুরগরি প্রায় ৬০ শতাংশ যোগান আসে গ্রামীণ প্রান্তিক পর্যায়ের খামারি থেকে। ছোট খামারিরা উৎপাদনে না থাকায় বাজার বড় খামারিদের দখলে রয়েছে। তারা প্রতিদিনের দাম ঠিক করছে।
মধ্যস্বত্বভোগীরাও মুনাফা বাড়াচ্ছেন
উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বড় ভূমিকা থাকে মধ্যম পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের। তারাই খামার থেকে সংগ্রহ করে তা বাজারে সরবরাহ করেন। কিন্তু এখন মধ্যস্বত্বভোগীরা আগের চেয়ে বেশি লাভ করছেন।
দাম বাড়ার আগে খামার পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতো ১০০ থেকে ১০৫ টাকায়। সে মুরগি দুই হাত ঘুরে খুচরা বাজারে বিক্রি হতো ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় খামার থেকে কেনা ব্রয়লার মুরগি খুচরা বাাজরে বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায়।
আবার আগে খামার পর্যায়ে ১৭০ টাকায় বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগি খুচরা বাজারে বিক্রি হতো ২১০ থেকে ২২০ টাকায়। কিন্তু সোমবার খামার পর্যায়ে ২৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগি খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৩৪০ টাকায়। বিক্রি কম হলেও মধ্যস্তরের ব্যবসায়ীরা লাভ করছেন বেশি।
সামাজিক অনুষ্ঠানে চাহিদা বেড়েছে
জানুয়ারিতে করোনা সংক্রমণ স্বল্প সময়ের জন্য কমে আসায় তখন নানা অনুষ্ঠান আয়োজন বেড়ে যায়। এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে নানা পদের রান্নায় সোনালি মুরগিই বেশি ব্যবহার হয়।
পর্যটন এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে সোনালি ও দেশি মুরগির ব্যবহার বেশি হয়। আবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির রুচির পরিবর্তন। এ শ্রেণির মানুষজন আগে ব্রয়লার মুরগিতে অভ্যস্ত হলেও গত কয়েক বছর দাম নাগালে থাকায় তারা সোনালি মুরগিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ফলে এখন সোনালি মুরগির চাহিদায় বেড়েছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মোহসীন জানান, এবার শীতে শেষে সামাজিক অনুষ্ঠান বেড়ে যাওয়ায় মুরগির চাহিদা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশের মতো। একদিকে কম উৎপাদন অপরদিকে বাড়তি চাহিদা দাম বাড়িয়েছে।
বেড়েছে খাবার ও বাচ্চার দাম
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিঅ্যাব) বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম বাড়তি থাকায় মুরগির খাবার বা পোলট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। পোলট্রি ফিডের কাঁচামালের দাম কেজিতে ১২ টাকা বেড়েছে। সেই সঙ্গে জাহাজভাড়া মিলে ৩০ শতাংশ দাম বেড়েছে। এতে দেশের বাজারে ফিডের দাম ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেড়েছে। আগে প্রতি কেজি ফিড গড়ে ৪২ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৭ টাকার ওপর।
পোলট্রি খাদ্য তৈরির উপকরণ ভুট্টা কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ২৭ টাকায় এবং মিটবোন মিল ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার আমদানি করা ফিডের কাঁচামাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হয়। খালাসে দেরি হওয়ায় দাম বেড়ে যায়।
এখন বাচ্চার দামও বেড়েছে। সর্বোচ্চ ৪৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে সোনালি ও ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা, যা স্বাভাবিক সময়ে ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে থাকে।
দাম বাড়লেও খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভ বাড়েনি বলে জানান কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. শাহীন। তিনি বলেন, ‘আগে এক খাঁচা মুরগি কিনলে যে পরিমাণ লাভ হতো, এখন তার অর্ধেকে নেমেছে। বেশি দাম হওয়ায় পাইকারি বাজার থেকে বেশি টাকা খরচ করে মুরগি কিনতে হচ্ছে। অপরদিকে ক্রেতারাও কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।’
বাজারে বড় মুরগি কম আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘৬৫০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি ওজনের সোনালি মুরগি এবং দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগি পাওয়া যেত। এখন দাম বেশি হওয়ায় ছোট মুরগিই বেশি আসছে। বাজারে আসা বেশিরভাগ সোনালি মুরগি ৬৫০ থেকে ৭০০ গ্রামের এবং ব্রয়লার মুরগি এক কেজির কাছাকাছি।’
বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মোহসীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রমজান ও ঈদ বাজারের ভালো দামের আশায় অনেকে দেরিতে খামারে মুরগি তুলেছেন। দুই সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর মুরগি বাজারে আসবে। তাই দাম কিছুটা কমে আসতে পারে। তবে বর্তমানে করোনার সংক্রমণ আবারও বেড়ে গেলে খামারিরা গতবারের মতো পথে বসবে। তাই ব্যবসায়ীদের মুরগি ধরে না রেখে বিক্রি করে দেয়া উচিত।’
আরও পড়ুন:দাবদাহ আর বৃষ্টিহীনতায় পুড়ছে মাদারীপুরের পাটক্ষেত। বৈশাখের তপ্ত রোদে পাটক্ষেত নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। পাটের জমিতে ঘন ঘন সেচ দেয়ায় যেমন উৎপাদন খরচ বাড়ছে, তেমনি খরায় জমির আগাছা পরিষ্কার করতে পারছেন না কৃষকরা।
এমনটা চলতে থাকলে উৎপাদন অনেকটা হুমকির মুখে পড়বে বলেও আশঙ্কা কৃষকদের।
সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের মধ্যচক এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দিনের তীব্র দাবদাহে পাট গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতেই মরে যাচ্ছে পাট গাছ। কোথাও শুকিয়ে মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ফলে ঘন ঘন সেচ দিয়েও গাছের আশানুরূপ পরিবর্তন আনতে পারছেন না।
অনাবৃষ্টির কারণে পাট গাছের বৃদ্ধি না হওয়ায় জমিতে আগাছার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্বিগুণ হারে।
কৃষকরা জানান, এবার প্রতি বিঘা পাট চাষ করতে খরচ হয়েছে ১৯ হাজার ৫০০ টাকার মতো। যা গতবারের চেয়ে অন্তত দুই হাজার বেশি। এরপরে গাছ শুকিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য সেচ দিচ্ছেন তারা। ফলে আরও বাড়তে পারে উৎপাদন ব্যয়।
খোয়াজপুরের কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কয়েকদিনের প্রচণ্ড গরমে মাঠ ফেটে চৌচির। পাটগাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। একটুখানি বড় হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন চললে এবার পাট আবাদ ধসে পড়বে। অনেকেই সেচ দিলেও এক দুই দিন পরে আবার শুকিয়ে যায়। এতে মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে উঠছে।’
আর মাদারীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এবার ৩৭ হাজার ৪০২ হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এরই মধ্যে অধিকাংশ জমিতে বপন কাজ শেষ হয়েছে এবং অনেক স্থানে চারা বড় হয়ে গেছে, কিন্তু রোগের কারণে পাটের ক্ষতি হওয়ায় চাষিদের বিকেলে পানি সেচ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক আবদুল মতিন বিশ্বাস বলেন, ‘এই গরমে পাটের কিছুটা ক্ষতি হচ্ছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই, তবে কৃষকদের বলছি, যেন বিকেলে সেচের মাধ্যমে পাট গাছ জীবিত রাখে। এতে গাছ মরবে না।’
মাদারীপুর জেলায় অন্যতম অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটের অবস্থান শীর্ষে। গত বছর পাটের মূল্য ভাল পাওয়ায় কৃষকরাও এবার বেশি জমিতে পাট চাষ করেছেন।
আরও পড়ুন:গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ফেটালিয়া ও নাশেরা গ্রামের দুইশ’ কৃষকের প্রায় ৪ শ’ বিঘা জমির বোরো ধান ইটভাটার আগুনের তাপে নষ্ট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভাটার আগুনের তেজস্ক্রিয়তায় পার্শ্ববর্তী দড়িনাশেরা গ্রামের কৃষকদেরও ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
অভিযোগ পেয়ে উপজেলা কৃষি অফিস জমির ফসল পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নির্ণয় করে তাদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ইটভাটার চারপাশের বিপুল পরিমাণ জমির ফসল পুড়ে যাওয়ার মতো লালচে রঙ ধারণ করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন ফলজ গাছপালা ও সবজির বাগান।
স্থানীয়রা জানান, ২০১২ সাল থেকে কাপাসিয়ার তারাগঞ্জের ফেটালিয়া গ্রামে এসকেএস ইটভাটা স্থাপিত হয়। হাত বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নামেরও পরিবর্তন হয়। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে কর্তৃপক্ষ ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কখনও ফেটালিয়া ব্রিক ফিল্ড, ভাই ভাই ব্রিক ফিল্ড নামে ইটভাটা পরিচালনা করলেও বর্তমানে এসআরএফ নামে ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বর্তমান মালিক।
তারা জানান, এ ইটভাটার ২০০ ফিট দূরত্বের মধ্যে স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ ও ঘনবসতি রয়েছে। ভাটার কালো ধোঁয়ায় আশপাশের গ্রামের বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছে ফুল-ফল থাকে না; সব কিছু অকালেই ঝরে যায়। প্রতি বছর যে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে, তা হলো কালো ধোঁয়া ও তাপে পুড়ে যায় ফসলের মাঠ। এ বছরও বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ ভাটার আগুনের তাপে পুড়ে গেছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, অনুমোদন না থাকায় ঈদের আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ইটের ভাটাটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়। এই ভাটাটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায় থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধের দাবি করে আসছিল এলাকাবাসী। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকলেও ইট পোড়ানো হয় এ ভাটায়। কয়েকদিন পরপর ইটভাটায় কয়েক দফা অভিযান পরিচালনা করে প্রশাসন, কিন্তু পরবর্তীতে ফের শুরু হয় ভাটার কার্যক্রম। তবে সেসব সময় অদৃশ্য কারণে নীরবতা পালন করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ফেটালিয়া ও নাশেরা গ্রামটি ধান উৎপাদনে ব্যাপক প্রসিদ্ধ। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষের আয়ের মূল চালিকা শক্তি ফল উৎপাদন ও কৃষির বিভিন্ন ফসল। কৃষকদের দাবি, অথচ এক ইটভাটার কারণে দুর্ভোগ বেড়েছে পুরো এলাকার মানুষের।
মো. বুরুজ আলী নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমি এ বছর পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। ধানে দুধ আসার পরপরই ভাটার আগুনের তাপে তা পুড়ে গেছে। টাকা ধার করে জমি চাষ করেছিলাম। সেই ধারের টাকা এখন কীভাবে পরিশোধ করব, তা নিয়ে ভেবে কূল পাচ্ছি না।’
কৃষক মো. রফিকুল বলেন, ‘এ বছর ১৫ শতাংশ জমিতে ধানের চাষ করেছি। তার এক মুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারব না। ইটভাটার আগুনের তাপে সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।
‘গরুকে খাওয়ানোর যে কুটা (খড়) লাগবে তাও পাই কিনা সন্দেহ। আগুনের তাপে ঝলসে যাওয়া কুটা গরুও খেতে চায় না। এখন গরু কী খাবে, আর আমরাই বা কী খাব?’
আবাদি জমির পাশে ইটভাটা নির্মাণ হওয়ায় প্রতি বছরই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় বলে জানান কৃষক আব্দুল হাই।
কিছুটা ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন, ‘ভাটার আগুনের তাপ ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে, যা কোনোভাবেই পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না। ওই জমির ফসল দিয়েই আমাদের সারা বছরের খাওয়ার যোগান হয়। কীভাবে কী করবো বুঝতে পারছি না।’
কৃষি জমিতে কাজ করতে গিয়ে ভাটার ধোঁয়ায় জনস্বাস্থ্যেও পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এ বিষয়ে কৃষক আব্দুল বাতেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খেতে কাজ করতে গেলেই আমার বাবার তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি।’
এই এলাকায় যেন কোনো ইটের ভাটা না থাকে, প্রশাসনের কাছে এমন দাবি রাখেন তিনি।
দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ফেটালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই শতাধিক কৃষকের ধান পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিপূরণ পেতে কৃষকরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তারা ক্ষতিপূরণ পাবে কি না এখনই বলা যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে ইটভাটার মালিক রমিজ উদ্দিন রমি বলেন, ‘আগুনের তাপে ধানের ফুল আসার সময় কয়েকজন কৃষকের ফসল নষ্ট হইছে। পরে তারা ইটভাটার গেইটে তালা মেরে রাখেন।’
কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমার ভাটাটি বন্ধ রয়েছে। আমি এখনও ভাটার লাইসেন্স করতে পারিনি।’
কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজার মঞ্জুরুল আমিন সম্প্রতি কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত ফলজ গাছ ও ধানের ফসল পরিদর্শন করেছেন। সরেজমিনে তিনি কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে ও তথ্যানুসন্ধান করে জেনেছেন, স্থানীয় ইটভাটার কারণেই কৃষকদের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
নিউজবাংলাকে এসব তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘ধান পরিপুষ্ট হওয়ার আগেই নির্গত ক্ষতিকর ধোঁয়ায় সব ঝলসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের তালিকা তৈরি করে উপজেলা কৃষি অফিসে জমা দেয়া হবে।’
কাপাসিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার বসাক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বিনা ধান-২৫ এর পরীক্ষামূলক চাষাবাদে সফলতা পাওয়া গেছে। স্বল্প সময়ে ধানের বাম্পার ফলনে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে এ ধান উৎসাহ-উদ্দীপনা যুগিয়েছে।
নতুন উদ্ভাবিত প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ধান বোরো জাতের বিনা ধান-২৫। উচ্চ ফলনশীল হলেও ধানটি হাইব্রিড নয় বলে দাবি করা হচ্ছে। বাসমতি চালের বিকল্প হিসেবে এ ধানের চাষ বাড়লে দেশে চিকন চালের আমদানি কমতে পারে বলে দাবি কৃষি বিভাগের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের জলালপুর গ্রামে এ বছর বিনা ধান-২৫ এর পরীক্ষামূলক চাষাবাদ করা হয়েছে। মুন্সীবাজার ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মো. নওরোজ মিয়াসহ এলাকার তিনজন কৃষক চার একর জমিতে বিনা ধান-২৫ এর চাষাবাদ করেছেন।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, বিনা ধান-২৫ বোরোর উন্নতমানের নতুন একটি জাত। নতুন উদ্ভাবিত এই ধানের জাতটি সর্বাধিক লম্বা ও সরু। এর চালের আকার চিকন ও লম্বা। বিদেশ থেকে যে বাসমতি চাল আমদানি করা হয় এটাও অবিকল সেই চালের মতো। এজন্য এই চালের চাহিদা ক্রেতাদের কাছে বেশি।
এর বাজারমূল্যও বেশ ভালো জানিয়ে সূত্র আরও জানায়, উৎপাদন ব্যয় অন্য ধানের মতোই। তবে ফলন অন্য ধানের চেয়ে ভালো হওয়ায় কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। দেশের চাহিদা পুরণের পাশাপাশি এই ধান রপ্তানিও করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কৃষক নওরোজ মিয়া বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৫ মণ ধান পাওয়ার আশা করছি। এই প্রথম নতুন জাতের বিনা ধান-২৫ চাষাবাদে বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি শীষে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০টি ধান ধরেছে।
‘অন্যান্য জাতের তুলনায় বিনা ধান-২৫ জাতে শীষ প্রতি ধানের পরিমাণও বেশি। চাষাবাদে আশানুরূপ ফলন হওয়ায় নিজেকে আরও উদ্বুদ্ধ করে তুলছে বলে মনে হচ্ছে।’
কমলগঞ্জ উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিপ্লব দেব বলেন, ‘পরীক্ষামূলক চাষাবাদে এবং কৃষি বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাম্পার ফলন হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে ধান কাটা হবে।’
সারা দেশের মতো তাপপ্রবাহে পুড়ছে শেরপুর জেলাও। কয়েকদিনের গরমে শেরপুরে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। শুধু তাই নয়, লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জেলার বোরো ধানের আবাদেও।
কৃষি বিভাগের তথ্যনুসারে, চলতি মৌসুমে শেরপুর জেলাজুড়ে ৯১ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ধানখেতে ধান পুষ্ট হতে শুরু করেছে। তবে এরই মধ্যে লোডশেডিং শুরু হওয়ায় চাহিদামাফিক সেচ দিতে না পারছেন না জেলার কৃষকরা। ফলে ধানের আশানুরূপ ফলন পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তাদের মনে।
বিদ্যুতের ঘন ঘন যাওয়া-আসা এবং ভোল্টেজ কম থাকায় সেচ পাম্পের মোটরও পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সেচ পাম্পের মালিকরাও আছে বিপাকে।
শেরপুর কৃষি সম্প্রাসরণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সুকল্প দাস জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ৯১ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। ৭০ শতাংশ জমিতে বোরো ধানের ফ্লাওয়ারিং হয়েছে (ফুল ফুটেছে)। অন্যদিকে, পাহাড়ি এলাকায় আগাম জাতের লাগানো ধানগুলো ইতোমধ্যে কাটা শুরু করেছে।
জেলার পিডিবি অফিস বলছে, জেলায় দৈনিক বিদ্যুৎতের চাহিদা প্রায় ৬০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২৫ থেকে ২৮ মেগাওয়াট। তাই চাহিদার তুলনায় অর্ধেক বিদ্যুৎ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের মতও একইরকম। তাদের ভাষ্য, জেলায় পল্লীবিদ্যুতের বিদ্যুৎ চাহিদা ৮০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ৫০ মেগাওয়াটেরও কম। তাই চাহিদার তুলনায় অর্ধেক বিদ্যুৎ দিয়ে যতটা পারা যায়, ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনার চেষ্টা করছেন তারা।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎ থাকে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মতো। এতে করে সেচ পাম্পগুলো ঠিক মতো চালাতে পারছেন না কৃষকরা। বিদ্যুতের ঘন ঘন যাওয়া-আসা এবং ভোল্টেজ কম থাকায় মোটর পুড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, পানির অভাবে জমি ফেটে যাচ্ছে। ধানের থোড় (গাছে যে অংশ থেকে ফুল হয়ে পরে ধান হয়) বের হওয়ার পর কিছু কিছু জমির থোড় শুকিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ অবস্থার পরিবর্তন না হলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা কৃষকদের।
সদর উপজেলার যোগিনীমুড়া গ্রামের কৃষক আলমগীর হারুন বলেন, ‘বোরোর আবাদ কইরা আমরা বর্তমানে খুবই আশঙ্কার মধ্যে আছি। মাঠে যে থুর (থোড়) ধানগুলা বাইর হইতাছে, ঠিকমত সেচ দিবার পাইতাছি না। এই ধানগুলা চিচ (চিটা) হইয়া যাইব।
‘বিদ্যুৎ দিনে ৪-৫ ঘণ্টা থাকে। এত কষ্ট কইরা ফসল ফলাইয়া ঘরে না তোলবার পাইলে আমরা মাঠেই মারা যাব।’
সদর উপজেলার বাজিতখিলা গ্রামের কৃষক লাল মিয়া বলেন, ‘আবাদ তো নষ্ট হইয়া গেল। কারেন্ট থাহে না। ৫০ হাজার টাহা খরচ কইরা ধান লাগাইছি। পানি দিবার না পাইলে তো সব শেষ। আমগোরে কি মাইরা হারবার চাইতাছে নাকি?’
আরেক কৃষক শামসুল মিয়া বলেন, ‘দিনে কারেন্ট থাহে ৪-৬ ঘণ্টা, কিন্তু ভোল্টেজ তো থাহে না। কম ভোল্টেজে মোটর চালু দিলে তো মোটর পুইড়া যায়।’
কৃষকদের কাছে বিদুৎ সঙ্কটের কারণে সেচে প্রভাব পড়ার অভিযোগ পাওয়া গেলেও পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তার দাবি, এতে সেচে তেমন প্রভাব পড়বে না।
শেরপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আলী হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এই শেরপুর জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাভুক্ত ৫টি উপজেলা এবং এর আওতায় প্রায় ১০ হাজার সেচ সংযোগ রয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এতে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে। এর আগে আমরা ভালো বিদুৎ পেয়েছি, তবে বর্তমানে জেলায় ৩০ শতাংশের মতো লোডশেডিং হচ্ছে। আশা করি, খুব দ্রুত এ সঙ্কটও কেটে যাবে।’
প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বোরো ধান কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা।
উপজেলার হাকালুকি হাওরে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সোনালি ফসল তুলতে মাঠে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন কৃষকরা।
কুলাউড়ার অনেক জায়গায় অতি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির শঙ্কায় কৃষকরা আধা পাকা বোরো ধান কাটা শুরু করেছেন। হাওরে পানি ঢোকার আগে ফসল ঘরে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। হাকালুকি হাওরপাড়ের কয়েকটি এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর বোরো ধানচাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে।
কৃষকদের ভাষ্য, হাওরে এবার বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে।
এ বছর হাওরে এখন পর্যন্ত পানি না আসায় সময়মতো নিরাপদে ধান কাটছেন কৃষকরা। হাওরপাড়ের ভুকশিমইল, কানেহাত, কারেরা, বাদে ভুকশিমইল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রচণ্ড রোদে উত্তপ্ত আবহাওয়ায় কৃষকরা হাওরের ভেতর থেকে ধান কাটেছেন।
কৃষক মনিরুল উসলাম বলেন, ‘ধান পাকার আগে অতি বৃষ্টি হলে খুব সমস্যায় পড়তে হয়। হাওরে উজানের পানি ঢুকলে ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। হাওরে এখন পানি না থাকায় ফসল তুলতে সুবিধা হচ্ছে।’
আরেক কৃষক জমির মিয়া বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ধান পাকতে শুরু করলে বৃষ্টি হওয়ায় ক্ষেত নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় ছিলাম। এখন অতিরিক্ত গরম থাকলেও ধান নিরাপদে কাটা সম্ভব হচ্ছে।’
এক কৃষকের ভাষ্য, সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে প্রতি বছর বোরো আবাদে বেশ ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। গেল বছর খরায় বোরো ধান আবাদ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানির সংকটে পড়ায় ধানের চারা নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি আরও জানান, বোরো চাষের এলাকায় গভীর নলকূপের ব্যবস্থা থাকলে হয়তো পানি সংকটের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। গত বছর হাকালুকি হাওরে যে ছোট-বড় খাল রয়েছে, সেগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল। আবাদি জমির পরিমাণ বেশি হওয়ায় তুলনামূলক পানির জোগান না থাকায় দেখা দিয়েছিল পানির অতিরিক্ত সংকট। কোনো কোনো জায়গায় ধান বের হলেও পানির অভাবে চারার অবস্থা ছিল শোচনীয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সব শঙ্কা কাটিয়ে এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে খুশি কৃষকরা।
কুলাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘হাওরে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। চলতি মাসে হাওর অঞ্চলের ধান কাটা শেষ হবে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পুরো উপজেলার ধান কাটা শেষ হবে।
‘এ বছর বোরো ধানের বেশ ভালো ফলন হয়েছে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য সরকারি ভর্তুকি মূল্যে কয়েকটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার কৃষকদের দেয়া হয়েছে।’
আরও পড়ুন:থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙুর। আর কয়েকদিন পর পেকে গেলে তা গাছ থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করা হবে। বাতাসে দোল খাওয়া আঙুর বাগানের এমন দৃশ্য দেখা গেল কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বলরামপুর গ্রামে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা কাজী বিল্লাল হোসেন খোকন পেশায় কলেজ শিক্ষক। শখ করে করা আঙুর বাগানটি এখন তাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে আঙুর উৎপাদনের।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চারপাশে বিস্তৃর্ণ ধানি জমি। তার মাঝেই উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে বাঁশের মাচা। সেই মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলছে গাঢ় সবুজ রঙের আঙুর।
বাগানে নিবিষ্ট চিত্তে গাছের পরিচর্যা করছিলেন বিল্লাল হোসেন। এ সংবাদ সগ্রাংহককে দেখে এগিয়ে আসেন তিনি। এরপর আগ্রহ নিয়ে ঘুরিয়ে দেখান তার শখের আঙুর বাগান।
বাগানের প্রতিটি কোণায় যত্নের ছাপ স্পষ্ট। শিক্ষকের হাতের ছোঁয়ায় আঙুর গাছগুলো সজীব ও সতেজ হয়ে বাগানে শোভা ছড়াচ্ছে।
বিল্লাল জানান, বছর দুই আগে শখ করে তার নার্সারিতে দুটি আঙুর চারা রোপণ করেন তিনি। সেবার গাছ দুটি থেকে তিনি প্রায় ১৮ কেজি আঙুর পেয়েছিলেন। তারপর ইউটিউব দেখে আঙুর বাগান করার উদ্যোগ নেন তিনি।
তিনি জানান, এ বছর ১৪ শতক জমিতে আঙুর বাগান করেছেন। মোটামুটি লাখ খানেক টাকা খরচ হয়েছে তার। তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বাগান থেকে অন্তত ৫ লাখ টাকার আঙুর তিনি বিক্রি করতে পারবেন।
শখের এ কৃষকের চিন্তা, আগামী বছর তিনি বাগানের পরিসর আরও বড় করবেন।
কুমিল্লা জেলার মাটিতে আঙুর চাষের উপযোগিতা আছে কি না তা এ মুর্হুতে বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তবে এ জেলার মাটি সব ধরনের ফল উৎপাদনে সহায়ক বলে জানান অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আইয়ুব মাহমুদ।
কৃষি বিভাগের অব্যাহত সহযোগিতা পেলে আঙুর চাষেও সফলতা আসবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আঙুর চাষে শিক্ষক খোকনের প্রচেষ্টা অন্যদের উৎসাহিত করবে। পাশাপাশি জেলায় ফলের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে।’
রমজানের মধ্যে শসার বাজার চড়া দাম থাকলেও বর্তমানে শসাচাষিরা দাম পাওয়া নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন।
এমন দুঃসময়ে শসাচাষিদের পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের অন্যতম রিটেইল চেইন সুপারশপ ‘স্বপ্ন’।
সম্প্রতি এক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়, ন্যায্য দাম না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার শসাচাষিরা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি শসা বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে চার টাকায়। ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না চাষিরা।
এমন সময় সেই শসাচাষিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ন্যায্যমূল্যে কৃষিপণ্যটি কেনে ‘স্বপ্ন’ কর্তৃপক্ষ। সেই শসা এখন খোলাবাজারের চেয়ে কম দামে স্বপ্ন আউটলেটে পাওয়া যাচ্ছে।
খোলা বাজারে বৃহস্পতিবার ৪০ টাকা কেজিতে শসা বিক্রি করতে দেখা গেলেও স্বপ্ন আউটলেটে তা ১২ টাকা কেজিতে গ্রাহকরা কিনতে পেরেছেন। এরই মধ্যে দিনাজপুরের খানসামার ওই এলাকা থেকে দুই টন এবং ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকা থেকে ছয় টন শসা কিনেছে স্বপ্ন প্রতিনিধি।
বর্তমানে তাদের উৎপাদিত শসা পৌঁছে গেছে স্বপ্নর আউটলেটে। স্টক থাকা অবধি এ অফার গ্রাহকরা পাবেন।
স্বপ্নর নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির বলেন, ‘আমরা শসাচাষিদের দুর্ভোগের কথা জানতে পেরেছি নিউজের মাধ্যমে। আমরা দিনাজপুর, ময়মনসিংহসহ বেশ কিছু এলাকার কৃষকের দুর্ভোগের কথা জানার পর তাদের কাছ থেকে শসা কিনেছি ন্যায্য মূল্যে।
‘অন্যান্য ব্যবসায়ীদেরও কৃষকদের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান থাকবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভবান না করে কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি সেতুবন্ধের চেষ্টা করে আসছে স্বপ্ন। এ চেষ্টা সবসময় অব্যাহত থাকবে।’
এ প্রসঙ্গে স্বপ্নর হেড অফ পার্চেজ সাজ্জাদুল হক বলেন, “বিভিন্ন গণমাধ্যমে শসাচাষিদের সংকটের খবর দেখার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, কৃষকদের পাশে আমরা দাঁড়াব। দিনাজপুর, ময়মনসিংহসহ বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে এরই মধ্যে ৮ টন শসা আমরা কিনেছি।
“দুঃসময়ে কষ্টে থাকা অনেক কৃষকদের পাশে ‘স্বপ্ন’ এর আগেও দাঁড়িয়েছে। সামনেও পাশে থাকবে।”
দিনাজপুরের খানসামা এলাকার কৃষক সাকিব হোসেন বলেন, ‘প্রায় এক বিঘা জমিতে শসা চাষ করেছিলাম এবার। শসার বীজ, সারসহ নানা কাজে লাখ টাকা খরচ হয় আমার, কিন্তু ১০ রমজান অবধি কিছু শসা বিক্রি করার পর বাজারে শসার দাম কমে যায়। প্রতি কেজি ১০ টাকা, এরপর পাঁচ টাকা এবং সবশেষে আরও কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অনেক শসা নষ্ট হয়ে যায়। অনেক লোকসান হচ্ছিল।’
তিনি আরও বলেন, “আমার এলাকার এক সাংবাদিক নিউজ করার পর এসিআই কোম্পানির ‘স্বপ্ন’ থেকে যোগাযোগ করে আমার অনেকগুলো শসা কিনে নিয়েছেন উনারা। এতে করে লোকসানের অনেক ঘাটতি পূরণ হয়েছে আমার। তাদের অশেষ ধন্যবাদ।”
আরও পড়ুন:
মন্তব্য