পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হয়ে ওঠার ইঙ্গিতের মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির গঠন করা স্থিতিশীলতা তহবিলের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে দীর্ঘদিন দাবিহীন পড়ে থাকা লভ্যাংশের বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যবহার করে এই তহবিল গঠন করা হয়েছে।
১০ সদস্যের পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) রোববার এ-সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করেছে।
২০১০ সালের মহাধসের পর এক দশকে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছিল না। তবে গত বছরের মে মাসে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিবর্তন আসার পর থেকে বাজারে আস্থার সংকট কাটতে শুরু করে।
এই কমিশন বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার পাশাপাশি সংকটকালে বাজারকে কীভাবে সাপোর্ট দেয়া যায়, সে চিন্তাভাবনাও করে। এর অংশ হিসেবে অবণ্টিত লভ্যাংশ ব্যবহার করে একটি তহবিল গঠনের চিন্তা করে।
ছয় মাসের বেশি সময় পর এই তহবিল পরিচালনায় কমিটি গঠন করা নিঃসন্দেহে বিনিয়াগকারীদের চিড় ধরা মনোবলকে আরেকটু চাঙা করবে।
তহবিল পরিচালনায় যে পর্ষদ গঠন করা হয়েছে, তাতে সদস্যরা হলেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স বিভাগের অধ্যাপক তানজিলা দিপ্তী, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আমিন ভুঁইয়া, চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ফজল বুলবুল, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সিসিবিএলের স্বতন্ত্র পরিচালক মোহাম্মদ তারেক এবং এ কে এম দেলোয়ার হোসেন এফসিএমএ।
চেয়ারম্যানসহ বোর্ডের প্রত্যেক সদস্যের মেয়াদ হবে ৩ বছর। তবে বিএসইসি যেকোনো সময় কাউকে বাদ দেয়া বা নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
বোর্ডের বৈঠকের কার্যবিবরণী পরবর্তী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে বিএসইসির কাছে পাঠাতে হবে। এই বোর্ড আলোচিত ফান্ড পরিচালনার সব দায়দায়িত্ব বহন করবে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে বিএসইসি আলোচিত ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। গত ২১ জানুয়ারি এ বিষয়ে একটি নোটিশিকেশন জারি করে বিএসইসি। ৩ মে বিএসইসির ৭৭২তম নিয়মিত কমিশন সভায় ‘ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ নামে ওই তহবিল গঠন ও পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা অনুমোদন করা হয়। ২৭ জুন এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়।
এরপর ৬ জুলাই বিএসইসি এক নির্দেশনায় সব তালিকাভুক্ত কোম্পানি, ব্রোকার হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে আগামী ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের কাছে থাকা (যদি থেকে থাকে) অদাবিকৃত লভ্যাংশ, অবণ্টিত লভ্যাংশ, আইপিওর রিফান্ড ইত্যাদি পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে জমা দিতে বলে।
বিএসইসির নির্দেশনায় টাকা জমা দেয়ার জন্য একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। তবে পরে কোম্পানিগুলো আরও এক মাস সময় চেয়ে নেয়।
বিএসইসির অনুমান, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অবণ্টিত ও অদাবিকৃত লভ্যাংশ ও রিফান্ডের পরিমাণ হতে পারে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
তালিকাভুক্ত সিংহভাগ কোম্পানির কাছেই এ রকম অবণ্টিত ও দাবিহীন লভ্যাংশ রয়ে গেছে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ভবন। ফাইল ছবি/নিউজবাংলা
বছরের পর বছর ধরে অবণ্টিত ও দাবিহীন এসব লভ্যাংশ কোম্পানিগুলোর কাছে পড়ে থাকলেও এতদিন এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
গত মে মাসে চেয়ারম্যান, কমিশনারসহ বিএসইসির শীর্ষ পদে পরিবর্তন আসার পর বাজার স্থিতিশীল করতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল গঠন সে পদক্ষেপেরই একটি ।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবণ্টিত ও দাবিহীন লভ্যাংশ সাত বছর পর্যন্ত সাসপেন্ডেড থাকতে পারে। এরপর সেটা চলে যায় বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলে। কিন্তু বাংলাদেশে এতদিন এ ধরনের কোনো তহবিল ছিল না।
তহবিল থেকে বাজারের মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার কেনাবেচা করা তথা বিনিয়োগের জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেয়া হবে। শেয়ার কেনাবেচা করতে গিয়ে যাতে তহবিলের কোনো লোকসান না হয়, তার জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন করা হবে, থাকবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও অডিট কমিটি।
তহবিল কীভাবে ব্যবহৃত হবে?
২৭ জুন জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এই তহবিলের ৪০ শতাংশ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ারে। ৫০ শতাংশ অর্থে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ দেয়া হবে। আর ১০ শতাংশ অর্থ অতালিকাভুক্ত কোম্পানি বা সরকারি সিকিউরিটিজ, স্থায়ী আমানত ও বেমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা যাবে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম সে সময় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তারল্যসংকট কাটাতে এ তহবিল সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’
এই তহবিলের ব্যবস্থাপনায় থাকবে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অফ বাংলাদেশ বা আইসিবি।
বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত কারা নেবে?
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তহবিল ব্যবস্থাপনায় একাধিক কমিটি করবে তহবিল পরিচালনায় ১১ সদস্যের বোর্ড। এর মধ্যে থাকবে পরিচালন ব্যবস্থাপনা কমিটি, নিরীক্ষা ও হিসাব ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি।
প্রয়োজন বোধ করলে আরও সাবকমিটিও করতে পারবে বোর্ড।
তহবিল পরিচালন ব্যবস্থাপনা কমিটিই শেয়া কেনাবেচা, বিনিয়োগ, পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দিতে ঋণ বা অন্য কোনো কাজ করবে।
কেউ টাকা চাইলে?
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কোনো শেয়ারধারী বা তার উত্তরাধিকার নগদ বা বোনাস লভ্যাংশ অথবা রাইট শেয়ার দাবি করলে তাকে ১৫ দিনের মধ্যে শেয়ার বা টাকা পরিশোধ করতে হবে।
বিএসইসি মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, ‘এ জন্য দাবিদারের নামে আলাদা একটি বিও হিসাবে যাচাই-বাছাই শেষ দাবি করা বোনাস শেয়ার প্রদান করা হবে। এতে জটিলতার কিছু নেই।’
যেভাবে এলো তহবিলের ভাবনা
নিয়মিত লেনদেন না করা বা দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থানের কারণে ব্যাংক হিসাব বন্ধ বা অকার্যকর হয়ে যায়। এতে নগদ লভ্যাংশ ব্যাংক হিসাবে জমা হয় না। একই কারণে বিও হিসাব নবায়ন না করলে শেয়ার (স্টক) লভ্যাংশ জমা না হয়ে তা কোম্পানির কাছে ফেরত চলে যায়। কোম্পানি এগুলো সাসেপেন্ডেড হিসাবে জমা দেখিয়ে আর্থিক বিবরণী তৈরি করে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ২১ হাজার কোটি টাকার মতো অবণ্টিত লভ্যাংশ পড়ে থাকার খবর আসে। তখন এই অর্থ ব্যবহার করে কীভাবে পুঁজিবাজারকে উন্নত করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়।
তখনই এই তহবিল গঠনের আলোচনা ওঠে। আর ২৭ জুন প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে এই তহবিল গঠন নিশ্চিত হয়।
বিএসইসির ’ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবলাইজেশন ফান্ড’ খসড়া নীতিমালার ওপর মতামত জন্য উন্মুক্ত করে গত ৮ মার্চ। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নীতিমালার ওপর মতামত দেয়।
খসড়া নীতিমালার ওপর বিএসইসিতে লিখিত প্রস্তাব পাঠায় তালিকাভুক্ত কোম্পানির সমিতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেট কোম্পানি-বিএপিএলসি। তাদের বেশ কিছু আপত্তি বিবেচনায় নেয়া হয়।
ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে নানা আলোচনার পর অবশেষে নীতিমালা চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য পাঠানো হয় বিজি প্রেসে।
অবণ্টিত লভ্যাংশ কত
বিএসইসি দেখেছে, টাকার অঙ্কে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অবণ্টিত বোনাস লভ্যাংশের পরিমাণ ১১ হাজার কোটি টাকা ও নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ ৬৩৪ কোটি টাকা।
সিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে অবণ্টিত বোনাস লভ্যাংশের পরিমাণ ৮ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা ও নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ ৩২১ কোটি টাকা।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮ হাজার ৮০৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকার অদাবিকৃত লভ্যাংশ রয়েছে তামাক খাতের বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড- বিএটিবিসির। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বোনাস লভ্যাংশ এবং ৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা নগদ লভ্যাংশ।
এটি ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব। এরপর ব্যাংক খাতের ৩০ কোম্পানি, আর্থিক খাতের প্রায় সব কোম্পানি ও বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ফলে তহবিলের অঙ্কটা বড় হতে পারে।
তবে এই অবণ্টিত লভ্যাংশের মধ্যে নগদ অর্থ ব্যবহার করা যাবে যেকোনো সময়। তবে বোনাস শেয়ার নিয়ে কী করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।