বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ২০০ কোটি টাকারও বেশি পাওনা পরিশোধে সরকারের নির্দেশনা চেয়েছে পাঁচ বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকা বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউনাইটেড এয়ার।
এ বিষয়ে রূপরেখা চেয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে এয়ারলাইনসটির কর্তৃপক্ষ।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ার ২০১৬ সালে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এতে কোম্পানির শেয়ার দর নামতে নামতে দুই টাকার নিচে নেমে আসে। বিএসইসি মূল মার্কেট থেকে কোম্পানিটিকে স্থানান্তর করে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেটে। সেখানে শেয়ার লেনদেন জটিল ও সময়সাপেক্ষ বলে লেনদেনও হচ্ছে না। এতে ৭২ কোটি শেয়ারের মালিকদের টাকা কার্যত শূন্য হয়ে গেছে।
এর প্রায় পাঁচ বছর পর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড এয়ারের বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয় বিএসইসি। ২০১০ সালে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের প্রধান তাসবিরুল আলম চৌধুরীকে বাদ দিয়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় কাজী ওয়াহিদুল আলমকে।
ওয়াহিদুল আলম বাংলাদেশ বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। এভিয়েশন ব্যবসায় পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে তার ওপর আস্থা রেখেছে বিএসইসি।
বেবিচকের হিসাবে, গত মার্চ পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারের কাছে তাদের পাওনা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০৩ কোটি ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯৩ টাকা। এ টাকা আদায়ে চলতি বছরের শুরুতে এয়ারলাইনসটির পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো নিলামের উদ্যোগ নেয় বেবিচক। অবশ্য পরে প্রতিষ্ঠানটির নতুন পরিচালনা পর্ষদের অনুরোধে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে আকাশ পথের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
সিদ্ধান্ত হয়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দীর্ঘদিন অকেজো পড়ে থাকা উড়োজাহাজগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দেয়া হবে মালিকপক্ষকে।
এরই মধ্যে গত ১১ আগস্ট বেবিচকের সঙ্গে বৈঠক করে ইউনাইটেডের পরিচালনা পর্ষদ। এর পরপরই বিএসইসির কাছে পাওনা পরিশোধের বিষয়ে নির্দেশনা চায় প্রতিষ্ঠানটি।
ইউনাইটেড এয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এখন কোনো ফান্ড নেই। আমাদের এয়ারওর্দিনেস সার্টিফিকেটের (এওসি) মেয়াদও শেষ। আমরা যদি নতুন করে ফ্লাইট শুরু করতে চাই তাহলে আগে পাওনা পরিশোধের বিষয়টি চলে আসছে।
‘পাওনা পরিশোধের বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে আমরা বিএসইসিকে একটি চিঠি দিয়েছি। কীভাবে এই পাওনা পরিশোধ হবে, সেটা কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ থাকবে কিনা বা সরকার এটা পুরোপুরি মওকুফ করে দিতে পারে কিনা, সে বিষয়েই নির্দেশনা চেয়েছি। বিএসইসি যেহেতু আমাদের প্রতিষ্ঠানটি সচল করার দায়িত্ব দিয়েছে, তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিষয়টি জানাবে। তাদের কাছ থেকে নির্দেশনা আসার পর পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা হবে।’
বেবিচক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা তাদের উড়োজাহাজগুলোর একটি অ্যাসেসমেন্ট করতে চাচ্ছে। আমরা তাদের অনুমতি দেবো। তাদের পর্ষদ পুনর্গঠন হয়েছে, এটা সরকারই করেছে। তারপরেও তাদের অনেক দেনাপাওনা রয়ে গেছে। সেগুলো পরিশোধের বিষয়ে কী করা যায় তা তারা দেখছে। দেনা-পাওনা পরিশোধের আগে তাদের ফ্লাইটের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে না।’
বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় ইউনাইটেড এয়ারের বহরে ১০টি উড়োজাহাজ ছিল। এগুলোর মধ্যে নয়টি বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। আর একটি আছে ভারতে।
পর্ষদ পুনর্গঠন হওয়ার পর থেকেই ইউনাইটেডের নতুন কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ফ্লাইটে ফিরে আসতে চায়। তবে পাওনা আদায়ের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আগ্রহ হারিয়েছে ওটিসিতে
পাঁচ বছর ধরে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত না করা, বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ না দেয়া, নিয়মিত এজিএম না করার কারণে পুঁজিবাজারের মূল মার্কেট থেকে ইউনাইটেড এয়ারকে সরিয়ে দেয়া হয়। গত ১৪ জানুয়ারি থেকে কোম্পানিটির লেনদেন হচ্ছে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেটে।
ওটিসিতে পাঠানোর এক মাসের ব্যবধানে পর্ষদ পুনর্গঠনের খবরে আগ্রহ বাড়ে বিনিয়োগকারীদের। ফলে সে সময় ওটিসি মার্কেটে শেয়ার বিক্রির আদেশ দেয়া সব শেয়ার বিক্রি হয়ে যায় এক মাসের কম সময়ে। পরবর্তীতে কোম্পানিটির কোনো অগ্রগতির খবর না আসায়, শেয়ার বিক্রির আদেশ আসলেও ক্রেতার সন্ধানে পড়ে থাকছে বেশিরভাগ শেয়ার।
বিএসইসি কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে নতুন পর্ষদ দেয়ায় বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ থেকে তাদের বিনিয়োগ ফেরত পাবে।
সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে ওটিসিতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ২২ লাখ ৫১৩টি শেয়ার বিক্রির জন্য রাখা আছে। যার প্রতিটি শেয়ারের দর চাওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ ২ টাকা ৮০ পয়সা। ১৪ জানুয়ারিতে ইউনাইটেড এয়ারওয়জের প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হয়েছে ১ টাকা ৮৪ পয়সা।
শেয়ার বেচে বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা
বেসরকারি বিমান সংস্থা হিসেবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রথম প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এয়ার। ২০১০ সালে পুঁজিবাজার যখন চাঙা, তখন সেটি তালিকাভুক্ত হয়। শুরুর দিকে বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে।
সে সময় ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। তবে ২০১৫ সালের পর থেকে কোম্পানিটির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে উদ্যোক্তা পরিচালকেরা তাদের হাতে থাকা প্রায় সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে কোম্পানিটিই বন্ধ করে দেন।
৮২০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির ৮২ কোটি শেয়ারের মধ্যে বাদ পড়া উদ্যোক্তা পরিচালকদের কেবল আড়াই শতাংশ শেয়ার ছিল। অথচ বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হতো তাদের হাতে।
কোম্পানিটি ওটিসি মার্কেটে পাঠিয়ে দেয়ার পর ৭২ কোটি শেয়ারের মালিকদের টাকা কার্যত শূন্য হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কোম্পানিটিকে নতুন করে চালু করতে পারলেই কেবল এই শেয়ার আবার তার মূল্য ফিরে পাবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।