পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সিদ্ধান্তে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পরও দৃশ্যমান উন্নতি করতে না পারা ইউনাইটেড এয়ার ক্ষীণ আশা দেখতে পারছে।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, নয়টি উড়োজাহাজ নিলামে বিক্রি করে দেয়া হবে না। আর সেগুলো কী অবস্থায় আছে, তা পরিদর্শনের সুযোগ দেয়া হবে।
নতুন পরিচালনা পর্ষদ বলছে, উড়োহাজাজগুলো কী অবস্থায় আছে, সেগুলো আবার উড়ার মতো আছে কি না, সেটি না দেখার আগে তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছিল না। এই পরিদর্শন হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যাবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ-বেবিচকের দুটি সিদ্ধান্তে এই আশা তৈরি হলেও কোম্পানিটি আবার চালু হওয়া এখনও অনেক দূরের বিষয়। এর কারণ, যে তহবিল প্রয়োজন হবে, সেটির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড এয়ারের বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয় বিএসইসি।
২০১০ সালে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের প্রধান তাসবিরুল আলম চৌধুরীকে বাদ দিয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় কাজী ওয়াহিদুল আলমকে।
ওয়াহিদুল আলম বাংলাদেশ বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। এভিয়েশন ব্যবসায় তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় তার আস্থা রেখেছে করেছে বিএসইসি।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি ২০১৬ সালে হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে কোম্পানির শেয়ারদর দুই টাকার নিচে নেমে আসে এক পর্যায়ে। আর বিএসইসি মূল মার্কেট থেকে কোম্পানিটিকে স্থানান্তর করে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেটে। সেখানে শেয়ার লেনদেন জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে লেনদেনও হচ্ছে না। এতে ৭২ কোটি শেয়ারের মালিকদের টাকা কার্যত নাই হয়ে গেছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড এয়ারের বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয় বিএসইসি
বোর্ড পুনর্গঠনের পর তারা যে আশা দেখছিলেন, তাতেও এতদিন কোনো সুখবর আসছিল না। ইউনাইটেড নিয়ে এই দুই সিদ্ধান্তে তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে পারেন।
বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় ইউনাইটেড এয়ারের বহরে ১০টি উড়োজাহাজ ছিল। এগুলোর মধ্যে নয়টি বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। আর একটি আছে ভারতে।
পর্ষদ পুনর্গঠন হওয়ার পর থেকেই ইউনাইটেডের নতুন কর্তৃপক্ষ বলে আসছে, তারা ফ্লাইটে ফিরে আসতে চায়। দেনা শোধেও আপত্তি নেই।
এর মধ্যেই ফ্লাইট পরিচালনায় না থাকা তিন এয়ারলাইনসের কাছে বিভিন্ন ফি বাবদ পাওনা ৭৭৪ কোটি ৭৪ লাখ ৩ হাজার ৭১৪ টাকা টাকা আদায়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানায় বেবিচক। একইসঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর পরিত্যক্ত কয়েকটি উড়োজাহাজ নিলামে তোলার প্রক্রিয়াও শুরু হয়।
বেবিচকের হিসাবে, গত মার্চ পর্যন্ত রিজেন্ট এয়ারের কাছে তাদের মোট পাওনা ২৮৩ কোটি ৩৮ লাখ ২৮ হাজার ১৭৩ টাকা, ইউনাইটেড এয়ারের কাছে ২০৩ কোটি ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯৩ টাকা এবং জিএমজি এয়ারের কাছে পাওনা হয়েছে ৩৬৮ কোটি ২৯ লাখ ৬ হাজার ৪৮ টাকা।
নিলামের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তা ঠেকাতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে ইউনাইটেড এয়ার। দাবি করে, উড়োজাহাজগুলো পরিদর্শনের। এ নিয়ে বেবিচককে কয়েক দফা চিঠিও দেয়া হয় এয়ারলাইনসটির পক্ষ থেকে।
আকাশপথের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেবিচকের চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু বিএসইসি কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেডের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে এবং নতুন পর্ষদও উড়োজাহাজগুলোর ভ্যেলুয়েশন করতে চান। এ কারণে আমরা আপাতত নিলাম স্থগিত রেখেছি।
‘তারা আমাদের কাছে অনুরোধ করেছে যে, তারা উড়োজাহাজগুলো সশরীরে পরিদর্শন করতে চায়। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাদের এ সুযোগ দেয়া হবে।’
ইউনাইটেড এয়ারের পুর্নগঠিত বোর্ডের প্রধান কাজী ওয়াহিদুল আলম
ইউনাইটেড এয়ারের নতুন পরিচালনা পর্ষদের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেবিচক আমাদের উড়োজাহাজগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দেবে বলে জানিয়েছে। এটা একটা অগ্রগতি। প্রায় ৫-৬ বছর হয়ে গেছে, এখন আমরা কীভাবে এই এয়ারলাইনসকে পুনরুজ্জীবিত করব, সেটা তো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। বেবিচকের যে আইন আছে সেটা তো আর ভাঙা যাবে না। সেটাকে রেখেই অগ্রসর হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এটা নিয়েই এখন আমরা কাজ করছি। বেবিচকও করছে, আমরাও করছি। দেনা পাওনা নিয়ে সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধানও তো একটি বিষয়। এগুলো নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু করতেও পারছি না।
‘আমাদের আরো ফান্ড দরকার। সেটা নিয়ে বেবিচকের সিদ্ধান্তকে সম্মান করেই কাজ করতে হবে। আমাদের বেবিচক যেটা বলেছে, আমরা সাধারণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আসলে তারা বাধা দেবে না।’
আগ্রহ হারিয়েছে ওটিসিতে
পাঁচ বছর ধরে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত না করা, বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ না দেয়া, নিয়মিত এজিএম না করার কারণে সম্প্রতি পুঁজিবাজারের মূল মার্কেট থেকে ইউনাইটেড এয়ারকে সরিয়ে দেয়া হয়। গত ১৪ জানুয়ারি থেকে কোম্পানিটি লেনদেন হচ্ছে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেটে।
ওটিসিতে পাঠানো এক মাসের ব্যবধানে পর্ষদ পুনগঠনের খবরে আগ্রহ বাড়ে বিনিয়োগকারীদের।
ওটিসি মার্কেটে এমনও কোম্পানি আছে যেগুলোর শেয়ার বিক্রির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়ে। কিন্ত পর্ষদ পুনগঠনের খবরে মাত্র এক মাসে এক কোটির বেশি শেয়ার বিক্রি হয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের।
কিন্ত তিন মাসেও কোম্পানিটির কোনো অগ্রগতি না থাকায় আগ্রহ হারায় বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে শেয়ার ক্রেতা না থাকায় কোটির বেশি শেয়ার পড়ে আছে বিক্রির অপেক্ষায়।
শেয়ার বেচে বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা
বেসরকারি বিমান সংস্থা হিসেবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রথম প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এয়ার। ২০১০ সালে পুঁজিবাজার যখন চাঙা, তখন সেটি তালিকাভুক্ত হয়। শুরুর দিকে বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে।
সে সময় ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। তবে ২০১৫ সালের পর থেকে কোম্পানিটির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে উদ্যোক্তা পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা প্রায় সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে কোম্পানিটিই বন্ধ করে দেন।
৮২০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির ৮২ কোটি শেয়ারের মধ্যে বাদ পড়া উদ্যোক্তা পরিচালকদের কেবল আড়াই শতাংশ শেয়ার ছিল। অথচ বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হতো তাদের হাতে।
সেখানে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির আদেশ দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা, কিন্তু কেউ কিনতে রাজি হচ্ছেন না।
কোম্পানিটি ওটিসি মার্কেটে পাঠিয়ে দেয়ার পর ৭২ কোটি শেয়ারের মালিকদের টাকা কার্যত নাই হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কোম্পানিটিকে নতুন করে চালু করতে পারলেই কেবল এই শেয়ার আবার তার মূল্য ফিরে পাবে।