পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর বন্ধ কোম্পানিকে উৎপাদনে নিয়ে আসার পরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রিংসাইন টেক্সটাইল এখন উৎপাদন আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
বর্তমানে উৎপাদনক্ষমতার ২৫ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি ধাপে ধাপে বাড়িয়ে শতভাগে নেয়ার চেষ্টায় আছে বর্তমান বিএসইসির গঠন করে দেয়া পর্ষদ।
২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি পরের বছর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা তাদের টাকা ফিরে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েন। এই পরিস্থিতিতে বিএসইসি গত ২৭ জানুয়ারি কোম্পানিটির বোর্ড পুনর্গঠন করে আগের পরিচালকদের বাদ দিয়ে দেয়।
বিএসইসি মনোনীত পরিচালনা পর্ষদের সদস্য অধ্যাপক সগীর হোসাইন খন্দকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোম্পানির উৎপাদন চলমান আছে এবং এটা কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়েও আমরা কাজ করছি।’
গত জুনে কোম্পানিটি পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করে। আর এখন কয়েকটি ইউনিট একসঙ্গে চালু আছে। একটি বিশেষ ইউনিট চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
গত ১৩ জুন ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে কোম্পানিটি জানায়, তারা তাদের উৎপাদনক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ ব্যবহার করছে।
রিংসাইনের ক্ষেত্রে নতুন বোর্ডের আরেকটু সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এ কারণে যে, আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিটি যে ১৫০ কোটি টাকা তুলেছিল, তার পুরোটাই ব্যাংকে রক্ষিত আছে।
এর মধ্যে বিএসইসির অনুমতি পেয়ে ৪০ কোটি টাকায় দায়দেনা পরিশোধ হয়েছে। আর বাকি অর্থে শুরু হয় উৎপাদন।
বাকি ১১০ কোটি টাকা ব্যবহারের জন্য বিএসইসির কাছে কোনো আবেদন করা হবে কি না, এমন প্রশ্নে অধ্যাপক সগীর হোসাইন খন্দকার বলেন, ‘আমাদের যখন প্রয়োজন ছিল তখন বিএসইসি থেকে চেয়ে নিয়েছি এবং সে টাকা দিয়ে কোম্পানির উৎপাদন চালু করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বাকি যে প্ল্যান্টগুলো আছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করার। এখন আপাতত আইপিও থেকে নতুন করে প্রয়োজন নেই। আমাদের যে টাকা দেয়া হয়েছে সেগুলোই ব্যবহৃত হচ্ছে।’
বোর্ডের একজন সদস্য জানান, একটি স্পেশাল ইউনিট চালুর জন্য ৬০ কোটি টাকা প্রয়োজন। সেটি চালু করা নিশ্চিত হওয়ার পরেই সেই টাকার জন্য আবেদন করা হবে।
উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে এবং এতে মুনাফাও হচ্ছে বলে জানান এই বোর্ড সদস্য। তবে কী পরিমাণ মুনাফা হচ্ছে, সেই হিসাব তার কাছে নেই বলে জানান অধ্যাপক সগীর। জানান, তারা একটি বার্ষিক সাধারণ সভা করার চেষ্টা করছেন, সেখানেই সব হিসাব-নিকাশ প্রকাশ করা হবে।
বার্ষিক সাধারণ সভায় সব পরিকল্পনা প্রকাশ
কোম্পানির বর্তমান অবস্থান, তারা কী করছেন, ভবিষ্যতে পরিকল্পনা কী- এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের তথ্য দিতে বার্ষিক সাধারণ সভা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলেও জানান অধ্যাপক সগীর।
তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন করে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি। আমাদের সিএফও নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি আর্থিক সবকিছু দেখভাল করছেন। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব আমরা এজিএম করব। সেখানে কোম্পানির সার্বিক অগ্রগতির বিষয়টি জানা যাবে।’
তালিকাভুক্তির বছরে ২০১৯ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছিল রিংসাইন। ২০২০ সালে ১ শতাংশ বোনাস ও ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করা হলেও বার্ষিক সাধারণ সভা করে সেটি অনুমোদন করা যায়নি। এর মধ্যে করোনার সময় কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর কোনো একটা কিছু হচ্ছে- এমন তথ্য পেয়ে কোম্পানির আইপিও ফান্ড আটকে দেয় বিএসইসি।
উৎপাদন শুরু হলেও এবার জুনে অর্থবছর শেষে বোর্ডসভায় ২০২১ সালের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে ভবিষ্যতে ভালো লভ্যাংশ দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন অধ্যাপক সগীর।
সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব হবে কি না- এই প্রশ্নে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কোম্পানির আর্থিক বিষয়গুলোতে খুব বেশি জোর দিচ্ছি। লভ্যাংশ দেয়া যাবে কি না, সেটি আর্থিক বিবরণী চূড়ান্ত হলে বলা যাবে। তবে যেহেতু কোম্পানির উৎপাদন চলছে, তাই আমাদের চেষ্টা থাকবেই যেন শেয়ারধারীরা ভালো লভ্যাংশ পেতে পারেন।’
২৭ কোটি শেয়ার বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে
রিংসাইন পুনর্গঠন করার পর এতে আরও অনিয়ম ধরা পড়ে। তালিকাভুক্তির আগেই কোম্পানির ২৭ কোটির বেশি শেয়ার ইস্যু করা হয় প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে। মালিকপক্ষের নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করা এই শেয়ারের বিপরীতে কোনো টাকা জমা নেয়া হয়নি।
আইপিওতে আসার আগে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। উদ্যোক্তা বা পরিচালক ও ৭৩ জন সাধারণ শেয়ারধারীর কাছে ২৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এই পরিশোধিত মূলধন ২৮৫ কোটি ৫ লাখ টাকা করা হয়। কিন্তু এই শেয়ারের বিপরীতে বিপরীতে কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি।
গত ২৪ জুন বিএসইসি এক বিজ্ঞপ্তিতে এই বিষয়টি উদঘাটনের কথা জানায়। এই অবৈধ শেয়ার বাতিল হবে জানালেও এখনও সব কাজ শেষ হয়নি।
অধ্যাপক সগীর বলেন, ‘এটি আমাদের কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে না। এটি নিয়ে আমাদের বোর্ডে কোনো আলোচনা হয়নি। এ বিষয়টি বিএসইসি দেখছে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেভাবেই হোক শেয়ারগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেগুলো তাদের অ্যাকাউন্টে আছে। ফলে চাইলেই তা নিয়ে আসা যাবে না। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা বাতিল করতে হবে। আমরা সে প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু শেয়ারগুলোর বিপরীতে পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। ফলে অবশ্যই এগুলো অবৈধভাবে। তাই এগুলো তাদের আবার দেয়ার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।’
২৭ কোটি ৫১ লাখ শেয়ার বাতিল হলে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন হবে ২২৫ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। শেয়ারসংখ্যা হবে ২২ কোটি ৫২ লাখ ১৩ হাজার ৪৩টি।
অর্থাৎ বর্তমানে কোম্পানিটির যে শেয়ার দেখানো হচ্ছে, তার ৫৪ শতাংশই কমে যাচ্ছে।
আইপিওর টাকায় পাবে নতুন জীবন
কোম্পানিটি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে যে দেড় শ কোটি টাকা তোলে, সেই টাকা নিয়ে কোম্পানির বিদেশি পরিচালকরা দেশে চলে যাচ্ছেন, এমন গুঞ্জনের মধ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে হস্তক্ষেপ করে বিএসইসি। তাদের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক কোম্পানির ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেয়। ফলে সে টাকা আর তুলতে পারেনি।
২০ মে বিএসইসি আইপিওর ৪০ কোটি টাকা ব্যবহারের অনুমতি দেয় নতুন পর্ষদকে। এর মধ্যে ১৫ কোটি টাকা দেয়া হয় ছাঁটাই করা কর্মীদের বেতন-ভাতা হিসেবে। ৩ কোটি টাকায় পরিশোধ করা হয় বেজপার পাওনা। তিতাস গ্যাসের পাওনা পরিশোধে যাবে সাড়ে ৩ কোটি টাকা।
১০ কোটি টাকায় পরিশোধ করা হবে প্রিমিয়ার ব্যাংকের আর ৬ কোটি টাকায় ঢাকা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার কথা জানানো হয়। এর বাইরে আরও আড়াই কোটি টাকা বিবিধ খাতে খরচ হবে বলে জানানো হয়।
প্রসপেক্টাসে তহবিল ব্যবহারের যে কথা বলা ছিল, তার বদলে অন্য খাতে ব্যয় করার জন্য আইনি বাধাও দূর করে দিয়েছে কমিশন।
বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানির ৫১ শতাংশ শেয়ারধারীদের উপস্থিতিতে সাধারণ সভা করারও অনুমোদন দেয়া হয়।
বিনিয়োগকারীদের স্বপ্ন যাদের হাতে
বর্তমানে সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক কোম্পানিটি চালাচ্ছেন, যার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মেজবাহ উদ্দিন।
সগীর হোসাইন খন্দকার ছাড়া পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ আলী, পাওয়ার গ্রিডের স্বতন্ত্র পরিচালক ইসতাক আহমেদ শিমুল এবং অ্যাভিয়েশন ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেসের সাবেক মহাব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক।
যেভাবে বিপাকে
ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ডিইপিজেড) তাইওয়ানের মালিকানাধীন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রিংসাইন একটি শক্তিশালী কোম্পানি হিসেবেই পরিচিত ছিল। এর শ্রমিকসংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি ছিল।
১৯৯৬ সালে ডিইপিজেডে তাইওয়ানের নাগরিক মি সাও সোয়েটার কারখানাটি চালু করেন। ব্যবসায়িক সাফল্যে একে একে তিনি গড়ে তোলেন অ্যাভাস গার্ড লিমিটেড, সাইন ফ্যাশন লিমিটেড ও ইন্টার লগ লিমিটেড। এসব কারখানায় শ্রমিক ছিলেন আরও অন্তত সাত হাজার।
সমস্যার শুরু পাঁচ বছর আগে। বার্ধক্যজনিত কারণে মি সাও মারা গেলে তার ছেলে মি উইং থিং ও মেয়ে অ্যাঞ্জেলা কারখানাটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু শ্রমিক ফেডারেশন নেতা ও কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তারা পেরে ওঠেননি।
মালিকদের অভিযোগ, শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে আমদানি করা সুতাসহ নানা উপকরণ পাচার করে দিচ্ছিলেন শ্রমিক ফেডারেশন নেতা ও কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
মি সাওয়ের মতো তার সন্তানরা ব্যবসা অতটা ভালো বুঝতেন না। আর এই সুযোগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে বলেও তথ্য আছে। একপর্যায়ে মি সাওয়ের দুই সন্তান কাউকে না বলে বাংলাদেশ থেকে চলে যান।
তখন অভিযোগ উঠে, কোম্পানিটির বিদেশি পরিচালকরা আইপিওর মাধ্যমে তোলা টাকা নিয়ে নিজ দেশে চলে গেছেন। তবে সেটা সত্য প্রমাণিত হয়নি। আর বিএসইসির অনুরোধে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কোম্পানির ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মালিকানার বর্তমান হিস্যা
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী ৫০০ কোটি টাকার কিছু বেশি পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির শেয়ারসংখ্যা ৫০ কোটি ৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৩টি।
এই শেয়ারের মধ্যে ৩১ দশমিক ৫৪ শতাংশের মালিকানা উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১৬ দশমিক ২৩ শতাংশ শেয়ার। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কিনেছেন দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ৫২ দশমিক ১৮ শতাংশ শেয়ারের মালিক।
অর্থাৎ ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা মোট ২৬ কোটি ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪৫টি শেয়ারের মালিক।