পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরও দুটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড আকর্ষণীয় লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তারা ইউনিটধারীদেরকে গত জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত যে হারে লভ্যাংশ দিতে যাচ্ছে, তা দেশের যে কোনো সঞ্চয়ী হিসাব তো বটেই, এমনকি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার চেয়ে বেশি।
এর মধ্যে একটি ফান্ড তার ৫ বছরের সম্মিলিত লভ্যাংশের ৬০ শতাংশের বেশি দেয়ার কথা জানিয়েছে এবার। আর একটি ফান্ড তার আগের দুই বছরের সম্মিলিত লভ্যাংশের দ্বিগুণ লভ্যাংশ দিচ্ছে এবার।
সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি স্ট্র্যটেজিক ইক্যুইটি পরিচালিত এসইএমএল লেকচার ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ড ও এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড ইউনিটধারীদেরকে দেড় টাকা করে লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
সোমবার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার দিন ফান্ড দুটির দাম ছিল যথাক্রমে ১২ টাকা ২০ পয়সা এবং ১২ টাকা ৬০ পয়সা।
এই দামে যদি কেউ বিনিয়োগ করে তাহলে লেকচার ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ডে ইউনিট মূল্যের ১২.২৯ শতাংশ আর ফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ডে ইউনিট মূল্যের ১১.৯০ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে পাওয়া যাবে।
এখন দেশে কোনো সঞ্চয়ী হিসাবে এই হারে মুনাফা দেয় না। সঞ্চয়পত্রেরও এত বেশি হারে মুনাফা দেয় না। পেনশনাস সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি ১১.৭৬ শতাংশ মুনাফা দিলেও সেখানে থেকে ১০ শতাংশ কর কারা হয়।
অন্যদিকে মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মুনাফা করমুক্ত। ফলে এখানে প্রকৃত রিটার্ন বেশি।
ফান্ড দুটির মধ্যে বেশি আয় করেছে লেকচার ফান্ড। তবে গত বছরের লোকসানের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে তারা লভ্যাংশ কমিয়েছে।
ফান্ডটি এবার ইউনিটপ্রতি আয় করেছে ২ টাকা ৮৪ পয়সা। আগের বছর লোকসান ছিল ১ টাকা ৭ পয়সা।
অন্যদিকে গ্রোথ ফান্ড এবার ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৮৭ পয়সা আয় করলেও এর লভ্যাংশ দেয়ার সক্ষমতা বেশি ছিল। কারণ, তাদের গত বছর লোকসান ছিল না। সে বছর ইউনিটপ্রতি আয় ছিল ২৭ পয়সা।
মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালা অনুযায়ী ফান্ডগুলো তাদের আয়ের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ নগদে বিতরণ করবে। আর গ্রোথ ফান্ড বিতরণ করবে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ। তবে আগের বছরে লোকসান থাকলে তা সমন্বয় করতে পারবে।
দুটি ফান্ডই তাদের কার্যক্রম শুরু করার পর রেকর্ড পরিমাণ লভ্যাংশ দিয়েছে।
২০১৬ সালে কার্যক্রম শুরু করা লেকচার ইক্যুইটি ফান্ড শুরুর বছরে ইউনিটপ্রতি ২৫ পয়সা, পরের বছর ১ টাকা, এর পরের বছর ৭০ পয়সা এবং ২০১৯ সালে ৫০ পয়সা লভ্যাংশ দিয়েছে। গত বছর তারা লভ্যাংশ দেয়নি।
অর্থাৎ পাঁচ বছরের সম্মিলিত লভ্যাংশ ২ টাকা ৪৫ পয়সা, আর এক বছরেই তার ৬২.৫ শতাংশ লভ্যাংশ পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে ২০১৯ সালে কার্যক্রম শুরু করা গ্রোথ ফান্ডটি শুরুর বছরে ৫০ পয়সা এবং গত বছর ২৫ পয়সা লভ্যাংশ দিয়েছে। অর্থাৎ দুই বছরের সম্মিলিত লভ্যাংশের চেয়ে এক বছরের লভ্যাংশ দ্বিগুণ।
আগের চার ফান্ডেরও রেকর্ড লভ্যাংশ
জুনে অর্থবছর শেষ হয়েছে এমন আরও চারটি ফান্ড এরই মধ্যে লভ্যাংশ ঘোষণা করছে যেগুলো রেকর্ড আয় করে লভ্যাংশও দিয়েছে রেকর্ড পরিমাণ।
স্ট্র্যটেজিক ইক্যুইটি পরিচালিত আরেক ফান্ড এসইএমএল আইবিবিএল শরিয়াহ তার ইউনিটধারীদেরকে ১ টাকা করে লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। এই ফান্ডটি এবার ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৩৫ আয় করেছে। গত বছর ১ টাকা ১৩ পয়সা লোকসান ছিল তাদের।
তবে লভ্যাংশের খবরে ফান্ডটির দাম ইউনিটপ্রতি ৬০ পয়সা কমে যায়। এর বর্তমান মূল্য ১২ টাকা ১০ পয়সা।
গত ৪ আগস্ট জুনে অর্থবছর শেষ হয়েছে পুঁজিবাজারের এমন ফান্ডের মধ্যে প্রথমে লভ্যাংশ দেয় এনএলআই ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, যেটি ইউনিট প্রতি ১ টাকা ৭৫ পয়সা লভ্যাংশ দিয়েছে।
এনএলআই ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান এবার ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৭৫ পয়সা লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে
এই ফান্ডটিও গত বছর লোকসানে ছিল। সে বছর ইউনিটপ্রতি তাদের লোকসান ছিল ৭৬ পয়সা। চলতি বছর আয় হয়েছে ৩ টাকা ১৪ পয়সা। আর আগের বছরের লোকসানের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে চূড়ান্ত আয় হয়েছে ১ টাকা ৮৬ পয়সা।
সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এলআর গ্লোবাল পরিচালিত ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও গ্রিন ডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিট প্রতি ১ টাকা ২০ পয়সা অর্থাৎ ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেবে এবার।
২০১০ সালে তালিকাভুক্ত দুটি ফান্ড এর আগে কখনও এত বেশি লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
গ্রিনডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ড এর আগে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ দিয়েছে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে, ৯ শতাংশ করে। অন্যদিকে ডিবিএইচ মিউচ্যুয়াল ফান্ড সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে ২০১৮ সালে।
২০২০ সালে ডিবিএইচ মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিট প্রতি ১ টাকা ৮ পয়সা লোকসান দিয়েছিল। আর গ্রিনডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ড লোকসান দিয়েছিল ৯৯ পয়সা।
আরও আটটির লভ্যাংশ বুধবার
আগামী বুধবার ঘোষণা হবে আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি পরিচালিত আটটি ফান্ডের লভ্যাংশ।
এগুলো হলো আইসিবি এএমসিএল ফার্স্ট অগ্রণী ব্যাংক মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান, আইসিবি এএমসিএল সোনালী ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইসিবি এএমসিএল সেকেন্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান, আইসিবি এএমসিএল থার্ড এনআরবি মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইসিবি এমপ্লয়ি প্রভিডেন্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান, আইএফআইএল ইসলামি মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান, প্রাইম ব্যাংক ফার্স্ট আইসিবি এএমসিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও ফিনিক্স ফিন্যান্স মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান।
পুঁজিবাজারের বাইরের ফান্ডগুলোর অভাবনীয় লভ্যাংশ
এখন পর্যন্ত অতালিকাভুক্ত যেসব ফান্ড লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ- আইসিবি পরিচালিত ইউনিট ফান্ড। এটি ইউনিটপ্রতি ৪২ টাকা লভ্যাংশ দিয়েছে। ফান্ডটির সবশেষ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬১ টাকা।
তবে ফান্ডটি চাইলেই কেনা যায় না। আইসিবিতে গিয়ে আবেদন করে রাখতে হয়। কেউ বিক্রি করতে চাইলেই পাওয়া যায়, তবে বিক্রির পরিমাণ খুবই কম। আর একবারে কিনতে হয় ৫০ লাখ টাকার ফান্ড।
ব্যাপক লভ্যাংশ দিয়েছে এএএমএল ইউনিট ফান্ডও। তারা ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৪৩ টাকা আয় করে আড়াই টাকা লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফান্ডটির বর্তমান দাম ১৬ টাকা ৩ পয়সা।
এবার এখন পর্যন্ত যেসব ফান্ড লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে আইসিবি ইউনিট ফান্ডের লভ্যাংশ আলোচন তুলেছে সবচেয়ে বেশি
এই হিসাবে দামের ১৫.৫৯ শতাংশই লভ্যাংশ হিসেবে পেয়ে গেছেন বিনিয়োগকারীরা। গত বছর ইউনিটের দাম ছিল আরও কম। যারা কমে কিনেছেন, তাদের ইউনিট মূল্যের তুলনায় লভ্যাংশ শতকরা হারে আরও বেশি হয়েছে।
শান্তার ফান্ড
শান্তা ফার্স্ট ইনকাম প্রোপার্টি ফান্ড ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৮৮ পয়সা আয় করে ২ টাকা ৫ পয়সা লভ্যাংশ দিয়েছে।
এই ফান্ডটির সবশেষ মূল্য ১৪ টাকা ৬৭ পয়সা। কেউ যদি এই দামেও ফান্ডটি কিনে থাকেন, তার পরেও তার লভ্যাংশ এসেছে ইউনিটমূল্যের ১৩.৯৭ শতাংশ।
আইডিএলসির ফান্ড
আইডিএলসি ব্যালেন্সড ফান্ড ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ১৭ পয়সা আয় করে দেড় টাকা লভ্যাংশ দিয়েছে।
ফান্ডটি গত বছরের লোকসানের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে লভ্যাংশ কম দিয়েছে।
আইডিএলসি গ্রোথ ফান্ড ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৬০ পয়সা আয় করে লভ্যাংশ দিয়েছে দেড় টাকা।
২০১০ সালে তালিকাভুক্ত ডিবিএইচ মিউচ্যুয়াল ফান্ড চলতি বছরের আগে কখনও এত লভ্যাংশ নিতে পারেনি
গত বছরের লোকসানের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে লভ্যাংশ কম দিয়েছে।
অন্যদিকে আইডিএলসি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট শরিয়া ফান্ড ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৮৭ পয়সা আয় করে ১ টাকা ৪০ পয়সা লভ্যাংশ দিয়েছে।
ক্যাপিটেকের দুই ফান্ড
সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ক্যাপিটেক পরিচালিত মেয়াদহীন দুটি ফান্ডের মধ্যে ক্যাপিটেক পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এই ফান্ডটির সবশেষ ইউনিটমূল্য ১১ টাকা ৫৪ পয়সা।
পদ্মা প্রভিডেন্ট ফান্ডের শরিয়াহ ইউনিট ফান্ড ৭ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই ফান্ডটির বর্তমান ইউনিটমূল্য ১০ টাকা ৫৪ পয়সা। কেউ যদি এই দামে ইউনিট কিনে থাকেন, তাহলে তিনি মুনাফা অবশ্য কম পেয়েছেন; ৬.৬৪ শতাংশ। তবে এটিও বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যেকোনো সঞ্চয়ী স্কিমের সুদ হারের চেয়ে বেশি।
পেনিনসুলার তিন ফান্ড
পেনিনসুলা ব্যালেন্সড ফান্ড ইউনিটধারীদেরকে ১৭ শতাংশ অর্থাৎ ১ টাকা ৭০ পয়সা হারে লভ্যাংশ দেয়ার কথা জানিয়েছে।
ফান্ডটির ইউনিটপ্রতি আয় হয় ২ টাকা ৩৯ পয়সা। গত বছর এই আয় ছিল ১৫ পয়সা।
পেনিনসুলা এএমসিএল বিডিবিএল ফান্ড ইউনিটপ্রতি আরও বেশি আয় কমে কম লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এই ফান্ডটির আয় হয়েছে ৪ টাকা ৮৩ পয়সা। তবে লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ১ টাকা ৫০ পয়সা।
এই ফান্ডটি আগের বছর ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৭ পয়সা লোকসান দিয়েছিল। আর সেই লোকসানের সঞ্চিতি সংরক্ষণের কারণে এবার তারা লভ্যাংশ দিয়েছে মূলত বাকি ২ টাকা ৭৬ পয়সার ওপর। এই হিসাবেই ঘোষণা করা হয়েছে লভ্যাংশ।
গ্রিনডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ডও চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে
পেনিনসুলা সাধারণ বিমা করপোরেশন ফান্ড ইউনিটধারীদেরকে ১২ শতাংশ অর্থাৎ ১ টাকা ২০ পয়সা হারে লভ্যাংশ দেবে।
এই ফান্ডটি ইউনিটপ্রতি হয় ৩ টাকা ৮৭ পয়সা। তবে গত বছর ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৩০ পয়সা লোকসান দেয়ার কারণে সেটি লোকসান সমন্বয় করে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
ন্যাশনাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ফান্ড
আইবিবিএল ইসলামী ইউনিট ফান্ড ইউনিটধারীদেরকে ৯০ পয়সা করে লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
ফান্ডটির বর্তমান ইউনিটমূল্য ১০ টাকা ২৯ পয়সা, যেটি এক বছর আগে সর্বনিম্ন ৬ টাকা ৯২ পয়সাতেও কেনা গেছে।
গত বছর ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ১৫ পয়সা লোকসান দেয়া ফান্ডটি এবার ইউনিটপ্রতি মুনাফা করেছে ৪ টাকা ৪ পয়সা। আর আগের বছরের লোকসানের সঞ্চিতি সংরক্ষণের পর ইউনিটপ্রতি চূড়ান্ত আয় দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ২৮ পয়সা।